আর্থিক অনটন ও খেলোয়াড় বিক্রির ওপর নির্ভরশীলতা: নতুন বাস্তবতায় মাদ্রিদ
গ্রীষ্মকালীন দলবদলের শেষ দিন ছিল গত মঙ্গলবার (৩১শে আগস্ট)। স্প্যানিশ টিভি এল চিরিঙ্গিতোর স্টুডিওতে এদিনে ছিল পুরোদস্তুর উৎসবের আমেজ। কিলিয়ান এমবাপ্পে রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দিচ্ছে, এ ব্যাপারে যেন নিশ্চিত ছিল এই টিভি স্টুডিও'র সবাই।
স্টুডিওতে এমবাপ্পের ছবি বসানো একটি বড় ঘড়ি বসিয়েছিল এল চিরিঙ্গিতো। এই ফরাসি স্ট্রাইকারের দলবদলের খবর নিশ্চিত হওয়ামাত্র থেমে যাবে ঘড়ি, হয়তো সেটাই ছিল পরিকল্পনা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেদিন আর থামা হয়নি ঘড়িটির।
এর আগে, মার্চ মাসে স্প্যানিশ পত্রিকার মার্কা তার প্রথম পাতায় এমবাপ্পে এবং আর্লিং হলান্ডের ছবি ছাপিয়ে একরকম ঘোষণাই দিয়েছিল, 'দুই তারকা, এক নিয়তি'। এই গ্রীষ্মে রিয়ালের প্রাথমিক লক্ষ্য এই দুই তারকাকে দলে ভেড়ানো, সেটা জানাতেই এতো ঢাকঢোল পেটানো।
এক অর্থে সেই শিরোনাম সঠিকই ছিল। এমবাপ্পে বা হলান্ড, কারো নিয়তিই রিয়াল মাদ্রিদ হচ্ছে না এই মৌসুমে।
দম্ভ ও ক্ষমতায়, দলবদলের বাজারে রিয়ালের অধঃপতন একদিনে হয়নি। তাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনার দুর্দশার জন্য রিয়ালের এই অধঃপতন প্রায়শই চোখ এড়িয়ে যায়। শেষ দিনেও আন্তোয়ান গ্রিজমানের মতো তারকাকে ছেড়ে দিয়ে সেভিয়ার ব্যাকআপ স্ট্রাইকার লুক ডি ইয়ংকে দলে ভিড়িয়েছে কাতালান ক্লাবটি। আর এদিকে রিয়ালও পা রেখেছে তাদের নতুন বাস্তবতায়। সার্জিও রামোস, রাফায়েল ভারানে ও মার্টিন ওডেগার্ডের মতো তারকাকে ছেড়ে দিয়ে এই গ্রীষ্মে শুধু একজনকেই দলে ভেড়াতে পেরেছে তারা। ১৮ বছর বয়সী ফরাসি মিডফিল্ডার এডওয়ার্ডো কামাভিঙ্গার জন্য প্রায় ৪ কোটি ইউরো খরচ করেছে মাদ্রিদের ক্লাবটি।
রিয়ালের মতো ক্লাবের জন্য এরচেয়ে সাদামাটা দলবদল উইন্ডো হয়ই না। তবে পরিস্থিতি এরচেয়েও খারাপ হতে পারতো যদি এমবাপ্পের জন্য ফ্লোরেন্তিনা পেরেজের দাবি করা ২০ কোটি ইউরোর প্রস্তাবে সম্মতি দিয়ে দিতো পিএসজি। মাদ্রিদ সভাপতির মুখে আতঙ্কের ছাপ দেখতে চাইলে এ কাজ করতেই পারতো কাতার স্পোর্টস ইনভেস্টমেন্ট।
এ মাসের শেষে রিয়াল মাদ্রিদের বার্ষিক সাধারণ অধিবেশন হওয়ার কথা রয়েছে, যেখানে ক্লাবের সর্বমোট ঋণের পরিমাণ জানানো হবে। সূত্র অনুযায়ী, এই ঋণের পরিমাণ বর্তমানে ১০১ থেকে ১০২ কোটি ইউরোর মতো হওয়ার কথা। এরমধ্যে রয়েছে সান্তিয়াগো বার্নাব্যু পুনর্নির্মাণের জন্য নেওয়া ৭২ কোটি ইউরো ঋণ।
রিয়াল মাদ্রিদ নিঃসন্দেহে স্পেনের সবচেয়ে প্রতাপশালী ক্লাব। ম্যানচেস্টার সিটি ও পিএসজির মতো রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত ক্লাবগুলো সাথে এখন টাকার লড়াইয়ে পিছিয়ে যাওয়া মাদ্রিদের ইতিহাসও কিন্তু রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতারই ইতিহাস।
রিয়াল মাদ্রিদের 'রিয়াল' শব্দটির অর্থই রাজকীয়। রাজা ত্রয়োদশ আলফনসো থেকে শুরু করে স্বৈরাচারী ফ্রান্সিসকো ফ্র্যাংকো, গত শতাব্দীর প্রায় সব রাষ্ট্রপ্রধানই রিয়াল মাদ্রিদকে ব্যবহার করেছেন তাদের হাতিয়ার হিসেবে। এবং সেই ধারায় এখনো রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা পেয়ে যাচ্ছে ক্লাবটি।
রিয়ালের সর্বশেষ অর্থনৈতিক প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে যে কিংডম অব স্পেনের (স্পেনের আনুষ্ঠানিক নাম) কাছ থেকে ২০ কোটি ইউরো ঋণ নিয়েছে তারা। স্পেনের প্রধান ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউটো ডি ক্রেডিটো অফিসিয়াল (আইসিও) দ্বারা সমর্থিত এই ঋণ পরিশোধের সময়কাল সম্প্রতি দশ বছর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই ঋণের কারণেই এমবাপ্পের জন্য প্রস্তাব পাঠানোর সাহস করতে পেরেছিল মাদ্রিদ।
এরকম রাষ্ট্রীয় ঋণ স্প্যানিশ ব্যাংকগুলো থেকে নেওয়া রিয়ালের পূর্বের ঋণকে সংকুচিত করে দিয়েছে। যার মানে, সেসব বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে আরও ঋণ নিতে পারবে রিয়াল।
এর বাইরে, পূর্বের বেশ কিছু দলবদলের জন্য এখনো রিয়ালের কাছে ১৫ কোটি ইউরোর মতো পাওয়া আছে ইউরোপের বিভিন্ন ক্লাবের। বৈশ্বিক প্রাইভেট ইক্যুইটি ফান্ড প্রভিডেন্সেরও পাওনা আছে ৮ কোটি ইউরো।
করোনাকালীন অর্থনৈতিক মন্দা থেকে মুক্তির জন্য স্প্যানিশ ক্লাবগুলোকে আইসিও মোট ৩০ কোটি ইউরো ঋণ দিয়েছে। বড় ক্লাবগুলোর মধ্যে বার্সেলোনা পেয়েছে ৫.৫ কোটি, অ্যাতলেটিকো মাদ্রিদ ২ কোটি এবং সেভিয়া ১.৫ কোটি ইউরো। কিন্তু রিয়ালের পাওয়া ২০.৫ কোটি ইউরোর ধারেকাছেও পায়নি কেউ। পিএসজি রাষ্ট্রীয় অর্থে চলতে পারে, কিন্তু মন্দা নিরসন ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অনুকূলে আনতে রিয়াল যেরকম রাষ্ট্রীয় সহায়তা পাচ্ছে সেটিও নজিরবিহীন।
টটেনহাম হটস্পারের মতো আরও বেশ কিছু ইউরোপীয় ক্লাবও সরকারের জরুরী করোনাকালীন ঋণ থেকে উপকৃত হয়েছে। কিন্তু তাদের কেউই বিশ্বের সবচেয়ে দামী খেলোয়াড়দের একজনকে দলে ভেড়াতে এতো টাকা ঋণ নেয়নি। এই গ্রীষ্মে দল পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া পেরেজ দলবদল বাজার থেকে যেই একজনকে বাগিয়ে আনতে পেরেছেন, সেই কামাভিঙ্গার নাম রেজিস্টার করা হয়েছে রিয়ালের বি দল, কাস্তিয়ার অধীনে। কেননা রিয়ালের স্কোয়াড ইতোমধ্যেই পরিপূর্ণ ছিল।
মারিয়ানো ডায়াজ, গ্যারেথ বেল, ইসকো বা দানি সেবায়সের মতো খেলোয়াড়দের পেরেজ ছাটাই করতে চাইলেও দুর্ভাগ্যবশত তাদের কারোরই খদ্দের মেলেনি। যেখানে চেলসির মতো ক্লাব তাদের একাডেমির খেলোয়াড়দের বিক্রি করে কড়ি কড়ি টাকা উপার্জন করছে, এবং তরুণদের লোনে পাঠিয়ে মূল্যমান বাড়াচ্ছে, সেখানে রিয়ালের উচ্চ-বেতনধারী বয়স্কদের কাফেলা যে করোনাকালীন বাজারে খদ্দের পাবে না সেটা অনুমিতই ছিল। শেষ পর্যন্ত এই গ্রীষ্মে এমবাপ্পেকে দলে ভেড়ানোর জন্য স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যমগুলোকে ব্যবহার করা ছাড়া বড় কোন কৌশলই হাতে নেননি পেরেজ। ন্যু ক্যাম্পে চলমান সংকটের পাশাপাশি এই এমবাপ্পে প্রচারণা হয়তো একটি পরিকল্পিত বিক্ষেপই ছিল।
ইউরোপিয়ান সুপার লিগের পতনের পর ক্লাবকে অর্থনৈতিকভাবে উদ্ধার করার জন্য আর কোনো পরিকল্পনাই হাতে নেননি পেরেজ এবং তার প্রতিপক্ষ, বার্সেলোনা সভাপতি হুয়ান লাপোর্তা। এবার বার্সেলোনা তাদের সবচেয়ে মূল্যবান খেলোয়াড়কে হারিয়েছে বিনামূল্যে। এবং ক্লাবের অন্যান্য তারকারা বেতন কমানোর পরই কেবল মৌসুম শুরু করতে পেরেছে রোনাল্ড কুমানের দল। ওদিকে মাদ্রিদ তাদের অধিনায়ককে হারিয়েছে বিনামূল্যে, এবং তাদের প্রাথমিক টার্গেটকেই দলে ভেড়াতে পারেনি।
বছরের পর বছর ধরে করা বাড়তি ব্যয় এবং বিভিন্ন জায়গা থেকে নেওয়া পাহাড়সম ঋণ অবশেষে ঘিরে ধরতে শুরু করেছে এই দুই স্প্যানিশ পরাশক্তিকে।
করোনাকালীন প্রণোদনা তহবিল করতে লা লিগা ইক্যুইটি কোম্পানি সিভিসির কাছে ভবিষ্যৎ সম্প্রচার সত্ত্ব বিক্রি করে অর্থ সহায়তা নেওয়ার পরিকল্পনা করলেও তাতে সায় দেয়নি রিয়াল। নিজেদের সম্প্রচার সত্ত্ব নিজ দায়িত্বে বিক্রি করতে চায় মাদ্রিদের ক্লাবটি।
সর্বশেষ অর্থনৈতিক প্রতিবেদনে রিয়াল ৩ লাখ ইউরো লাভ করেছে বলে দাবি করেছে। তবে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে বাৎসরিক অধিবেশনে আর্থিক পরিস্থিতির পূর্ণ প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে লাভ-ক্ষতি আসল পরিমাণটা এমনিতেই জানা যাবে। বার্সেলোনার মতো মোট লোকসানের পরিমাণ ৪৯ কোটি ইউরো হওয়ার সম্ভাবনা হয়তো নেই। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বীদের দুরবস্থা দেখে এতো খুশি হওয়ারও সুযোগ নেই পেরেজ বাহিনীর।
বাস্তবতা হচ্ছে, একসময় যাকে খুশি তাকে কিনতে পারা রিয়াল মাদ্রিদ এখন যাকে খুশি তাকে বিক্রি করার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
- সূত্র: দ্য টেলিগ্রাফ