ফুটবল বিশ্বে ২০ বছর ধরে মেসিই সেরা: বিশ্বকাপজয়ী আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি হোর্হে বুরুচাগা
১৯৮৬ মেক্সিকো ফুটবল বিশ্বকাপ ছিল আর্জেন্টিনার ফুটবল ইতিহাসে চিরস্মরণীয় আসর। এ আসরের চরম প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ফাইনালে পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে জয়সূচক শেষ গোলটি করেন আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড হোর্হে বুরুচাগা। তার এ গোলের ফলেই ৩-২ ব্যবধানে পশ্চিম জার্মানিকে হারিয়ে ঐ আসরের বিশ্বকাপ নিজেদের করে নেয় আর্জেন্টিনা।
সেই ইতিহাস পুরনো হয়েছে, কিন্তু আজও আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ শিরোপা পুনরায় অর্জন করতে পারেনি। ২০১৪ সালে ফাইনালে জার্মানির কাছে হোঁচট খাওয়ার পর চলতি কাতার বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা আবারও শিরোপা থেকে মাত্র ৯০ মিনিট দূরে। কাতার বিশ্বকাপের শুরু থেকে ফাইনাল পর্যন্ত দলের সবচেয়ে বড় তারকা মেসির যে পারফরম্যন্স, তাতে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপজয়ী ফরোয়ার্ড বুরুচাগা খুব করেই চান মেসির নেতৃত্বে আর্জেন্টিনার ৩৬ বছরের বিশ্বকাপ শিরোপা খরা কাটাক। সম্প্রতি ফ্রান্সের বিপক্ষে আর্জেন্টিনার ফাইনালের আগে বুয়েন্স আয়ার্স টাইমসে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বুরুচাগা কথা বলেছেন কাতার নিজের ফুটবল ক্যারিয়ার ও চলতি বিশ্বকাপ নিয়ে। একইসাথে মেসি ও আর্জেন্টিনা নিয়েও দিয়েছেন নিজের ব্যক্তিগত মতামত।
প্রশ্ন: ২০২২ কাতার বিশ্বকাপের মেসিকে কি ১৯৮৬ মেক্সিকো বিশ্বকাপের ম্যারাডোনার সাথে তুলনা করা যায়?
হোর্হে বুরুচাগা: অবশ্যই, কোনো সন্দেহ ছাড়াই। আমাদের তৎকালীন কোচ কার্লোস বিলার্দো যে আট বছর সময় আমাদের সাথে ছিলেন তখন তিনি বলতেন যে, "আর্জেন্টিনা ফুটবল দল একজন ম্যারাডোনা ও বাকি ১০ জন খেলোয়াড় নিয়ে গঠিত।" বর্তমান আর্জেন্টিনার জাতীয় দলটিও তেমনি; এই দলে একজন মেসি এবং বাকি ১০ জন খেলোয়াড় আছে।
মেসি গত ২০ বছর ধরে বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়। সে তার দল ও বয়সের তুলনায় খুবই ভিন্নধর্মী খেলা খেলছে। একইসাথে তিনি দুর্দান্ত ছন্দে রয়েছে। ব্রাজিলের ২০২১ সালে কোপা আমেরিকার সময় আমরা দেখেছি যে, তিনি নিজের কাঁধে পুরো দলের দায়িত্ব তুলে নিয়েছিলেন এবং কাতার বিশ্বকাপেও আমরা মেসিকে ভিন্ন মাত্রায় দেখতে পারছি।
প্রশ্ন: কাতার বিশ্বকাপ ফাইনালে আর্জেন্টিনা না জিতলে ফুটবল ইতিহাসে মেসির মর্যাদার কি কোনো পরিবর্তন ঘটবে?
হোর্হে বুরুচাগা: এটা কোনো প্রশ্নই হতে পারে না। মেসি হয়তো ম্যারাডোনা থেকে কম বা বেশি কিছু হতে যাচ্ছে; কিংবা ভিন্নরকম কেউ। সে বিশ্বকাপ জিতল কি হারল সেটা বড় বিষয় হবে না।
মেসি অবশ্যই ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। গত ৭০ বছরের ফুটবল ইতিহাসে স্তেফানো, ইয়োহান ক্রুইফ, পেলে, ম্যারাডোনা এবং মেসিই সেরা প্লেয়ার। এই পাঁচ জনের চারজনই ল্যাটিন আমেরিকার। মেসি এই বাকি কিংবদন্তির সাথেই আলোচিত হবে। এবার তিনি বিশ্বকাপ জিতুক কিংবা নাই জিতুক।
আমি চাই মেসি বিশ্বকাপ জিতুক। একজন আর্জেন্টাইন হিসেবে আমরা সকলেই বিশ্বকাপ জিততে চাই প্রধানত মেসির জন্য। কেননা পূর্বে মেসিকে নানারকম সমালোচনায় মুখোমুখি হতে হয়েছে যেটা তার জন্য শোভা পায় না। তিনি ৩৫ বছর বয়সী হয়েও ২০ বছরের খেলোয়াড়ের মতো খেলে যাচ্ছে।
প্রশ্ন: চলতি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে আর্জেন্টিনার জয়কে আপনি কীভাবে দেখছেন?
হোর্হে বুরুচাগা: প্রথম ২৫ মিনিট ক্রোয়েশিয়া ম্যাচে ডোমিনেট করেছে। ঐ ২৫ মিনিট বাদ দিলে আর্জেন্টিনার জন্য ম্যাচটি দুর্দান্ত ছিল। প্রথমার্ধে আর্জেন্টিনার দুটি গোলই ঐ ম্যাচের ভাগ্য ঠিক করে দিয়েছিল। দ্বিতীয়ার্ধে পুরোটাই আর্জেন্টিনা একপাক্ষিক প্রভাব বিস্তার করেছে যেখানে মেসি ও আর্জেন্টিনার সেরা খেলাটা আমরা দেখতে পেয়েছি। যখন জয়ের সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল, তখনই আর্জেন্টিনা তাদের সেরা খেলাটা খেলতে পেরছে। এখন তারা শিরোপা থেকে মাত্র এক ম্যাচ দূরে।
প্রশ্ন: ১৯৮৬ মেক্সিকো বিশ্বকাপের ফাইনালের গোলটি নিয়ে আপনি কেমন অনুভব করেন?
হোর্হে বুরুচাগা: গোলটি আমার জীবনের সবচেয়ে খুশির মুহূর্ত। কিন্তু সত্যিকার অর্থে বর্তমানে গণমাধ্যম সমসাময়িক ইভেন্টগুলো যেভাবে ফোকাস করে আমাদের সময় তেমনটা ছিল না। এখন সকল ঘটনাই অনেক বৃহৎ আকারে; অনেক দ্রুত ছড়িয়ে যায়।
কিন্তু এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, গোলটি আমার মনে চিরদিনের জন্য জায়গা করে নিয়েছে। আমি এখনো প্রতিটি বিশ্বকাপের আগে আমার সেই সুন্দর মুহূর্তটি মনে করি। গোলটি করার প্রায় ৩৬ বছর হয়ে গেছে যেটা আমার জীবনের প্রায় অর্ধেক সময়। জীবনে অল্প কিছু মানুষই এমন বড় অর্জন করতে পারে যেটা করতে পারায় আমি খুবই খুশি।
প্রশ্ন: ১৯৮৬ বিশ্বকাপে মেক্সিকো থেকে শিরোপা জিতে আর্জেন্টিনায় প্রত্যাবর্তনের অনুভূতিটা কেমন ছিল?
হোর্হে বুরুচাগা: আমাদের কোচ বিলার্দো বিশ্বকাপ শেষে দেশে ফিরতে আমাদের অনুপ্রাণিত করেছিল। দেশের ফেরার অনুভূতিটা আমাদের জন্য দুর্দান্ত ছিল। কেননা দেশে ফেরার পর আমরা সব মহলের পক্ষ থেকে উষ্ণ অভ্যর্থনা পাচ্ছিলাম। যুবক থেকে শুরু করে বৃদ্ধ পর্যন্ত সকলের চোখেমুখে আমরা যে আনন্দ দেখছি এরচেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কিছু হতে পারেনা। আর্জেন্টিনায় ফুটবল আমাদের সকলের দুঃখ দুর্দশা ভুলিয়ে দেয়। আর তাই বিশ্বকাপ চলাকালীন সময়টা খুবই ভিন্নরকম যেটা আমরা বর্তমানে প্রত্যক্ষ করছি।
প্রশ্ন: চলমান কাতার ফুটবল বিশ্বকাপকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
হোর্হে বুরুচাগা: এখন পর্যন্ত আমি কাতার বিশ্বকাপকে খুব বেশি উপভোগ করতে পারিনি। ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের মধ্যকার কোয়ার্টার ফাইনালের ম্যাচটি ছাড়া খুব বেশি ভালো খেলা খেলতে দেখিনি। ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের খেলাটাই সবচেয়ে বেশি উপভোগ্য ছিল। খেলাটি এক্সটা টাইমে যাওয়া উচিত ছিল। যদি কেইন শেষ পেনাল্টিতে গোলটা করতে পারতেন তবে হয়তো তাই হতো।
আসরের অন্য ম্যাচগুলো অনেকটা সাদামাটা ছিল। খেলোয়াড়রা একক নৈপুণ্য দেখাতে পারেননি। নেইমার ইনজুরিতে ছিলেন, রোনালদোও খেলতে পারেননি। ফেভারিট হয়েও জার্মানি এক ম্যাচ হেরে গিয়েছে। আমি মনে করিনা যে, কাতার বিশ্বকাপটা খুব ভালো ছিল।
সূত্র: বুয়েন্স আয়ার্স টাইমস