সাত ম্যাচে টানা ছয় হার জয়ের পথ ভুলে যাওয়া বাংলাদেশের
একটা জয় কতোটা দামী? এটাকে প্রশ্নের বদলে জটিল ধাঁধা মনে হতে পারে বাংলাদেশের ক্রিকেট দলের কাছে। জয়ের স্বাদ কেমন হয়, সেটাই তো ভুলে যাওয়ার অবস্থা সাকিব আল হাসানদের। এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের জন্য হারই হয়ে উঠেছে অমোঘ নিয়তি। হারতে হারতে ক্লান্ত বাংলাদেশ আরও একটি ম্যাচে অসহায় আত্মসমর্পণ করে মেনে নিলো হার। জয়ে ফেরার মিশন নিয়ে পাকিস্তানের বিপক্ষে মাঠে নেমে ব্যাটে-বলে সামান্যতম লড়াইও করতে পারলো না তারা, সঙ্গী হলো আরেকটি বড় হার।
মঙ্গলবার কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৭ উইকেটের বড় ব্যবধানে হেরে গেছে বাংলাদেশ। এবারের বিশ্বকাপে সাত ম্যাচে এটা বাংলাদেশের টানা ষষ্ঠ হার। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে হারেই কার্যত শেষ চারের দৌড় থিকে ছিটকে যায় বাংলাদেশ। পাকিস্তানের বিপক্ষে হারে আনিষ্ঠানিকভাবে তাদের বিদায় নিশ্চিত হয়ে গেল। শ্রীলঙ্কা ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ দুটি বাংলাদেশের জন্য এখন নিতান্তই নিয়ম রক্ষার। তবে এই ম্যাচ দুটি জিতে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে জায়গা করে নেওয়ার সুযোগ আছে তাদের।
টস জিতে আগে ব্যাটিং করা বাংলাদেশ ৪৫.১ ওভারে ২০৪ রানেই অলআউট হয়। বাংলাদেশের চারজন ব্যাটসম্যান কেবল দুই অঙ্কের রান করেন। চরম ব্যর্থতার মাঝেও হাফ সেঞ্চুরি তুলে নেন বিশ্বকাপে ব্যাট হাতে বাংলাদেশের একমাত্র ধারাবাহিক পারফর্মার মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। লিটন কুমার দাস ও অধিনায়ক সাকিব আল হাসান চল্লিশোর্ধ্ব ইনিংস খেলেন। এবারের বিশ্বকাপে এটা বাংলাদেশের তৃতীয় সর্বনিম্ন দলীয় সংগ্রহ, তাদের সর্বোচ্চ সংগ্রহ ২৫৬।
বাংলাদেশের দেওয়া ছোট লক্ষ্য তাড়ায় দুই ওপেনার আবদুল্লাহ শফিক ও ফকর জামানের দারুণ জুটির পর মোহাম্মদ রিজওয়ান ও ইফতিখার আহমেদ মিলে ৩২.৩ ওভারেই দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছে দেন, তখনও বাকি ছিল ১০৫ বল। এবারের বিশ্বকাপে টানা চার ম্যাচে হারের পর জয়ের স্বাদ পেল বাবর আজমের দল। এই জয়ে সেমি-ফাইনাল খেলার আশা বেঁচে রইলো তাদের, ৭ ম্যাচে ৩ জয়ে ৬ পয়েন্ট পাকিস্তানের। পয়েন্ট টেবিলের পাঁচ নম্বরে আছে তারা।
লক্ষ্য তাড়ায় ধীর-স্থির শুরু করেন শফিক ও ফকর । সময়ের সাথে সাথে উইকেটে থিতু হয়ে রান তোলার গতি বাড়াতে থাকেন তারা। দাপুটে ব্যাটিংয়ে উদ্বোধনী জুটিতে ১২৭ বলে ১২৮ রান যোগ করেন এ দুজন। বিশ্বকাপে প্রথম উইকেটে এটা পাকিস্তানের চতুর্থ সর্বোচ্চ জুটি, যেকোনো উইকেটে এবারের আসরের তৃতীয় সর্বোচ্চ।
শফিককে থামিয়ে এই জুটি ভাঙেন মেহেদী হাসান মিরাজ। এলবিডব্লিউ হয়ে ফেরার আগে ৬৯ বলে ৯টি চার ও ২টি ছক্কায় ৬৮ রান করেন ডানহাতি এই ওপেনার। বিশ্বকাপে নিজের ছায়া হয়ে থাকা বাবর দ্রুতই ফিরে যান, তাকেও সাজঘর দেখান মিরাজ। তুলে মারতে গিয়ে লং অনে তাওহিদ হৃদয়ের হাতে ধরা পড়েন ১৬ বলে ৯ রান করা বাবর। ৯ রান পর ফকরকেও নিজের শিকারে পরিণত করেন মিরাজ।
দলে ফিরেই ৭৪ বলে ৩টি চার ও ৭টি ছক্কায় ৮১ রানের দারুণ এক ইনিংস খেলেন পাকিস্তানের এই ওপেনার। ৯ রানের মধ্যে দুই উইকেট হারিয়ে কিছুটা চাপেই পড়ে যায় পাকিস্তান। তবে সেই চাপ দলকে বুঝতেই দেননি রিজওয়ান ও ইফতিখার আহমেদ। ৩৬ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি গড়ে দলকে বড় জয় এনে দেন তারা। রিজওয়ান ২১ বলে ৪টি চারে ২৬ ও ইফতিখার ১৫ বলে ২টি চারে ১৭ রানে অপরাজিত থাকেন। পাকিস্তানের যাওয়া ৩টি উইকেটই নেন মিরাজ। বাংলাদেশের বাকি বোলারদের কেউ-ই সুবিধা করতে পারেননি।
এর আগে বাংলাদেশের শুরুটা হয় দুঃস্বপ্নের মতো। প্রথম ওভারেই ফিরে যান তানজিদ হাসান তামিম। তরুণ বাঁহাতি এই ওপেনারকে ফিরিয়ে ওয়ানডেতে ১০০ উইকেট পূর্ণ করেন পাকিস্তানের তারকা পেসার শাহিন শাহ আফ্রিদি, যা ওয়ানডেতে পেসারদের মধ্যে দ্রুততম। রানের খাতা খোলার আগেই এলবিডব্লিউর ফাঁদে পড়ে সাজঘরে ফেরেন তানজিদ। বিশ্বকাপে সাত ম্যাচের মধ্যে তিন ম্যাচে দুই অঙ্কের রান করতে ব্যর্থ হলেন তিনি।
শুরুতেই বাংলাদেশের ইনিংসে আঘাত হানা শাহিন আফ্রিদি নিজের পরের ওভারেও তোপ দাগেন, এবার তার শিকার নাজমুল হোসেন শান্ত। ফ্লিক করতে গিয়ে উসামা মীরের হাতে ধরা পড়েন ৩ বলে ৪ রান করা বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান। প্রথম ম্যাচে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ৫৯ রান করার পর থেকে নিজের ছায়া হয়ে আছেন শান্ত। পরের ছয় ম্যাচে একবারও দুই অঙ্কের রান করতে পারেননি তিনি, রানের খাতা খোলার আগেই আউট হয়েছেন দুবার।
অনেক সমালোচনার পর এই ম্যাচে মুশফিকুর রহিমের ব্যাটিং অর্ডারে পরিবর্তন আনা, এগিয়ে তাকে চার নম্বরে নামানো হয়। অভিজ্ঞ এই ব্যাটসম্যান অবশ্য এদিন টিকতে পারেননি, হারিস রউফের বলে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেওয়ার আগে ৮ বলে ৫ রান করেন তিনি। ২৩ রানেই তিন উইকেট হারানো দলের হাল ধরেন লিটন কুমার দাস ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। শুরুর চাপ কাটিয়ে সাবলীল ব্যাটিং-ই করছিলেন এ দুজন।
কিন্তু দলীয় সংগ্রহ ১০০ ছাড়িয়ে প্রতিপক্ষকে ক্যাচ অনুশীলন করিয়ে বিদায় নেন লিটন। এমন আউট যে সবার জন্যই হতাশার, লিটনের শারীরিক ভাষাই সেটা বলে দিচ্ছিল। আউট হওয়ার পর নিজেই যেন বিশ্ব করতে পারছিলেন না ডানহাতি এই ওপেনার। ২১তম ওভারে ইফতিখার আহমেদের করা পায়ের ওপরের ডেলিভারি ঘুরিয়ে খেলতে গিয়ে মিড উইকেটে আগা সালমানের হাতে ক্যাচ তুলে দেন লিটন। ৬৪ বলে ৬টি চারে ৪৫ রান করেন তিনি।
আউট হওয়ার আগে চতুর্থ উইকেটে মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে ৭৯ রানের জুটি গড়েন লিটন, যা এবারের বিশ্বকাপে যেকোনো উইকেটে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সেরা জুটি। এরপর মাহমুদউল্লাহও বেশি সময় টিকতে পারেননি, তবে তিনি হাফ সেঞ্চুরি তুলে নেন। এটা তার বিশ্বকাপের তৃতীয় ও এবারের আসরের প্রথম হাফ সেঞ্চুরি। শাহিন আফ্রিদির বলে বোল্ড হওয়ার আগে ৭০ বলে ৬টি চার ও একটি ছক্কায় ইনিংস সেরা ৫৬ রান করেন মাহমুদউল্লাহ।
চাপের মাঝেও ভালো শুরু করেন তাওহিদ হৃদয়। তবে ছক্কা মারার পরের বলেই স্লিপে ক্যাচ দিয়ে আউট হন কয়েক ম্যাচ পর সুযোগ পাওয়া তরুণ এই ব্যাটসম্যান। ৩ বলে একটি ছক্কায় ৭ রান করেন হৃদয়। ১৪০ রানে ৬ উইকেট হারানো দলে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফেরান সাকিব ও মেহেদী হাসান মিরাজ। সপ্তম উইকেটে ৪৫ রান যোগ করেন এ দুজন।
এদিন সাকিবকে রান তুলতে সংগ্রাম করতে দেখা যায়। ব্যক্তিগত ২৪ রান পর্যন্ত ধুঁকতে থাকেন তিনি। এরপর ছন্দ মিললেও বেশি পথ এগোনো হয়নি তার। ৬৪ বলে ৪টি চারে ৪৩ রান করেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। এরপর লড়াই করতে থাকা মিরাজকে ফিরিয়ে শাসন শুরু করা পাকিস্তান পেসার চোখের পলকেই বাংলাদেশের ইনিংস গুটিয়ে দেন। মিরাজ ৩০ বলে একটি করে চার ও ছক্কায় ২৫ রান করেন।
আগুনে বোলিংয়ে শুরুতেই বাংলাদেশকে দিক ভুলিয়ে দেওয়া পাকিস্তানের বাঁহাতি পেসার শাহিন আফ্রিদি ১০ ওভারে এক মেডেনসহ মাত্র ২৩ রান খরচায় ৩টি উইকেট নেন। বাংলাদেশের শেষের ৩ উইকেট নেওয়া ওয়াসিম ৮১.১ ওভারে ৩১ রান দেন। হারিস রউফ ২টি এবং ইফতিখার আহমেদ ও উসামা মীর একটি করে উইকেট পান।