‘ক্রিকেটীয় চেতনা প্রদর্শনে অসাধারণ একটা অর্জন হতো বাংলাদেশের’
বিশ্বকাপকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। একটি ভাগ গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের অতিমানবীয় ইনিংস পরবর্তী বিশ্বকাপ। আরেকটা ভাগ এই ইনিংস পূর্ববর্তী বিশ্বকাপের আগের অংশ। যে অংশে ক্রিকেট দুনিয়া মজে ছিল 'টাইমড আউট' নিয়ে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে এই আউটের শিকার শ্রীলঙ্কার অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস। অনেকেই এটাকে ক্রিকেটের চেতনা বিরোধী মনে করেন, তাদের অবস্থান লঙ্কান অলরাউন্ডারের সঙ্গে।
অনেকেই আবার মনে করাচ্ছেন নিয়মের কথা। ক্রিকেটের আউটের ১০ ধরনের এটি একটি। তাই বাংলাদেশ অধিনায়ক সাকিব আল হাসান দলের জন্য ঠিক কাজটাই করেছেন বলে মত অনেকের। ক্রিকেটের চেতনা ও ক্রিকেটের আইন; বিষয় দুটির কারণে সঙ্ঘাতময় একটি অবস্থান তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশের বিপক্ষে ব্যাটিংয়ে নেমে দুই মিনিটের মধ্যে প্রথম বল মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না ম্যাথুস। সাকিবের আবেদনের প্রেক্ষিতে তাকে 'টাইমড আউট' ঘোষণা করেন আম্পায়ার। এই ঘটনায় সাকিব ও বাংলাদেশকে চরম সমালোচনা করেন ম্যাথুস। যদিও সাকিব জানান, যুদ্ধের ময়দানে তিনি সেটাই করেছেন, যেটা করা দরকার ছিল। আবার আইনের কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সাবেক সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী মনে করেন, আইন প্রয়োগ করার কথা বলা পর্যন্ত ঠিক ছিলো। কিন্তু যুদ্ধের ময়দান এবং যেকোনো মূল্যে জেতার কথা বলে সাকিব ক্রিকেটীয় চেতনাকে বিসর্জন দিয়েছেন। এই ঘটনায় ক্রিকেটীয় চেতনা প্রদর্শন করে বাংলাদেশের অর্জনের সুযোগ ছিল বলে বিশ্বাস তার। এই ঘটনা নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে কথা বলেছেন সাবের হোসেন, তার পুরো বক্তব্য তুলে ধরা হলো-
"একটা হচ্ছে আইনের প্রয়োগ যে আইন কী বলে, আর স্পিরিট বা চেতনা কী বলে। অনেকেই বলছে এই দুটির মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে। কিন্তু আমি এখানে কোনো দ্বন্দ্ব দেখি না। কারণ চেতনা হচ্ছে ভিত্তি, আর আইন হচ্ছে চেতনা দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বিষয়। এখানেই কিন্তু ক্রিকেটের ভিন্নতা। অন্য কোনো খেলায় 'স্পিরিট অব গেম' বা চেতনার কথা বলা হয় না। ফুটবলে স্পিরিটের কিছু নেই, রাগবি বা অন্য খেলায় নেই; তবে ক্রিকেটে এটা আছে। ক্রিকেটের একটা ভিন্নতা যে, এখানে চেতনার একটা ব্যাপার আছে।
এই ঘটনায় আমার কাছে মনে হয়েছে, সাকিব যদি বলতো 'আমি আইনটা ব্যবহার করছি', তাহলে ভালো হতো। কিন্তু এখন এটা এমন হয়ে গেছে যে এটা একটা যুদ্ধ, যেকোনো উপায়ে আমাকে জিততে হবে। জেতার জন্য আমি চেতনাকে বিসর্জন করলাম। এটাই হচ্ছে মূল বিষয়। এটা তো আইনে আছে। আমি যেটা করেছি, সেটা তো বেআইনি কিছু নয়- এটা ঠিক আছে। কিন্তু যখন বলেন, এটা একটা যুদ্ধ ছিল, তখন কিন্তু হয়ে যায় যেকোনো মূল্যে জিততে হবে। যেকোনো মূল্যে জিততে হবে, এটাই এখন চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হচ্ছে।
আমি যদি দুটিই 'উইন উইন' করতে যাই, সাকিব আবেদন করতো, আম্পায়ার আউট দিয়ে দিতো, তারপর আম্পায়ার যখন তাকে দুইবার সুযোগ দিলো যে 'তুমি তোমার সিদ্ধান্তে থাকবে কিনা', ওই সময়ে আমরা চেতনা দেখাতে পারতাম যে আউট হয়ে গেছে আইন অনুযায়ী, কিন্তু তাকে আবার ব্যাটিং করার সুযোগ দিলাম। এটা হলে সবচেয়ে ভালো হতো। আইনের প্রয়োগ হতো, সবাই সতর্ক হতো। কারণ চেতনা তো এখানে প্রভাবশালী। এ কারণেই তো ১৪৬ বছরে কেউই এই আইনটাকে ব্যবহার করেনি।
এটা দুর্ভাগ্যজনক। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জয়ের ব্যবধান যদি দেখেন, খুবই সামান্য। কথার কথা বলছি, সেখানে ম্যাথুস যদি আরও ২০-২৫ রান করে ফেলতো, ফলই কিন্তু এটার ওপর চলে আসতো। খুব বড় ব্যবধানে যদি বাংলাদেশ জিতে যেতো, এটা নিয়ে হয়তো এতো কথা হতো না। যুদ্ধে আছি, যা করার তাই করেছি, এই অংশটা না বললে ঠিক ছিলো। যেকোনো মূল্যে যুদ্ধ জিততে হবে, বিষয়টা অমন হয়ে গেছে। সেখানে আমি চেতনাকে বিসর্জন দিলাম, আমি শুধু আইন মানছি। এখানেই সমস্যা তৈরি করেছে।
কোনটাকে প্রধান ধরবেন? আমি যেটা দেখি, আমি মনে করি চেতনাকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত, কারণ ক্রিকেটটা চেতনাগত সৌন্দর্যের কারণেই আলাদা। যেটা রুলস অব ক্রিকেটের মধ্যে আছে, চেতনার কথাটা বলা আছে। চেতনা হচ্ছে মৌলিক। এটা অনেকটা এমন যে একটা হচ্ছে সংবিধান, আরেকটা হচ্ছে আইন। সংবিধান হচ্ছে আপনার ভিত্তি। কোনো আইন যদি সংবিধান পরিপন্থী হয়, সেটা তো কার্যকর করা হয় না। আমরা খেলাটা জিতেছি, তখনও হয়তো জিততাম, আমাদের উইন উইন একটা সুযোগ ছিল। আম্পায়ার সাকিবের কাছে জানতে চেয়েছেন, সে পুনর্বিবেচনা করবে কিনা। সেখানে সাকিব যদি তাকে (ম্যাথুস) ফিরিয়ে আনতো, তাহলে এটা আমাদের জন্য উইন উইন হতো, অসাধারণ একটা অর্জন হতো বাংলাদেশের।"