ইয়াসিন বুনু: বিশ্বকাপের সদা হাস্যময় এক নায়ক
প্রথম আফ্রিকান, প্রথম আরব দেশ হিসেবে বিশ্বকাপ ফুটবলের সেমিফাইনালে উঠে গেছে মরক্কো।
ফুটবল-পণ্ডিতরা একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছেন: আটলাসের সিংহরা এত দূর আসতে পেরেছে তাদের লৌহকঠিন রক্ষণের কারণে। গোটা টুর্নামেন্টে মাত্র একটি গোল হজম করেছে দলটি—কানাডার বিপক্ষে—সেটিও আবার আত্মঘাতী।
৪-১-৪-১ ফরম্যাটের জমাট রক্ষণভাগের ফাঁকফোকর গলে বল নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া প্রতিপক্ষের জন্য এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি।
তবে প্রতিপক্ষের জন্য মরক্কোর রক্ষণের চেয়েও বড় হতাশা হয়ে আবির্ভূত হয়েছেন দলটির গোলরক্ষক ইয়াসিন বুনু। যতবার দলের প্রয়োজন পড়েছে, মহাপ্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে গেছেন তিনি।
শেষ ষোলোয় স্পেনের বিপক্ষে স্নায়ুক্ষয়ী পেনাল্টি শুটআউটের কথাই ধরুন। সেখানে দেখা গেছে, সার্জিও বাসকোয়েট স্পেনের তৃতীয় পেনাল্টি কিক নেওয়ার আগে রীতিমতো দাঁত বের করে হাসছেন বুনু। তারপরই তিনি ওই পেনাল্টি কিক ঠেকিয়ে দেন।
গোটা টুর্নামেন্টেই বুনু এরকম হাসতে হাসতে গোলপোস্ট সামলেছেন। একের পর এক ঠেকিয়ে গেছেন কঠিন সব বল। এই হাসিই তার ভালো পারফরম্যান্সের টোটকা।
বুনুর সাবেক গোলকিপিং কোচ ক্রিস্টোফিন রেভেল রেডিও ফ্রান্স ইন্টারন্যাশনালকে বলেছেন, 'ও [বুনু] যদি না হাসে, তাহলে বুঝবেন কোনো সমস্যা আছে।'
বেশিরভাগ সাক্ষাৎকার বুনু দেন পায়ের ওপর পা তুলে বসে। প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর দেন বেশ সময় নিয়ে, ভেবেচিন্তে।
ফুটবলার না হলে অনায়াসেই তিনি প্রাজ্ঞ শিক্ষক হিসেবে ক্যারিয়ার গড়তে পারতেন।
বুনুর জন্ম কানাডার মন্ট্রিলে। তার বয়স যখন তিন, তখন তার পরিবার মরক্কোর ক্যাসাব্লাঙ্কায় ফিরে যায়। সেখানে মোটামুটি আরাম-আয়েশে মধ্যবিত্ত আবহে বেড়ে ওঠেন তিনি। পড়াশোনা করেন মরক্কোর অন্যতম সেরা একটি ফ্রেঞ্চ সেকেন্ডারি স্কুলে।
তবে বুনুর এই সবকিছুকে সহজভাবে নেওয়ার ভঙ্গিটা ঔদ্ধত্য থেকে আসে না। বরঞ্চ ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই বিপুল চাপের মধ্যে থাকার কারণেই তার মধ্যে এই ধীর-স্থির ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠেছে।
আট বছর বয়সে ওয়াইদাদ অ্যাথলেটিক ক্লাবে যোগ দেন বুনু। এরপর অচিরেই মরক্কোর সবচেয়ে সফল ফুটবল ক্লাবটির র্যাঙ্ক তরতর করে বেড়ে যায়। বুনুর অভিষেক হয় ২০১১ সালে, আফ্রিকান চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালের দ্বিতীয় লেগে। তিউনিসিয়ান জায়ান্ট এসপারেন্স স্পোর্টিভ ডি তিউনিসের বিপক্ষে।
বিশ্বকাপের আগে মরোক্কান টিভি চ্যানেল এমটুয়েন্টিফোরটিভিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বুনু বলেন, 'আমার প্রথম ম্যাচটা কঠিন ছিল। মনে হয়েছিল খেলায় খারাপ করলে আমার ক্যারিয়ার একদিকে যাবে, আর ভালো করলে আরেকদিকে যাবে।'
ওই ম্যাচে বুনু বেশ কয়েকটি সেভ করেন। কিন্তু ঘানার ফুলব্যাক হ্যারিসন আফালের অসাধারণ গোলে শেষতক হারতে হয়। ওই রাতে বুনুর পারফরম্যান্স নজর কাড়ে অ্যাটলেটিকো ডি মাদ্রিদের স্কাউটদের। তারা তাকে লস কোলচোনারোসের হয়ে খেলার জন্য চুক্তি করার প্রস্তাব দেয়।
ওয়াইদাদে বুনু যে বেতন পেতেন, তার চেয়ে কম বেতনের প্রস্তাব দেয় মাদ্রিদের ক্লাবটি। সেইসঙ্গে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, বুনুকে খেলতে হবে তৃতীয় গোলরক্ষক হিসেবে। থিবো কোর্টিস ও জাঁ ওবলাক খেলতে না পারলেই কেবল সুযোগ পাবেন তিনি।
উচ্চাকাঙ্ক্ষী বুনু সেই প্রস্তাবই লুফে নেন।
অ্যাটলেটিকোতে যোগ দেওয়ার পর বুনু ধারে খেলতে যান দ্বিতীয় বিভাগের ক্লাব রিয়াল জারাগোজায়। সেখান থেকে জিরোনা এফসি-তে। দ্বিতীয় বিভাগে এই হাড়ভাঙা শ্রমের সুবাদে জিরোনা লা লিগায় খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। সেই সাফল্যের সুবাদে বুনু সুযোগ পেয়ে যান স্পেনের সবচেয়ে বড় ক্লাবগুলোর একটি সেভিয়া এফসি-তে। সেই থেকেই বিশ্বমানের গোলরক্ষক হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করে যাচ্ছেন ইয়াসিন বুনু।
২০২১-২২ লা লিগা মৌসুমে বুনুর সেভের হার ছিল প্রায় ৭৮ শতাংশ, যা ইউরোপে ষষ্ঠ সেরা।
রেভেল বলেন, 'ও শীর্ষ গোলরক্ষক। ওয়ান-অন-ওয়ানে ও দারুণ দক্ষ। ...বাতাসে বলকে দারুণ পড়তে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, ওর মাথা ঠান্ডা। বেলজিয়াম বা ইংল্যান্ড দলের গোলরক্ষক হলে ও বড় তারকা হয়ে যেতে।'
নেতা হিসেবেও বুনু দারুণ। সেভিয়ায় তিনি আরও দুই মরোক্কান ফুটবলারের 'বড় ভাইয়ের' ভূমিকা পালন করেন—ইউসেফ আন-নাসেরি ও মুনির আল হাদ্দাদি।
আন-নাসেরির সঙ্গে বুনুর সম্পর্ক বেশি ঘনিষ্ঠ। বিশ্বকাপে পর্তুগালের বিপক্ষে জিতে প্লেয়ার-অভ-দ্য-ম্যাচ পুরস্কার পাওয়ার পরপরই পুরস্কারটি তিনি আন-নাসেরিকে উৎসর্গ করেন।
বড় তারকা হিসেবে বুনু প্রমাণ করেছেন, সতর্কতার সঙ্গে ভাবমূর্তি রক্ষার প্রয়োজনীয়তা তিনি ভালোই বোঝেন।
এমটুয়েন্টিফোরটিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, 'ভালো খেলা আমাদের দায়িত্ব। তবে আমাদের সচেতন থাকা উচিত যে, দেশের বাইরে আমরা মরক্কোর প্রতিনিধিত্ব করি। ...মরক্কোর যেসব বাচ্চা আমাদের পথ ধরে হাঁটতে চায়, তাদের জন্য আমাদের ভালো উদাহরণ তৈরি করতে হবে।'
সব শ্রেণির মরোক্কানরা এখন ২০২২ বিশ্বকাপে পরপর দুটি মরোক্কান রূপকথার স্বাদ উপভোগ করছে তারিয়ে তারিয়ে। তাদের এই আনন্দের পেছনে বড় অবদান বুনুর।
ম্যাচ-পরবর্তী এক সংবাদ সম্মেলনে মরক্কোর কোচ ওয়ালিদ রেগরাগুই-ও এই পর্যবেক্ষণই তুলে ধরেছেন।
তিনি বলেন, 'আপনি যখন জানেন গোলপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে আছে বুনু, সেটি সবসময়ই আত্মবিশ্বাস জোগায়। ...ও পৃথিবীর সেরা গোলরক্ষকদের একজন।'
সেমিফাইনালেও মরক্কো খুব সম্ভব আগের কৌশলেই খেলবে। এরপরও বর্তমান চ্যাম্পিয়নরা রেগরাগুইয়ের রক্ষণভাগ চিড়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারে, তাদের সামনে পড়বে এক দুর্লঙ্ঘ্য বাধা—তার নাম ইয়াসিন বুনু। সেই বাধা পেরোতে পারলেই কেবল গোলের দেখা পাবে তারা।
- সূত্র: আল জাজিরা