পেলে-ম্যারাডোনা থেকে জিদান-রোনালদো, যাদের পাশে মেসি ও এমবাপ্পে
নিজেদের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলতে নামবেন লিওনেল মেসি এবং কিলিয়ান এমবাপ্পে। ২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে জার্মানির কাছে হেরে স্বপ্নভঙ হয়েছিল মেসির, এবার সেটি পূরণ করতে চাইবেন তিনি। অপরদিকে ২০১৮ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়া এমবাপ্পের লক্ষ্য নিজের নাম ইতিহাসে আরো গভীরভাবে খোদাই করে নেওয়া।
এই দুইজনের আগেও একাধিক বিশকাপের ফাইনাল খেলা খেলোয়াড়ের সংখ্যা নেহায়েতই কম নয়। তবে তাদের সবার গল্পটা এক নয়। একাধিক ফাইনাল খেলে সব জেতার রেকর্ড যেমন আছে, তেমনই আনন্দ- দুঃখের ইতিহাসও আছে, আবার বারবার যন্ত্রণায় পোড়ার করুণ গল্পও আছে।
তেমনই পাঁচজন কিংবদন্তিকে নিয়ে এই আয়োজন, যারা খেলেছেন একাধিক বিশ্বকাপ ফাইনাল, সেখানে তাদের অর্জন এবং ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স কেমন ছিল তা জেনে নেওয়া যাক।
পেলে (১৯৫৮ এবং ১৯৭০ বিশ্বকাপ ফাইনাল)
ফুটবলের রাজা হিসেবে আখ্যায়িত পেলে জিতেছেন ৩টি বিশ্বকাপ। কিন্তু এই ৩ বিশ্বকাপের মধ্যে তিনি ফাইনাল খেলেছেন আদতে দুটির। ১৯৬২ বিশ্বকাপে মাত্র একটি ম্যাচ খেলেই চোটে আক্রান্ত হন পেলে। এরপর আর খেলতে পারেননি তিনি। তাই ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ন হলেও সেবারের টুর্নামেন্টে ভূমিকা ছিল না পেলের।
কিন্তু ১৯৫৮ এবং ১৯৭০ বিশ্বকাপে জয়ের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা ছিল তার। ১৯৫৮ বিশ্বকাপের ফাইনালে সুইডেনকে ৫-২ গোলের ব্যবধানে হারিয়ে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয় ব্রাজিল। সেই ফাইনালে ১৭ বছর বয়সী পেলে করেছিলেন জোড়া গোল।
১৯৭০ বিশ্বকাপের ফাইনালে ব্রাজিলের প্রথম গোলটি করেন পেলে। ইতালিকে ৪-১ গোলের ব্যবধানে হারিয়ে তৃতীয়বারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয় ব্রাজিল। সেলেকাওদের সেই দলকে অনেকেই সর্বকালের সেরা আন্তর্জাতিক দল হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন।
ডিয়েগো ম্যারাডোনা (১৯৮৬ এবং ১৯৯০ বিশ্বকাপ ফাইনাল)
বিশ্বকাপ নিয়ে যেকোনো আলোচনায় ম্যারাডোনার থাকাটা যেন সম্ভাব্যই। দুটি বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলে জয়ের হাসিও হেসেছেন তিনি, কেঁদেছেন কষ্টের কান্নাও।
১৯৮৬ বিশ্বকাপকে ইতিহাস মনে রেখেছে ম্যারাডোনার বিশ্বকাপ হিসেবে। অনেকটা একা হাতেই আর্জেন্টিনাকে চ্যাম্পিয়ন করেন তিনি। ফাইনালে ২-২ সমতা থাকা অবস্থায় হোর্হে বুরুচাগাকে গোল করতে সহায়তা করেন ম্যারাডোনা। সেই গোলেই পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে ৩-২ ব্যবধানে জিতে দ্বিতীয়বারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয় আর্জেন্টিনা।
১৯৯০ বিশ্বকাপ ফাইনালটা আগেরবারের মতো যায়নি ম্যারাডোনার। প্রতিপক্ষ ছিল সেই একই, পশ্চিম জার্মানি। কিন্তু এবার শেষ মুহূর্তের পেনাল্টি গোলে হেরে টানা দ্বিতীয়বার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন ভেঙে যায় ম্যারাডোনার। এরপর আরও ২৪ বছর বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠতে পারেনি আর্জেন্টিনা।
জিনেদিন জিদান (১৯৯৮ এবং ২০০৬ বিশ্বকাপ)
একাধিক বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলা কিংবদন্তিদের মধ্যে জিদানের খেলা ফাইনালগুলোই সবচেয়ে ঘটনাবহুল। দুই ফাইনালে নানা ধরণের আবেগের স্পর্শ তো পেয়েছেনই, ঘটিয়েছেন এমন কান্ড যা অমর হয়ে থাকবে বিশ্বকাপের ইতিহাসে।
১৯৯৮ বিশ্বকাপের ফাইনালে দুর্দান্ত ব্রাজিলকে ৩-০ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় ফ্রান্স। এটিই ছিল লে ব্লুজদের প্রথম বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বাদ পাওয়া। দুই গোল করে ব্রাজিলের হার একাই নিশ্চিত করেন নিজের ফর্মের তুঙ্গে থাকা জিদান।
২০০৬ বিশ্বকাপ ফাইনালে যা করেছেন সেটি নিয়ে আলোচনা হবে যুগের পর যুগ। ইতালির বিপক্ষে ফ্রান্সকে পেনাল্টি থেকে গোল করে এগিয়ে দিয়েছিলেন। পেলে এবং পল ব্রেইটনারের পর দুই বিশ্বকাপ ফাইনালে গোল করা একমাত্র খেলোয়াড়ও তিনি। এরপর ম্যাচের অতিরিক্ত সময়ে যা করলেন সেটির জন্যই তাকে বেশি মনে রাখা হবে। ইতালির মার্কো মাতেরাজ্জিকে ঢুস মেরে দেখলেন লাল কার্ড।
নিজের ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপ এবং আন্তর্জাতিক ম্যাচে লাল কার্ড দেখে বেরিয়ে যেতে হয় তাকে। ফ্রান্সও শেষ পর্যন্ত টাইব্রেকারে ইতালির কাছে হেরে রানার্স-আপ হয়।
রোনালদো নাজারিও (১৯৯৮ এবং ২০০২ বিশ্বকাপ ফাইনাল)
বলা হয়ে থাকে, চোটাক্রান্ত না হলে সর্বকালের সেরার প্রশ্নে তার ধারে-কাছে আসতেন না অন্যকেউ। চোটাক্রান্ত ক্যারিয়ারেই করেছেন ৪১৪ গোল। সুস্থ থাকলে কী করতেন সেই প্রশ্নে না যাওয়াই ভালো।
১৯৯৮ বিশ্বকাপের ফাইনালে তিনি ছিলেন বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়। ফাইনালের আগে নাকি পেট খারাপ হয়েছিল তার। জিনেদিন জিদানের জোড়া গোলের কাছে হার মানতে হয় রোনালদোকে। সেদিনই হয়তো পণ করেছিলেন, পরের বিশ্বকাপে পুষিয়ে দিবেন।
হয়েছিলোও তাই, জাপান-কোরিয়াতে হওয়া ২০০২ বিশ্বকাপের ফাইনালে তার দেওয়া দুই গোলেই জার্মানিকে ২-০ গোলে হারিয়ে পঞ্চমবারের মতো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয় ব্রাজিল। রোনালদোও পূরণ করেন তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন।
১৯৯৪ বিশ্বকাপের ফাইনালেও কিন্তু ছিলেন 'এল ফেনোমেনো', যদিও তাকে নামানো হয়নি। ইতালিকে টাইব্রেকারে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ব্রাজিল। তাই এক হিসেবে এই তালিকায় থাকা বাকি খেলোয়াড়দের থেকে আলাদা রোনালদো। টানা তিনটি বিশ্বকাপ ফাইনালের অংশ ছিলেন ব্রাজিলিয়ান তারকা।
কাফু (১৯৯৪, ১৯৯৮ এবং ২০০২ বিশ্বকাপ ফাইনাল)
রোনালদোর মতো শুধু টানা তিনটি বিশ্বকাপের ফাইনালের অংশই ছিলেন না, প্রত্যেকটিতেই খেলেছেন কাফু। সর্বকালের সেরা রাইট-ব্যাক হিসেবে তাকে গণ্য করেন অনেকেই। সেই কাফু ১৯৯৪ এবং ২০০২ বিশ্বকাপ জেতেন ব্রাজিলের হয়ে। মধ্যে ১৯৯৮ বিশ্বকাপের ফাইনালে হারেন ফ্রান্সের কাছে।
২০০২ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের অধিনায়কও ছিলেন কাফু। তিন বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলা কাফুর কাছে দুঃখের চেয়ে তাই আনন্দের পাল্লাই বেশি ভারী।