এশিয়া-আফ্রিকা ফাইনাল স্বপ্ন কতদূর?
ফুটবল বিশ্বকাপ মানেই সেখানে লাতিন আমেরিকা অথবা ইউরোপের কোনো দলের রাজত্ব। 'গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ'- এর দীর্ঘ ৯২ বছরের ইতিহাসে এই দুই অঞ্চলের বাইরের কোনো দল কখনই শিরোপা জিততে পারেনি। আফ্রিকা বা এশিয়া অঞ্চলের দলগুলো সম্ভাবনা জাগালেও বেশি পথ পাড়ি দিতে পারেনি। কখনও ফাইনালেও খেলতে পারেনি এই দুই অঞ্চলের কোনো দেশ।
ঘুরেফিরে বারবার লাতিন আমেরিকা অথবা ইউরোপেই গেছে বিশ্বকাপের শিরোপা। লাতিন আমেরিকার তিন দেশ ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ও উরুগুয়ে মিলেই ৯ বার বিশ্বকাপ শিরোপা ঘরে তুলেছে। ব্রাজিল ৫ বার এবং আর্জেন্টিনা ও উরুগুয়ে ২ বার করে শিরোপা উঁচিয়ে ধরেছে। বাকি সব শিরোপা গেছে কোনো না কোনো ইউরোপের দেশের ঝুলিতে। জার্মানি ও ইতালি জিতেছে ৪টি করে বিশ্বকাপ। ২টি বিশ্বকাপ জিতেছে ফ্রান্স। এ ছাড়া একবার করে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট জিতেছে ইংল্যান্ড ও স্পেন।
কাতার বিশ্বকাপেও শিরোপার দাবিদার হিসেবে যে কয় দলকে বিবেচনা করা হচ্ছে, প্রতিটি দলই লাতিন অথবা ইউরোপের। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ফ্রান্স বা স্পেন; সবগুলো দলই এই দুই অঞ্চলের। এশিয়া বা আফ্রিকার কোনো দেশই নেই গোনার তালিকায়। এই দুই অঞ্চলের কোনো দেশ যে কখনও সেমি-ফাইনালের গন্ডিই পেরোতে পারেনি। এশিয়ার সর্বোচ্চ সাফল্য শেষ চারে খেলা, ২০০২ সালে ঘরের মাঠে সেমি-ফাইনাল খেলে দক্ষিণ কোরিয়া। আফ্রিকার কোনো দেশ অবশ্য এখনও শেষ চারেও খেলতে পারেনি।
তবে এবার যেভাবে অভ্যুত্থান হয়েছে, অনেকেই নতুন করে আশা দেখছেন। বাড়াবাড়ি জেনেও কল্পনায় ছবি আঁকছেন এশিয়া বনাম আফ্রিকা ফাইনালের। মধ্যপ্রাচ্যে আয়োজিত বিশ্বকাপে এশিয়ার কয়েকটি দল অভাবনীয় পারফরম্যান্স করেছে। আফ্রিকান দেশগুলোও দেখিয়েছে তাদের দম। এশিয়ার দেশ জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সৌদি আরব, ইরান তাদের উন্নতির ছাপ রেখেছে মাঠে। আবার আফ্রিকা অঞ্চলের দেশ মরক্কো, সেনেগাল, ঘানা, তিউনিশিয়া, ক্যামেরুন দেখিয়েছে তাদের সামর্থ্য।
এর মধ্যে চারটি দেশের নাম আলাদা করে বলতে হবে। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মরক্কো ও সেনেগাল। এই চার দেশই শেষ ষোলোয় উঠেছে। দুই অঞ্চল থেকে দুটি করে দেশ প্রতিনিধিত্ব করবে শেষ আঠে ওঠার লড়াইয়ে। এর মধ্যে এশিয়ার দেশ রীতিমতো বিস্ময় গাজানিয়া পারফরম্যান্স করেছে। গ্রুপ সেরা হয়ে উঠেছে শেষ ষোলোয় উঠেছে তারা। সেটাও স্পেন ও জার্মানির মতো পরাশক্তির গ্রুপে থেকে। এই দুই দলকে হারিয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠেছে ব্লু সামুরাইরা। শেষ ষোলোয় তাদের প্রতিপক্ষ বর্তমান রানার্স-আপ ক্রোয়েশিয়া।
ড্রয়ে শুরু করা দক্ষিণ কোরিয়াও শেষ ম্যাচে বিস্ময় নিয়ে হাজির হয়। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর দেশ পর্তুগালকে হারিয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডের টিকেট কাটে তারা। সেরা আটে ওঠার লড়াইয়ে তাদের প্রতিপক্ষ শক্তিশালী ব্রাজিল। আফ্রিকা-আরব অঞ্চলের দেশ মরক্কোর পথচলা আরও দাপুটে। দেশটি গ্রুপ পর্বে কোনো ম্যাচ হারেনি। ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ড্র করা মরক্কো পরে বেলজিয়াম ও কানাডাকে হারিয়ে ওঠের পরের রাউন্ডে। দ্বিতীয় রাউন্ডে তাদের প্রতিপক্ষ স্পেন।
আফ্রিকার দ্বিতীয় দেশ হিসেবে শেষ ষোলোয় ওঠা সেনেগালও দাপুটে পারফরম্যান্স করেছে। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে হারলেও ইকুয়েডর ও কাতারকে পরের রাউন্ডে ওঠে তারা। শেষ ষোলোয় তাদের প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড। আজ রাতেই ইংলিশদের মুখোমুখি হবে সেনেগাল। এই চার দল ছাড়া সৌদি আরবের আর্জেন্টিনাকে হারানো, ইরানের ওয়েলসকে হারানো, ক্যামেরুনের ব্রাজিলকে হারানো কাতার বিশ্বকাপে উল্লেখ করার মতো ঘটনা।
দুই অঞ্চলের চারটি দেশ শেষ ষোলোয় উঠেছে, আরও কয়েকটি দল প্রতিশ্রুতিশীল ফুটবল খেলেছে। এই দুই অঞ্চলের ফুটবলের অভাবনীয় উন্নতির কারণেই আশার বেলুন ফুলে উঠেছে। পথটা দুর্গম আর কাটা বেছানো জেনেও দুই অঞ্চলের মধ্যে বিশ্বকাপ ফাইনালের প্রায় অবাস্তব ভাবনায় অনেকেই। তবে এর আগে দেখে নেওয়া যাক বিশ্বকাপে এই দুই অঞ্চলের দেশগুলোর সাফল্য।
বিশ্বকাপে এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলো
জাপান
এবারের আসরে রীতিমতো শাসন করা জাপান এশিয়া থেকে ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে দুই নম্বরে। ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে ২৪ নম্বরে থাকা দেশটি ১৯৯৮ সালে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। এর আগে চেষ্টা করেও কখনও সুযোগ করে নিতে পারেনি তারা। তবে এর মধ্যে ১৯৩৮ বিশ্বকাপে নিজেরাই নাম প্রত্যাহার করে নেয় তারা। এ ছাড়া ১৯৫০ বিশ্বকাপে ফিফা জাপানকে নিষিদ্ধ করে।
১৯৯৮ বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো বিশ্ব আসরে অংশ নেওয়া জাপান পরের সবকটি আসরে খেলেছে। এই ছয় আসরের মধ্যে তিনবারই শেষ ষোলোতে উঠেছে তারা। সেটার ধারাবাহিকতায় এবারও দ্বিতীয় রাউন্ডের টিকেট কেটেছে এশিয়ার দেশটি। আর এবার তাদের দাপটে বিস্মিত গোটা ফুটবল দুনিয়া।
দক্ষিণ কোরিয়া
ফিফা র্যাঙ্কিং ২৮ নম্বরে থাকা দক্ষিণ কোরিয়ার বিশ্বকাপ ইতিহাস সবচেয়ে পুরনো। এশিয়ার এই দেশটি প্রথমবারের মতো ১৯৫৪ বিশ্বকাপে অংশ নেয়। প্রথম আসরেই তারা শেষ ষোলোতে ওঠে। এরপর সাতটি আসরে বাছাই পর্ব পেরোতে পারেনি কোরিয়া। ১৯৮৬ বিশ্বকাপ দিয়ে ফেরা দক্ষিণ কোরিয়ার এরপর প্রতিটি আসরেই অংশ নিয়েছে। দেশটির সর্বোচ্চ সাফল্য ২০০২ বিশ্বকাপে ঘরের মাঠে সেমি-ফাইনাল খেলা। এ ছাড়া একবার প্রথম রাউন্ড পেরোয় তারা। ২০১৮ বিশ্বকাপে জার্মানিকে হারিয়ে বিদায় করে দেয় কোরিয়া।
ইরান
এশিয়ার মধ্যে ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে সবচেয়ে এগিয়ে ইরান। মধ্যপ্রাচ্যের দেশটি ১৯৭৮ বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো অংশ নেয়। প্রথম তিনটি আসরে ফিফার সদস্য দেশ ছিল না তারা। প্রথম বিশ্বকাপ খেলার পর ২০ বছর অপেক্ষা করতে হয় তাদের। ১৯৯৮ বিশ্বকাপ দিয়ে ফেরা ইরান পরের ছয় আসরের চারটিতে খেলে। কিন্তু কোনোবারই প্রথম রাউন্ড পার হতে পারেনি ইরান। এবার আশা জাগিয়েও বাদ পড়ে দলটি।
সৌদি আরব
মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটির ফিফা র্যাঙ্কিং ৫১। এবারের আসরে অবিশ্বাস্য ফুটবলে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে চমক উপহার দেওয়া দেশটি ১৯৯৪ সালে প্রথম বিশ্বকাপ খেলে। সেবারই তারা পেরিয়ে যায় প্রথম রাউন্ড। এবার মিলিয়ে বিশ্বকাপে ছয়টি আসরে অংশ নিয়েছে দেশটি। তাদের সর্বোচ্চ সাফল্য ওই প্রথম বিশ্বকাপই।
প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া আয়োজক কাতারের পথচলা ছিল দুঃস্বপ্নের, তিন ম্যাচ হেরে বিদায় নিয়েছে তারা। এ ছাড়া এবারের বিশ্বকাপ থেকে নাম প্রত্যাহার করা উত্তর কোরিয়া বিশ্বকাপের দুটি আসরে অংশ নিয়েছে। তাদের সর্বোচ্চ সাফল্য ১৯৬৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল খেলা। এর বাইরে এশিয়া থেকে চীন একবার বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছে, ২০০২ বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নেয় তারা।
বিশ্বকাপে আফ্রিকা অঞ্চলের দেশগুলো
মরক্কো
ভৌগোলিক দিক থেকে আফ্রিকার দেশ হলেও মরক্কো নিজেদের আরব দেশ বলে দাবি করতে বেশি স্বাছন্দ্যবোধ করে। কিন্তু যেহেতু মহাদেশীয় হিসেবে তারা আফ্রিকার, তাই তাদের সাফল্যে আফ্রিকানরাও খুশি হয়। কাতার বিশ্বকাপে নক-আউটে উঠে ৩৬ বছরের অপেক্ষা ঘুচিয়েছে মরক্কো। এর আগে ১৯৮৬ বিশ্বকাপে শেষ ষোলোতে ওঠে আটলাসের সিংহরা। শেষ ষোলো স্পেনকে হারিয়ে সেটি ছাড়িয়ে গেলে তা মরক্কোর ফুটবল ইতিহাসের সেরা সাফল্য হিসেবেই লেখা হবে।
সেনেগাল
ফিফা র্যাঙ্কিংসহ শক্তি-সামর্থ্যে আফ্রিকার সবচেয়ে বড় দল এখন সেনেগাল। সেরা অস্ত্র সাদিও মানেকে ছাড়াই নক-আউট পর্বে উঠেছে তেরাঙ্গার সিংহরা। আফ্রিকান নেশন্স কাপের বর্তমান চ্যাম্পিয়নরা দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপের নক-আউটে উঠেছে। এর আগে নিজেদের প্রথম বিশ্বকাপ মিশনেই ২০০২ সালে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে যায় তারা।
ঘানা
বিশ্বকাপে ঘানার পথচলা বেশিদিনের নয়। ২০০৬ বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো সুযোগ পায় তারা। প্রথমবারই নক-আউট পর্বে ওঠে দেশটি। আর ২০১০ বিশ্বকাপের ঘানা তো ফুটবল পুরাকীর্তিরই অংশ। আফ্রিকা মহাদেশের প্রথম বিশ্বকাপে আফ্রিকার দল ছিলো ৬টি। শুধুমাত্র ঘানাই গ্রুপ পর্বের বৈতরণী পার হয়েছিল। ২০০৬ বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো অংশ নিয়েই নক-আউট পর্বে উঠা আর সদ্যই ফিফা অনূর্ধব-২০ বিশ্বকাপের শিরোপা জেতা ঘানা কোয়ার্টার-ফাইনালে উরুগুয়েকে হারিয়ে দিয়েছিল প্রায়। সে পথে বাধা ছিলো লুইস সুয়ারেজের 'হ্যান্ডবল'! যে হ্যান্ডবলের জন্য আজও সুয়ারেজকে ক্ষমা করতে পারেনি ঘানা।
ক্যামেরুন
১৯৯০ বিশ্বকাপে প্রথম আফ্রিকান দল হিসেবে কোয়ার্টার-ফাইনালে ওঠে ক্যামেরুন। যে সাফল্য টপকাতে পারেনি আর কোনো আফ্রিকান দলই। ২০০২ বিশ্বকাপে সেনেগাল ও ২০১০ বিশ্বকাপে ঘানাও কোয়ার্টার-ফাইনাল থেকে বিদায় নেয়। এ ছাড়া আর বলার মতোন কোনো অর্জন বিশ্বকাপে নেই আফ্রিকার সিংহদের।
কাতারে আফ্রিকা থেকে অংশ নেওয়া আরেক দল তিউনিশিয়া সম্ভাবনা জাগিয়েও বরাবরের মতো বাদ পড়েছে গ্রুপ পর্ব থেকে। এ ছাড়া এবার সুযোগ না পাওয়াদের মধ্যে নাইজেরিয়া দুইবার উঠেছে নক-আউট পর্বে, মিশর এবং আলজেরিয়া একবার করে স্বাদ পেয়েছে নক-আউটের। এর বাইরে বিশ্বকাপে বলার মতো অর্জন নেই আর কোনো আফ্রিকান দলের।