‘দ্য মুসলমান’—কীভাবে টিকে আছে বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো ও একমাত্র হাতে লেখা পত্রিকা?
অনলাইনের যুগে প্রিন্ট ভার্সনের পত্রিকাগুলো ক্রমেই হারাতে বসেছে। উন্নত বিশ্বে অধিকাংশ পত্রিকাই প্রিন্ট এডিশন বাদ দিয়ে পুরোপুরি অনলাইন সংস্করণের দিকে ঝুঁকছে। টাইপে ছাপা পত্রিকাই যখন হুমকির মুখে তখন হাতে লেখা পত্রিকার কথা শুনতে অবাকই লাগবে। কিন্তু সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে প্রায় ১০০ বছর ধরে প্রকাশিত হয়ে চলেছে সম্পূর্ণ হাতে লেখা পত্রিকা 'দ্য মুসলমান'। করোনার প্রকোপ কিংবা উন্নত প্রযুক্তির সঙ্গে দ্বন্দ্ব কোনোটাই থামাতে পারেনি এই পত্রিকাকে। পত্রিকাটিকে এখনও প্রকাশিত সবচেয়ে পুরোনো এবং বিশ্বের একমাত্র হাতে লেখা দৈনিক সংবাদপত্র বলা হয়ে থাকে।
ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের রাজ্য তামিল নাড়ুর উপকূলীয় শহর চেন্নাই থেকে প্রকাশিত হয় দ্য মুসলমান। ১৯২৭ সাল থেকে প্রকাশিত পত্রিকাটি ইতোমধ্যে ৯৪ বছর অতিক্রম করেছে। জওহরলাল নেহেরু এবং ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে এই পত্রিকার নাম। পত্রিকা অফিসে নিয়মিত আগমন ঘটে বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিক ও নামকরা ব্যক্তিদের। তাদের অনেকের লেখাই এখানে প্রকাশিত হয়। চার পাতার পত্রিকার প্রতি পাতা লিখতে লেগে যায় দুই থেকে তিন ঘণ্টা। মহামারির সময় ই-মেইলের মাধ্যমেও পাঠকদের কাছে পৌঁছে গেছে পত্রিকার কপি। ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সংমিশ্রণে কেমন চলছে পত্রিকাটি?
উর্দু ক্যালিগ্রাফিতে লেখা পত্রিকা
শের, শায়েরি আর গজলের ভাষা উর্দু। মান্টো কিংবা কৃষণচন্দরের উর্দু ভাষার সাহিত্য ভারত ও বাংলাদেশে সমানভাবে সমাদৃত। কিন্তু সাহিত্যিক মর্যাদা থাকা সত্ত্বেও সময়ের সঙ্গে ভারতে উর্দু চর্চা বিপন্ন।
উর্দু ভাষায় আছে ক্যালিগ্রাফির দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য। একটা সময় ছিল যখন বই, ম্যগাজিন কিংবা পত্রিকা সবই প্রকাশিত হতো হাতে লিখে। ক্যালিগ্রাফি লেখার এই শিল্পকে বলা হয় কিতাবাত। যারা লিখে থাকেন তাদের বলা হয় কাতিব বা লেখক। এই কাতিবদের লেখার দক্ষতা যন্ত্রের মতোই। সূক্ষ্ণ ও নির্ভুলভাবে কাটাছেঁড়া ছাড়াই তারা সুন্দর হরফে পাতার পর পাতা লিখতে পারেন। প্রিন্ট মিডিয়ার বিকাশের সঙ্গে এই কাতিবরা পৃষ্ঠপোষকতা হারায়। সময়ের সঙ্গে কিতাবাতের মতো শিল্পও হারিয়ে যেতে বসেছে।
ভাষার এই বিপন্ন অবস্থায় বিশ্বব্যাপী উর্দু ক্যালিগ্রাফি ও ভারতে উর্দু চর্চায় সক্রিয় ভূমিকা রাখছে দ্য মুসলমান। হাতে লেখার পর পত্রিকাটির ছাপানো কপি প্রতিদিন প্রায় ২১ হাজার গ্রাহকের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে।
যেভাবে যাত্রা শুরু
১৯২৭ সালে সৈয়দ আজমাতুল্লাহর হাত ধরে 'দ্য মুসলমান' পত্রিকার যাত্রা শুরু। সৈয়দ আজমাতুল্লাহর মনে হয়েছিল ভারতের উর্দু ভাষাভাষী মুসলিমদের পক্ষে কথা বলার মতো একটি পত্রিকা থাকা প্রয়োজন। এই ভাবনা থেকেই তিনি পত্রিকাটি প্রকাশ করেন। দ্য মুসলমানের প্রথম সংস্করণ উদ্বোধন করেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম নেতা ও মাদ্রাজ সেশনের সভাপতি মুখতার আহমেদ আনসারি। চেন্নাইয়ের ৩২৪ ট্রিপলিকেন হাই রোডে অবস্থিত এর পত্রিকা অফিস।
সৈয়দ আজমতউল্লাহর পর পত্রিকার দায়িত্ব নেন তার ছেলে সৈয়দ ফজলুল্লাহ। ২০০৮ সালে ৭৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন ফজলুল্লাহ।
বাবার মৃত্যুর পর আজমাতুল্লাহর নাতি সৈয়দ আরিফুল্লাহ পত্রিকাটি পরিচালনা করেন। মার্কেটিং এ এমবিএ করা সৈয়দ আরিফুল্লাহ দাদার স্বপ্নকে ধরে রাখতেই পত্রিকাটির নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন।
প্রতি পাতা লিখতে লাগে দুই ঘণ্টা
স্প্রেডশিটে প্রকাশিত পত্রিকাটি ভাজ করে চার পাতার পত্রিকা প্রকাশিত হয়। প্রথম পাতায় স্থানীয় ও জাতীয় সংবাদ প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় পাতায় থাকে সম্পাদকীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদ। তৃতীয় পাতায় থাকে কুরআনের আয়াত। শেষ পৃষ্ঠায় বিজ্ঞাপন, স্থানীয় সংবাদসহ প্রায় সব ধরনের সংবাদই থাকে।
কুইল কলম ও কালিতে এক পাতা লিখতে একজন ক্যালিগ্রাফারের দুই ঘণ্টা সময় লাগে। কোনো কিছু ভুল হলে সাধারণত পুরো পাতার কাজই নতুন করে করতে হয়। লিখিত কপিটি এরপর নেগেটিভে রূপান্তরিত করা হয়। সেখান থেকে পত্রিকাটি সরাসরি প্রিন্টিংয়ে যায়।
দ্য মুসলমান পত্রিকায় বর্তমানে তিনজন প্রতিবেদক কাজ করছেন। প্রতিবেদকরা সকলেই পুরুষ। রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, খেলার সংবাদ- সবই তারা সংগ্রহ করেন। ক্যালিগ্রাফির কাজ করেন তিনজন কাতিব। এদের মধ্যে দুজন নারী। খুরশিদ বেগম, শাবানা বেগম এবং রহমান হুসেন- এই তিন কাতিব দীর্ঘদিন ধরে পত্রিকাটিতে কাজ করে চলেছেন।
এখনকার কাতিবরা প্রায় ২৫ থেকে ৩০ বছর ধরে লেখার কাজ করছেন। আর তাই লেখায় এখন সেরকম ভুলও হয় না।
নিয়মিত গ্রাহকের মধ্যে আছে অসংখ্য হিন্দু পাঠক
দ্য মুসলমানের সার্কুলেশন সংখ্যা প্রায় ২১ হাজার। সারা ভারতবর্ষেই পত্রিকাটির গ্রাহক রয়েছে। দিল্লি, মুম্বাই, কলকাতা সব জায়গায় পৌঁছে যায় পত্রিকার কপি। চেন্নাইয়ে হকারদের কাছেও মিলবে এই পত্রিকা।
তবে দ্য মুসলমান শুধু মুসলিমদের পত্রিকা নয়। উর্দুভাষা জানেন ও চর্চা করেন এমন বহু হিন্দুও এই সংবাদপত্রের নিয়মিত গ্রাহক।
পত্রিকার অধিকাংশ বিজ্ঞাপন আসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারের কাছ থেকে। এছাড়া কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও সরাসরি বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে। পত্রিকাটি টিকিয়ে রাখতে এই বিজ্ঞাপনগুলো যথেষ্ট বলে মনে করেন সৈয়দ আরিফুল্লাহ। কিছু বিজ্ঞাপন ডিজিটালি, আবার কিছু বিজ্ঞাপন ম্যানুয়ালিও এসে থাকে।
পুরো পত্রিকাই সাদা এবং কালো হরফে সাজানো। তবে কোনো রঙিন বিজ্ঞাপন ছাপানোর অনুরোধ আসলে, বিশেষভাবে সেগুলোও ছাপা হয়ে থাকে।
দ্য মুসলমানের বার্ষিক সাবস্ক্রিপশন খরচ মাত্র ৪০০ টাকা। প্রতিটি পত্রিকার দাম মাত্র ৭৫ পয়সা।
অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতীক 'দ্য মুসলমান'
পত্রিকাটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক চমৎকার ইতিহাস। ৬০-এর দশকের শুরুতে জওহরলাল নেহেরু কেরালা সফরে যান। তিনি তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। দ্য মুসলমান পত্রিকার পক্ষ থেকে নেহেরুর সাক্ষাৎকার নিতে আসেন কৃষ্ণা আইয়ার। কৃষ্ণা যখন নেহেরুর সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন তখন আরেক পত্রিকা দ্য হিন্দুর ফটোগ্রাফার মোহাম্মদ আসাদ কক্ষে প্রবেশ করেন। মুসলিম নামের একটি পত্রিকায় হিন্দু সাংবাদিক এবং হিন্দু নামের পত্রিকায় মুসলমান সাংবাদিককে কর্মরত দেখে চমৎকৃত হন নেহেরু। বহুত্ববাদ ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতার এক অনন্য উদাহরণ এই ঘটনা।
বেশ কয়েক বছর পর ইন্দিরা গান্ধী ভারতের অসাম্প্রদায়িকতার উদাহরণ হিসেবে এই ঘটনার বর্ণনা দেন। চেন্নাই থেকে আজও দুটি পত্রিকাই প্রকাশিত হয়।
মহামারিতেও বন্ধ হয়নি প্রকাশনা
করোনার মাঝেও ৯৪ বছর ধরে পত্রিকাটি ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। ভারতে করোনার ভয়াবহ প্রকোপের হাত থেকে রেহাই পায়নি চেন্নাইও। কিন্তু তারপরও আরিফুল্লাহর নেতৃত্বে কাজ চালিয়ে গেছে দ্য মুসলমানের পুরো দল। করোনা থাকা সত্ত্বেও কমেনি তাদের গ্রাহক সংখ্যা। কঠোর লকডাউনের মাঝেও করোনা-পূর্ব সময়ের মতোই যথাসময়ে দ্বারে দ্বারে পৌঁছেছে মুসলমানের কপি।
তবে সম্প্রতি কিছুদিনের জন্য পত্রিকাটির প্রিন্ট ভার্সন বন্ধ আছে। গ্রাহকরা এখন ই-মেইলের মাধ্যমে নিজেদের কপি পাচ্ছেন। খুব শীঘ্রই প্রিন্ট সংস্করণ পুনরায় চালু হবে বলে জানিয়েছেন আরিফুল্লাহ। করোনায় লকডাউনের কারণে পাঠকসংখ্যায় কোনো প্রভাব পড়েনি বলেও খালিজ টাইমসকে জানান তিনি ।
বর্তমানে এই পত্রিকাটি নিতে চাইলে সরাসরি চেন্নাইয়ের ট্রিপলিকেনের অফিসে যেয়ে খোঁজ নিতে হবে অথবা পাঠিয়ে দিতে হবে চেক। পরিচালনা কমিটি এখনও ব্যাংকের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন করে না।
তৃতীয় প্রজন্মের সম্পাদক
তিন ভাই ও চার বোনের পরিবারের মধ্যে বাবা সৈয়দ ফজলুল্লাহর মৃত্যুর পর সৈয়দ আরিফুল্লাহ পত্রিকাটির দায়িত্ব নেন।
২০০৭ সালে বৃদ্ধ ফজলুল্লাহ আশঙ্কা করেন তার মৃত্যুর পর ক্যালিগ্রাফির এই সংস্কৃতি হারিয়ে যাবে। ফয়জুল্লাহর পুত্র সৈয়দ নাসরুল্লাহ বলেছিলেন তিনি ক্যালিগ্রাফিতে আগ্রহী নন। তবে নাসরুল্লাহ আগ্রহী না হলেও হাল ধরেছেন তার ছোট ভাই সৈয়দ আরিফুল্লাহ। ২০০৮ সাল থেকে তিনিই পত্রিকাটি পরিচালনা করছেন।
খালিজ টাইমকে আরিফুল্লাহ জানান, এই পত্রিকা চালানোর স্বপ্ন তার দাদার ছিল। আর তাই তিনি এমবিএ করার পরও এই পেশা বেছে নিয়েছেন। নিজের শিক্ষা ও যাবতীয় প্রচেষ্টার মাধ্যমে তিনি এই ক্যালিগ্রাফি সাংবাদিকতাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
আরিফুল্লাহ আরও জানান এখানে সবাই পরিবারের মতোই কাজ করে। কেউ কোনো ভুল করলে অন্যরা এসে সাহায্য করে। আঙ্গুল তুলে কারও দিকে কেউ অভিযোগ করে না।
পাঠকদের কাছ থেকে দিনে অন্তত ২০টি ফোনকল পান আরিফুল্লাহ। অনেকে পত্রিকাটির বিষয়ে জানার জন্য ফোন করেন। আবার অনেকেই ফোন করে ধন্যবাদ জানান। অধিকাংশ পাঠকই বর্তমানে ই-মেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ করলেও এখনও তিনি বেশ কিছু চিঠি পান।
সময়ের সঙ্গে অনেক কিছু বদলে গেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই ক্যালিগ্রাফির ঐতিহ্য কেন ধরে রেখেছেন আরিফুল্লাহ? খালিজ টাইমসকে তিনি বলেন, 'সময়ের সঙ্গে প্রিন্টিং শিল্পে অনেক পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু দ্য মুসলমান পরিবর্তিত হলে এর বৈচিত্র্য থাকবে না। আমিও মানুষের শ্রদ্ধা আর বিশ্বস্ততা হারাব।'
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পত্রিকাটির একটি পেজ থাকলেও সেটি সক্রিয় নয়। আরিফুল্লাহর পর এই পত্রিকার দায়িত্ব কে নিবে তা এখনও নিশ্চিত নয়। তবে নিজের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই পত্রিকার জন্য কাজ করে যাবেন আরিফুল্লাহ।
তার মতে, উর্দু একটি মিষ্টি ভাষা। পাঠকরা এটা জানেন ও বুঝেন বলেই তারা এই পত্রিকা নিয়ে সন্তুষ্ট। এত চমৎকার একটি ভাষার মিষ্টতা কেবল হাতে লেখা ক্যালিগ্রাফির মাধ্যমেই ফুটিয়ে তোলা সম্ভব বলে মনে করেন পত্রিকাটির বর্তমান সম্পাদক সৈয়দ আরিফুল্লাহ।