কেন পারছে না বাংলাদেশ, কী বলছেন সাবেকরা
স্বপ্ন যেখানে সেমি-ফাইনাল খেলা, সেখানে কেবল একটি ম্যাচ মনের মতো হয়েছে। আফগানিস্তানের বিপক্ষে দাপুটে জয়ে বিশ্বকাপ অভিযান শুরু হয় বাংলাদেশের। এরপর কেবলই ব্যর্থতার গল্প। ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ডের পর ভারতের বিপক্ষেও বড় ব্যবধানে হার। শক্তি বিবেচনায় প্রাথমিকভাবে হয়তো এই তিনটি দলের পক্ষেই সবাই বাজি ধরবেন, কিন্তু ফরম্যাটটা ওয়ানডে বলে বাংলাদেশকে নিয়ে আশা করাটাও অবাস্তব ছিল না।
প্রিয় ফরম্যাটে লড়াকু সেই বাংলাদেশের দেখা মিলছে না, বিশ্বকাপে কঠিন সময় যাচ্ছে তাদের। হেরে যাওয়া ম্যাচ থেকেও ইতিবাচক অনেক কিছু নেওয়ার থাকে। শ্রীলঙ্কা যেমন প্রথম দুই ম্যাচে হারলেও তিনশ ছাড়ানো সংগ্রহ গড়ে। কিন্তু হেরে যাওয়া ম্যাচ থেকে বাংলাদেশের নেওয়ার মতো কিছুই নেই। জয় তো দূরের কথা, প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে লড়তেও পারেনি সাকিব আল হাসানের দল।
বিশ্বকাপ স্বপ্নের পথে চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে দলের ব্যাটিং। টপ অর্ডার ব্যর্থ হচ্ছে, অন্যদের কেউ-ই খেলতে পারছেন না বড় ইনিংস। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২২৭ রান করা দলটি নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে করে ২৪৮ রান। ভারতের বিপক্ষে আগে ব্যাটিং করে ২৫৬ রান তুললেও তা যথেষ্ট হয়নি। কেন পারছে না বাংলাদেশ, কোথায় পিছিয়ে পড়ছে তারা, সামনের ম্যাচগুলোতে করণীয় কী, ব্যাটিং অর্ডার কেমন করা উচিত; এসব নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে কথা বলেছেন জাতীয় দলের দুই সাবেক ক্রিকেটার খালেদ মাসুদ পাইলট ও মেহরাব হোসেন অপি।
বাংলাদেশের ভালো করতে না পারার কারণ হিসেবে দুজনই ব্যাটিং ব্যর্থতার কথা জানিয়েছেন, অভাব দেখছেন দলগত পারফরম্যান্সের। এ ছাড়া হেরে যাওয়া দলগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের শক্তির পার্থক্যের বিষয়টিও উল্লেখ করেছেন তারা। সাবেক অধিনায়ক পাইলট বলেন, 'ভারত যে মানের দল আর বাংলাদেশের যে মানের দল, তাতে এমনিতেই ভারতের জেতার কথা। আমাদের যে ভালো মানের ক্রিকেটার আছে, তারা একইদিনে; অর্থাৎ একই ম্যাচে সবাই এক সঙ্গে ভালো খেলছে না। হয়তো ব্যক্তিগতভাবে ভিন্ন ভিন্ন ম্যাচে লিটন, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ করছে। কিন্তু দলগত পারফরম্যান্স আসছে না।'
'যে উইকেটে ৩০০ রান করার কথা, সেই উইকেটে আমরা করছি ২৫০। ভারতের বিপক্ষে যে উইকেট ছিল আর যেমন শুরু হয়েছিল, আমার মনে হয় ৩৩০-৪০ করা উচিত ছিল। এমন রান যদি না করি, বিপক্ষ দলে তো মানসম্পন্ন খেলোয়াড় আছে, তারা বুঝতেই দেবে না কীভাবে রান করেছে; আর সেটাই করেছে তারা। ব্যক্তিগত ছোট ছোট ইনিংস আসছে। দলগতভাবে যেটা দরকার, একই দিনে সবার পারফরম্যান্স, সেটা আসছে না।' যোগ করেন তিনি।
পাইলটের সুরে কথা বললেন বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরিয়ান অপিও, 'বাংলাদেশ কাদের বিপক্ষে তিনটি ম্যাচ হেরেছে, সেটা আগে দেখতে হবে। যাদের বিপক্ষে হেরেছি, তারা আমাদের চেয়ে র্যাঙ্কিং, বিশ্বকাপে অভিজ্ঞতায় অনেক এগিয়ে। পারফরম্যান্সে আমি যে খুব বেশি হতাশ, তেমন বলব না। কিন্তু বিশ্বকাপের মতো আসরে ব্যাটসম্যানদের রান করাটা খুব জরুরি। অন্যান্য দল যে ৩০০-৩৫০ করছে, সেটা তো ব্যাটসম্যানরাই করছে, টপ অর্ডারের ব্যাটসম্যানরা বেশি রান করছে। তো আমাদের যে টপ অর্ডারে যারা আছে, এখান থেকে অন্তত দুজনের ক্লিক করাটা খুবই জরুরি, বড় রান করা জরুরি।'
ব্যাটসম্যানদের বড় ইনিংস ও দলগত পারফরম্যান্স নিয়ে তার ভাষ্য, ' ৪০-৫০ রান হলো, আমি খুশি হয়ে গেলাম; তেমন না। ওটাকে অন্তত ৭০-৮০ বা সেঞ্চুরিতে নিয়ে যেতে হবে। এ ছাড়া যদি বড় জুটি গড়তে পারে, তাহলে আমাদের আরেকটু ভালো করার সম্ভাবনা আছে। সবাই এক সঙ্গে ক্লিক করবে না, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু ম্যাচে তিন-চার জন একসঙ্গে পারফরম্যান্স না করলে জেতা যাবে না। আমাদের সেটাই হচ্ছে না। কয়েকটা ম্যাচে ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স এসেছে, আবার অন্যান্য ম্যাচে হয়নি। কিন্তু একত্রে জ্বলে ওঠা হচ্ছে না, বড় জুটি গড়ার ব্যাপারটা মিসিং।'
মুশফিকুর রহিম ছয়ে, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ সাত ও আট নম্বরে ব্যাটিং করছেন। এমন দুজন অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যানকে আরও উপরে ব্যাটিং করানোর পক্ষে পাইলট। এ ছাড়া নাজমুল হোসেন শান্তকে তিন নম্বর থেকে সরানোর সিদ্ধান্তও ঠিক মনে করেন না তিনি, 'আমাদের হয়তো পরিকল্পনা ছিল যে গ্যাম্বলিং করব, তাওহিদ হৃদয়কে পাঁচে, তানজিদ তামিমকে দিয়ে ওপেন করাবো। এসব করতে গিয়ে বড় ধরনের ঝুঁকি হয়ে গেছে। তামিম ইকবাল থাকলে অন্যরকম হতে পারতো। বড় বড় খেলোয়াড়রা বড় খেলা খেলে অভ্যস্ত, যেটা মাহমুদউল্লাহ করছে। ভুল কম করবে।'
'মুশফিক ও রিয়াদ খেলছে, কিন্তু ততোক্ষণে দেরি হয়ে যাচ্ছে। অনেক পরে ব্যাটিং করছে, ৬-৭-৮ নম্বরে খেলছে। ততোক্ষণে খেলা হাত থেকে চলে গেছে। ভারতের বিপক্ষে মাহমুদউল্লাহ আউট হয়ে গেল শট খেলতে গিয়ে। সে যদি আরও ১০-১৫ ওভার আগে ব্যাটিং করতো, তাহলে ৮০-৯০ রান করতে পারতো। খুব বেশি ইমপ্রোভাইজ করা ভালো না। যেমন আমরা মিরাজকে দিয়ে বেশি ইমপ্রোভাইজ করেছি। একটি-দুটি ম্যাচে ভালো খেলেছে, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু শান্ত গত এক বছরে তিন নম্বরে ভালো খেলে এলো, শান্তর জায়গায় করা হলো ইমপ্রোভাইজ।' বলেন তিনি।
অপি অবশ্য মুশফিক-মাহমুদউল্লাহকে এগিয়ে ব্যাটিং করানোর পক্ষে নন, কারণ এ দুজন ছাড়া ছয়-সাতে ব্যাটিং করার মতো কাউকে দেখেন না তিনি, 'টিম ম্যানেজমেন্ট সবচেয়ে ভালো বোঝে কোন পজিশনে কাকে খেলাতে হবে। কোন দলের বিপক্ষে কাকে কোন অর্ডারে নামানো হবে, এটা কিন্তু প্রতিপক্ষ বিবেচনায় ঠিক করা হয়। প্রতিপক্ষ দেখে দল নির্বাচন করা হয়, ব্যাটিং অর্ডার ও পরিকল্পনা সাজানো হয়। তো মুশফিক ও মাহমুদউল্লাকে এগিয়ে আনা হলো, কিন্তু ৬-৭ নম্বরে তাহলে কে ব্যাটিং করবে। এটাও তো ভাবতে হবে, এই জায়গারও বিকল্প থাকতে হবে।'
বাংলাদেশের বোলিংয়ে সমস্যা দেখেন না পাইলট। বোলারদের লড়াই করার জন্য রসদটা ব্যাটসম্যানদেরই দিতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, 'আমার মনে হয় বোলিংয়ে কোনো ভুল নেই। শুধুমাত্র ভুল হচ্ছে ব্যাটে রান নেই। রান না করলে বোলাররা কী নিয়ে লড়াই করবে! রান না করলে কোনো উপায় নাই। রান আমরা খুবই কম করছি। দুজন ওপেনার একসঙ্গে রান করছে না। যে ম্যাচে করেছে, সেই ম্যাচে মাঝে এলোমেলো অবস্থা, তাই সেটা খুব একটা কাজে আসেনি। তাই বোলারদের লড়াই করার জায়গা করে দিতে স্কোরকার্ডে ভালো রান যোগ করতে হবে।'