উপমহাদেশে ফিরিঙ্গি পোশাক
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/02/15/a._4._bhaartiiy_grhkrmii_pribessttit_memsaaheb_0.jpg)
পাকিস্তানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত শৈলনিবাস মারির কাহিনি। সময় ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপনের প্রাথমিক বছরগুলো। সেখানে জমি কিনে স্বাস্থ্যনিবাস এবং বিনোদনকেন্দ্র স্থাপন করবে ইংরেজ সাহেব। জায়গা কেনার চেষ্টা করছে। জায়গা পছন্দ হওয়ার পর দাম কমানোর জন্য বিস্তর মুলামুলি করতে হয়। পরে জায়গার দাম শোধ করার জন্য সস্ত্রীক হাজির হন সাহেব। মেমসাহেবের গায়ে স্বল্প বেশভূষা দেখে জমির মালিকের চক্ষুস্থির। ধরে নেয় সাহেবের আর্থিক অবস্থা মোটেও সুবিধার নয়; এ জন্যেই এমন দরাদরি করেছে। করুণাবশত লোকটা জমির দাম আরও কমিয়ে দিল। সাহেব অবাক। লোকটা কেন এমন দয়াবান হয়ে উঠল? সাহেবের কাছে তার কারণ অজানাই রইল।
স্বাস্থ্যনিবাস ও বিনোদনকেন্দ্র গড়ে লালে লাল হয়ে গেল সাহেব। আরও জমি চাই। বাড়াতে হবে সুযোগ-সুবিধা। লাভের ঘর তাতে আরও মোটা হবে। এবার স্ত্রী নিয়ে গেল দরদাম করতে। সাহেবের তরক্কি হয়েছে। বিত্ত বেড়েছে। মেমসাহেবের পোশাক-আশাক আগের তুলনায় আরও কমেছে। জমির মালিকের আর সহ্য হলো না। বলেই ফেলল, সাহেব, মাওলার ইচ্ছায় টাকাকড়ি তো অনেক হলো। এবার কিছু অর্থ খরচ করে মেমসাহেবের গা ঢাকার মতো পোশাক বানিয়ে দাও!
সম্ভবত মুজতবা আলী এ কাহিনি শুনিয়েছেন। ব্রিটিশ পোশাক-পরিচ্ছদের প্রতি দেশীয় মানুষের আংশিক ভাবনা এতে উঠে এসেছে।
ব্রিটিশ বা ঔপনিবেশিক শাসকদের পোশাক নিয়ে ভিন্ন গল্পের নায়ক বাংলা ভাষায় অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। মধুকবি তার বন্ধু এবং সহযোগী রাজার মজলিশে আপাদমস্তক সাহেবি পোশাক-পরিচ্ছদ পরে হাজির। রাজা বিস্ময় চেপে রাখতে পারলেন না। ঐতিহ্যবাহী হিন্দু পোশাক ধুতি ও শাল না পরে হঠাৎ কেন এমন সাহেবি পোশাকে উদয় হলেন-সে কথা জানতে চাইলেন। জবাব দিলেন কবি, ওই সব ছাইপাঁশ কাপড়চোপড় পরে আসলে আমাকে পানির কলসি টানতে হতো বা থালাবাসন বিছানোর কাজে হাত লাগাতে হতো। কিন্তু রাজপোশাক পরায় আর তেমনটি হওয়ার জো নেই।
কদিন পরে এই দত্তকে দেখা গেল পুকুর থেকে ধুতি পরেই উঠে আসছে। সেদিনকার মজলিশের এক বন্ধু এতে অবাক হলো। প্রশ্ন করতে ছাড়েন না, মধু কী হলো? কোথায় টুপি, কোথায় কোট? কবি দমার পাত্র নন। তিনি বললেন, মানুষ পরিস্থিতি অনুযায়ী বদলে যায়, মানুষ নানা রূপ নানা বেশ ধারণ করে।
উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের শুরুতে, মধুসূদন দত্তের মতো মানুষকে প্রায়ই পোশাক নিয়ে দ্বিধায় পড়তে হতো। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ গোটা উপমহাদেশে কেবল নতুন ধরনের সরকার, ভাষা এবং সামাজিক সহবত নিয়েই আসেননি। বরং নতুন ধরনের সভ্যতাকেও আমদানি করে, যার সাথে চলার উপযোগী পোশাক-পরিচ্ছদও একই সাথে এসে জোটে।
ইংল্যান্ডের মানুষেরা শাসন করছে; তাই তারা শ্রেষ্ঠ এমনকি তাদের পোশাকও শ্রেষ্ঠ। এমনি ভাবনাকে নিয়ে বাংলা ভাষায় ব্যঙ্গ গল্পও লেখা হয়েছে। গল্পে ঘটনা উল্টে দেওয়া হয়েছে। ভারতীয় হিন্দু বাঙালি হেলায় ইংল্যান্ড নামের দ্বীপদেশকে জয় করেছে। সেখান মানুষ হিন্দু বাঙালির সব সংস্কৃতিকেই রাজার সংস্কৃতি জ্ঞানে সবার সেরা মনে করছে। ইংল্যান্ডের দুর্দান্ত শীতের মধ্যেও বিদ্যালয়ে গুটিকয়েক বালক মিহি ধুতি এবং গিলা-করা আস্তিন এবং সোনার বোতাম লাগানো ফিনফিনে পাঞ্জাবি পরে হাজির হয়েছে। শিক্ষক-ছাত্রদের মধ্যে ইংরেজির বদলে সংস্কৃত পড়ার অধিক ঝোঁক দেখে যারপরনাই বিরক্ত হচ্ছেন। কিন্তু ছাত্রদের জবাব, রাজপোশাকই সেরা পোশাক, রাজ ভাষাই সেরা ভাষা।
'ক্লথিং মেটারস ড্রেস অ্যান্ড আইডেনটিটি ইন ইন্ডিয়া' গ্রন্থে এম টারোল লিখেছেন, বেশির ভাগ ব্রিটিশ পুরুষ ও নারী বিশ্বাস করতেন যে তাদের রীতিনীতি ও জীবনধারায় নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের আলামত রয়েছে। উপমহাদেশের অনেক শিক্ষিত মানুষ ইউরোপের বৈজ্ঞানিক ও শিক্ষাগত উন্নতিকে প্রশংসা করলেও নির্বিচারে কিছু করেননি। ইউরোপীয় সংস্কৃতি থেকে ঝেড়ে-বেছে কিছু বিষয় বিচক্ষণতার সাথে গ্রহণ করতেন তারা।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/02/15/a_2._sheaalaar_hyaatt_praa_inrej_pribaar_1920.jpg)
পোশাক-পরিচ্ছদেও ছিল এমনই একটি বিষয়। হিমালয়ান উপমহাদেশে পোশাক বরাবরই সামাজিক ও ধর্মীয় পরিচয়ের প্রতীক হিসেবে বিরাজ করত। তাই বেশির ভাগ মানুষ, বিশেষ করে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী ও নারীরা ঐতিহ্যবাহী পোশাকের বৃত্তেই রয়ে গেলেন। কিন্তু ব্রিটিশ শিক্ষায় শিক্ষিত এক ক্ষুদ্র উপমহাদেশীয় গোষ্ঠীর জন্য ইউরোপীয় পোশাক একটি কঠিন বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ইউরোপীয় দৃষ্টিতে এটি তাদেরই সভ্যতার অংশ। তাই একে উপেক্ষা করা কঠিন। তবে পুরোপুরি গ্রহণ করাও ছিল নিজের সংস্কৃতি ত্যাগ করার মতো।
ইংরেজি শিক্ষায় নব্য শিক্ষিত মানুষগুলো কখনো অস্বস্তিকে পুষে রেখে, কখনো স্বাচ্ছন্দ্যে বোধ নিয়ে, আবার কখনো মধুসূদন দত্তের মতো রসিকতা ও বিদ্রুপের মিশেল দেওয়ার মাধ্যমে পোশাকের এই দ্বন্দ্বকে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
উপমহাদেশের ইতিহাসে বিভিন্ন কালে বা যুগে বিচিত্র পোশাকের সাথে মানিয়ে নেওয়া মোটেও নতুন নিয়ম বা উৎপাত নয়। ইতিহাসজুড়ে ব্যবসায়ী, পর্যটক ও বিজয়ীরা নতুন নতুন পোশাক-আশাকের ধারা নিয়ে এসেছে। মোগল যুগে সরকারি কর্মচারীদের মোগল পোশাক পরতে হতো। হিন্দুরা এটাকে সহজে মেনে নিতে পারেনি। অনেক হিন্দু বাড়িতে ঢোকার আগে কাজের কারণে পরিহিত পোশাক খুলে নিজেদের কর্মের সাথে পরিচয়কে আলাদা করতেন।
এদিকে মোগলদের মতো নিজেদের পোশাক চাপিয়ে দেয়নি ব্রিটিশরা। বরং তারা অন্ধ অনুকরণ নিরুৎসাহিত করত, এমনটিই গ্রন্থটির দাবি। কোনো ভারতীয় ইউরোপীয় পোশাক পরার মানে হলো, তা তার নিজের সিদ্ধান্তের ফল। এই ধারা মোগল আমলে বাধ্য হয়ে পোশাক পরার তুলনায় বেশি তর্কের জন্ম দিয়েছিল।
ইউরোপীয় পোশাক-পরিচ্ছদের আগমনকে উপমহাদেশীয়রা বিভিন্নভাবে মানিয়ে নিতে শুরু করে। কেউ ভারতীয় ও পাশ্চাত্য পোশাক মিশিয়ে পরতেন। কেউ পরিস্থিতি অনুযায়ী পোশাক বদলাতেন। আবার কেউ কেউ একই পোশাকে উপমহাদেশীয় এবং পশ্চিমা বৈশিষ্ট্যকে মিলিয়ে নিতেন। বিদেশ থেকে আমদানি হওয়া যন্ত্রে তৈরি বস্ত্র এসব পরিবর্তনের কর্মকাণ্ডকে করে তুলেছিল আরও জটিল।
ভিনদেশি বা ফিরিঙ্গি পোশাক বেছে নেওয়ার তৎপরতা পরিবার, বর্ণ, বন্ধু, সহকর্মী এবং ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে নানা প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিল। নানামুখী ঝোড়ো হাওয়া বইয়ে দিতে শুরু করে। ব্রিটিশরাও ভারতীয় পোশাক-আশাকের পরিবর্তনের দিকে নজর রাখত। কখনো কখনো এটি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করত। আবার কখনো উপমহাদেশীয়রা 'অনুপযুক্ত পোশাক পরে' বলে বিদ্রুপ করত।
এমন সব সামাজিক এবং ঔপনিবেশিক চাপ এদেশীয়দের কাছে বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। তাদের অনেকের জন্য পোশাক-পরিচ্ছদ বেছে নেওয়া জটিল হয়ে দেখা দিয়েছিল।
উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী পোশাক-পরিচ্ছদ ছিল বৈচিত্র্যে ভরপুর। বেশির ভাগ পোশাক সেলাই করা হতো না। বরং শরীরে জড়িয়ে পরার উপযোগী ছিল। ঔপনিবেশিক শাসনের আগে সাধারণ পোশাক ছিল সেলাইবিহীন কাপড়, যা শরীরের চারপাশে পেঁচিয়ে ও ভাঁজ করে পরা হতো। পুরুষদের পোশাক সাধারণত সাদা, কখনো একরঙা, আবার কখনো পাড়ে নকশাযুক্ত হতো। পরিচ্ছদ প্রধানত সুতিরই হতো। তবে রেশমও ব্যবহার হতো। গরিব মানুষগুলো শুধু 'লাঙ্গোট' পরত। 'ধুতি' ব্যবহারেরও চল ছিল; যা বিভিন্নভাবে বাঁধা যেত। ঋতু ও অনুষ্ঠানের ওপর নির্ভর করে ঊর্ধ্বাঙ্গ কখনো খালি থাকত, কখনো 'চাদর' দিয়ে ঢাকা থাকত। অঞ্চলভেদে মাথায় 'পাগড়ি' বাঁধার রীতি। একেক অঞ্চলে পাগড়ি একেকভাবে পরা হতো। ১৯ শতকের মধ্যে অনেক পুরুষ ধুতি বা পাজামার সাথে লম্বা কুর্তা বা শার্ট পরতে শুরু করে এবং কিছু লোক পুরোপুরি সেলাই করা পোশাক পরতে অভ্যস্ত হয়ে যায়।
নারীদের পোশাক প্রথম দিকে পুরুষদের মতোই ছিল, তবে সময়ের সাথে সাথে দুই টুকরো কাপড়ের পরিবর্তে একটি বস্ত্রে দেহ ঢাকা প্রধান পোশাক হয়ে ওঠে, যা আজও জনপ্রিয় 'শাড়ি' নামে পরিচিত। বৈদিক যুগের শেষের দিকে শাড়ি কোমরের চারপাশে পেঁচিয়ে এক প্রান্ত ঊর্ধ্বাঙ্গে জড়ানো হতো। কখনো মাথা বা মুখ ঢাকতে ব্যবহৃত হতো। সাধারণত শাড়ি সুতির বা রেশমের তৈরি হতো। শাড়িকে রং, ছাপা বা সূচিকর্ম দ্বারা অলংকৃত করা হতো। ১৯ শতকের শেষের দিকে শিক্ষিত শহুরে ও কিছু গ্রামীণ নারীরা শাড়ির সাথে ব্লাউজ ও অন্তর্বাস পরতে শুরু করে। উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী পোশাকগুলোর (ধুতি, লুঙ্গি, শাড়ি, চাদর, পাগড়ি) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল যে এগুলো সেলাই করতে হতো না। শুধু শরীরে জড়িয়ে গিঁট দিয়ে পরা যায়।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/02/15/a._3._uunish_shtker_shaaddi-blaaus.jpg)
সেলাই করা পোশাক উপমহাদেশে মুসলমান শাসকেরাই প্রথম এনেছেন-এমন একটি মতবাদ প্রচলিত আছে। কিন্তু প্রমাণ রয়েছে যে খ্রিষ্টপূর্ব ১১ শতকেই উপমহাদেশের কোনো কোনো অঞ্চলের নারী সেলাই করা ঘাঘরা, চোলি এবং ওড়না পরতেন। মুসলমানদের বিজয়ের অনেক আগেই উত্তর ও পশ্চিম হিমালয়ান উপমহাদেশের কোনো কোনো পুরুষ সেলাই করা কুর্তা ও পায়জামা পরতেন। তবে সুলতানি এবং মোগল আমলে সেলাই করা পোশাক-পরিচ্ছদ ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। বিভিন্ন ধরনের পায়জামা, চোগা ও কুর্তার বিস্তার ঘটে এভাবেই।
১৯ শতকের মধ্যে উপমহাদেশের একজন শিক্ষিত পুরুষ সাধারণত জনসমক্ষে লম্বা হাতাওয়ালা পোশাক জামা বা আঙ্গরখা বা কুর্তা ও পাজামা পরতেন। ঘরে ফিরে তিনি ঐতিহ্যবাহী জামাকাপড় পরতে পছন্দ করতেন। মুসলমান নারীরা সাধারণত দোপাট্টা বা লম্বা কামিজের সাথে পাজামা বা সালোয়ার, চওড়া ঘেরওয়ালা ঘাগরা পরতেন। মুসলমান নারীদের এসব পোশাক-পরিচ্ছদ অবিভক্ত ভারতে ধীরে ধীরে অনেক হিন্দু নারীও গ্রহণ করে। পরে উত্তর ভারতের কিছু অঞ্চলে সাধারণ পোশাক হয়ে ওঠে এগুলো।
সেলাই করা এবং সেলাই ছাড়া গায়ে জড়ানো পোশাকের পার্থক্য অনেক সময় হিন্দু এবং মুসলানদের পোশাকের বিভাজন চিহ্ন হিসেবে ধরা হতো। হিন্দুদের মধ্যে অনেকেই বিশ্বাস করতেন যে সেলাই করা কাপড় ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অপবিত্র। তারা এ ধরনের পোশাক-আশাককে গায়ে চড়াতে আপত্তি জানাতেন। সেলাই করা পোশাকের বিরুদ্ধে প্রাচীনকালে হিন্দু ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়নি। অনেকেই মনে করেন, কিছু কিছু হিন্দু ঐতিহ্য ধরে রাখতে এই যুক্তি ব্যবহার হয়েছিল। অন্যদিকে কিছু মুসলমান শালীনতার যুক্তি দেখিয়ে হিন্দুদের সেলাই করা পোশাক-পরিচ্ছদ ব্যবহার করতে উৎসাহিত করতেন। ভারতে মুসলমানদের আগমনের আগেও সেলাই করা পোশাক ব্যবহৃত হতো। অবশ্য পরবর্তী সময়ে সেলাই করা পোশাককে 'মুসলমান পোশাক' হিসেবে হয়তো পরিচিত করে তোলা হয়েছে।
১৯ শতকের শেষের দিকে অনেক শিক্ষিত হিন্দু পরিবার সেলাই করা পোশাককে উন্নত রুচি এবং আধুনিকতার প্রতীক হিসেবে গণ্য করত। কিন্তু তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে সেলাই করা এমন পোশাককে অপবিত্র বলে মনে করত।
ইউরোপীয় ব্যবসায়ী, মিশনারি ও ঔপনিবেশিক প্রশাসকদের মাধ্যমে ইউরোপীয় পোশাকের প্রভাব আরও বৃদ্ধি পায়। ইউরোপীয় পোশাক উপমহাদেশীয় পোশাকের তুলনায় একেবারেই আলাদা ছিল। ফিরিঙ্গিদের পোশাক শরীরের গঠন অনুসারে কাটছাঁট ও সেলাই করা হতো। পুরুষদের পোশাক-আশাক তৈরি হতো সোজাসাপটা ভাবে। কিন্তু নারীদের পোশাকে শরীরের বাঁক স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলত। তবে অধিকাংশ দেশীয়রা নিজস্ব পোশাকের তুলনায় ইউরোপীয় পোশাককে অস্বস্তিকর এবং জলবায়ুর জন্য অনুপযুক্ত মনে করত।
উপমহাদেশের রোদ থেকে সুরক্ষার জন্য ১৮৪০-এর দশকে একটি নতুন টুপি তৈরি করা হয়েছিল। এটি 'সোলা হ্যাট' (পিথ হেলমেট) নামে পরিচিতি হয়ে ওঠে। হ্যাটটি এতটাই জনপ্রিয়তা পায় যে ভারতীয়রা ইউরোপীয়দের 'টুপিওয়ালা' নামে ডাকতে শুরু করে।
পরবর্তী সময়ে স্যুট, প্যান্টের মতো হ্যাটও ইংরেজি শিক্ষিত উপমহাদেশীয়দের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কলকাতার উচ্চবর্ণের হিন্দুদের মধ্যে ইংরেজি পোশাক-পরিচ্ছদের অনুগমন বেশি দেখা যায়। তুলনামূলকভাবে কম হলেও পূর্ব বাংলার ঢাকাসহ অন্যান্য শহরের শিক্ষিত মুসলমানরা এই প্রবণতায় শামিল হয়েছিল।
এই প্রবণতায় সবাই ভেসে যায়নি। অনেক বাঙালিই মনে করত, ইউরোপীয় পোশাক-পরিচ্ছেদ অন্ধভাবে গায়ে চাপানো মানে নিজের সাংস্কৃতিক পরিচয় ত্যাগ করা। ব্রিটিশ পোশাক যারা গ্রহণ করত, তাদের অনেক সময়ই 'বাবু' বলে ব্যঙ্গ করা হতো। 'বাবু' বলতে ব্রিটিশদের অন্ধ অনুকরণকারীদের বোঝানো হতো। ইউরোপীয় পোশাক পরা নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপও বাংলার সাহিত্যে উঠে এসেছে। সেকালে খবরের কাগজ, সাময়িকী, পত্রপত্রিকা ও সাহিত্যিকেরা অনেক সময় বাঙালি বাবুদের ইউরোপীয় পোশাকের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তিকে ব্যঙ্গ করেছে।
এদিকে কেউ কেউ ইউরোপীয় ও ঐতিহ্যবাহী পোশাকের মিশ্রণও ঘটিয়েছে। ধুতি, পাজামা এমনকি লুঙ্গির সাথে কোট পরার ধারা সেই প্রবণতার সাক্ষী হয়ে রয়েছে।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/02/15/a._1._brittish_phrk_theke_sheroyaani_aaliigdd_mubhmentt-_noyaab_mhsi_ul_muulk_baanye_syaar_saiyd_aahmd_khaan_jaasttis_saiyd_maamud.jpg)
মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব বাংলায় এই প্রবণতা কিছুটা ভিন্ন পথ ধরেছিল। কলকাতার হিন্দু অভিজাতরা তুলনামূলকভাবে বেশি ইউরোপীয় পোশাক গ্রহণ করেছিল। পূর্ব বাংলার মুসলমান সমাজে পুরোপুরি ইউরোপীয় পোশাকের প্রচলন তুলনামূলকভাবে কম ছিল। মুসলিম অভিজাতরা অনেক সময় স্যুটের সাথে রুমি বা ফেজ টুপি পরতেন। এভাবে আধুনিকতার ছোঁয়া বজায় রাখার পাশাপাশি তাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ও বজায় রাখত তারা।
বাঙালি নারীদের মধ্যে ইউরোপীয় পোশাক-পরিচ্ছদের প্রভাব তুলনামূলকভাবে কম ছিল। পুরুষদের মতো তারা ব্রিটিশ প্রশাসনের সাথে সরাসরি সংস্পর্শে আসার সুযোগ কম পেয়েছে। তাদের পোশাকেও পরিবর্তন কম দেখা গেছে।
সাধারণভাবে পূর্ব বাংলায় নারীরা ঐতিহ্যবাহী শাড়িই পরিধান করত। পাশাপাশি কলকাতার অভিজাত হিন্দু পরিবারগুলোর মধ্যে ইউরোপীয় প্রভাব লক্ষ করা যায়, বিশেষ করে ব্লাউজ ও পেটিকোটের প্রচলন শুরুর সাথে এই প্রভাবের স্বাক্ষর রয়েছে। একে ভিক্টোরিয়ান পোশাকের প্রভাব বলে মনে করা হয়। এদিকে থেকে পূর্ব বাংলার মুসলিম নারীরা খানিক স্বতন্ত্র অবস্থানে ছিল। এমন পরিবর্তনের সাথে খুব বেশি একাত্ম হয়নি তারা। তারা তখনো বোরকা বা ঢিলেঢালা ঐতিহ্যবাহী পোশাকেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করত।
বিশ শতকের প্রথম দিকে স্বদেশি আন্দোলনের (১৯০৫-১৯১১) সময় ব্রিটিশ পণ্যের পাশাপাশি ইউরোপীয় পোশাক বর্জনের আহ্বান জানানো হয়। বাংলার জাতীয়তাবাদীরা ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের ডাক দেন। হাতে বোনা খাদি কাপড় ব্যবহারের ওপর জোর দেয় তারা। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী চরকায় সুতা কাটার এবং বিদেশি বস্ত্র ত্যাগ করে খাদি পরার আন্দোলনের সূচনা করেন। খাদি তৈরি এবং সাগরের পানি থেকে নুন তৈরির বিদ্যা গান্ধী পূর্ব বাংলার অবিভক্ত নোয়াখালী থেকে রপ্ত করেছিলেন। এই আন্দোলনকে ঘিরে গান রচিত হয়েছিল-'মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই/ দীন দুখিনি মা যে তোদের/ তার বেশি আর সাধ্য নাই।'
প্রথম দিকে পূর্ব বাংলার মুসলমানদের মধ্যে ইউরোপীয় পোশাকের বর্জনের ডাক তেমন সাড়া ফেলেনি। এদিকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বিস্তার লাভ করে। ইউরোপীয় পোশাককে ঔপনিবেশিক দাসত্বের প্রতীক হিসেবে দেখতে শুরু করেন। তা ছাড়া মুসলমান রাজনৈতিক নেতা এ কে ফজলুল হক স্বনির্ভরতার পক্ষে কথা বলেন। তিনি স্থানীয় শিল্পের প্রসারে জোর দেন। সব মিলিয়ে ইউরোপীয় পোশাক পরার চলকে আরও কমিয়ে দেয়।
বাংলাদেশের কুমার-কামার-চাষি-শ্রমিকের নিত্যদিনের পোশাক লুঙ্গি আজও জাতে ওঠেনি। অনুষ্ঠানে বা উৎসবে লুঙ্গি পরে যায় না কেউ। বহুজাতিক কোম্পানির সাক্ষাৎকার বা আইএসএসবিতে কেউ লুঙ্গি পরে হাজির হওয়ার কথা ভাবতেই পারে না। কেউ যদি এমন দুঃসাহস দেখায়ও তাহলে 'দেখা মাত্র বিদায়' অবধারিত। বাংলাদেশের খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বদের মধ্যে একমাত্র মাওলানা ভাসানীই ইউরোপ থেকে চীন পর্যন্ত সর্বত্র লুঙ্গি পরে বিচরণ করেছেন।
লুঙ্গি নিয়ে একটি ঘটনার কথা স্মৃতি থেকে বলছি, ১৯৭০-এর কোনো এক সময়ে ঢাকার অভিজাত রেস্টুরেন্ট রেক্সে লুঙ্গি পরে ঢুকতে গিয়ে বাধার মুখে পড়েছিলেন কেউ একজন, তিনি খোদ ভাসানীই, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। পরে এক লাখ টাকার মানহানির মামলা করে দেওয়া হয়েছিল। মফস্বলের স্কুলের ছাত্র আমি, দৈনিক খবরের কাগজ পড়ে বিষয়টি জানতে পেরেছিলাম। সে মামলার রায় আসার আগেই বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। রেক্সের অভিজাতগিরি উবে যায়। মামলাটিও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়।
আমাদের বাসায় বহু পুরানকালের খবরের কাগজ একসময় ছিল। স্টেটমেন্ট পত্রিকার একটি কার্টুন স্মৃতিতে জ্বলজ্বলে হয়ে আছে। 'ইন্ডিয়া ইজ টু হট' শিরোনামের ধারাবাহিক কার্টুনটিতে দেখানো হয়েছে, তিন প্রস্ত স্যুট পরিহিত সদ্যাগত ইংরেজ তার মালামাল কুলির মাথায় দিয়ে আগে আগে হাঁটছে। এরপর তীব্র গরমে অতিষ্ঠ হয়ে একে একে কুলির সাথে কাপড় বিনিময় করতে করতে একপর্যায়ে দেখা যায়, কুলির সব কাপড়চোপড় সাহেবের গায়ে। অন্যদিকে সাহেবের তিন প্রস্ত স্যুট চেপেছে কুলির শরীরে। কুলি এবার মাথার ঝোঝাটা নির্বিবাদে সাহেবের মাথায় তুলে দিয়ে আগে আগে হাঁটতে থাকে! দেশীয়দের বোঝা যদি এভাবে সত্যিই ইংরেজের মাথায় চাপিয়ে দেওয়া যেত, কত না ভালো হতো। সেই ছোট আমিও এমনটাই ভেবেছিলাম। বলেছিলাম আব্বাকেও!