শত বাধা পেরিয়ে অলিম্পিকের মঞ্চে ইরানের দ্রুততম মানবী
২০২৪ প্যারিস অলিম্পিকে ইরানের হয়ে লড়বেন ফারজানে ফাসিহি। ইরানের সর্বকালের সবচেয়ে দ্রুততম মানবী এই ৩১ বছর বয়সী স্প্রিন্টার। শুধু ইরানই নয়, বর্তমানে এশিয়াতেই নারীদের ৬০ মিটার স্প্রিন্টে এক নাম্বার স্থানে আছেন তিনি। ইরানের জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে ৬০ ও ১০০ মিটার স্প্রিন্টে নিজের গড়া রেকর্ডই বেশ কয়েকবার ভেঙেছেন ফাসিহি।
তবে ফাসিহির এই উত্থানের গল্পে রয়েছে নানা মোড়। ইরানে নারীদের খেলাধুলায় তেমন উৎসাহিত করা হয় না। সেরকম এক পরিবেশ থেকে উঠে এসেছেন ফাসিহি। যার পুরোটাই তার নিজের পরিশ্রমের ফসল। সরকার থেকে কোনো ধরনের সাহায্য মেলেনি। ২০২৪ প্যারিস অলিম্পিকে অংশ নিতে নিজ উদ্যোগে সার্বিয়ার বেলগ্রেডে অনুশীলন চালিয়ে যাচ্ছেন ফাসিহি।
অথচ ফাসিহির দৌড়বিদই হওয়ার কথা ছিল না। পরিবার থেকে খেলাধুলায় আসতে বরাবরই উৎসাহ পেয়েছেন তিনি। বাবা ছিলেন ভলিবল খেলোয়াড়, ভাই সাঁতার এবং ডাইভিংয়ে চ্যাম্পিয়ন। তারা ফাসিহিকে খেলতে সাহস জুগিয়েছেন। পরিবার থেকে সমর্থন পাওয়া নিয়ে ফাসিহির কথা, 'বিয়ে হওয়ার আগ পর্যন্ত আমার বাবা সব ট্রেইনিং সেশনে উপস্থিত থাকতেন। আমার সব প্রতিযোগিতায় মা সাহস জোগাতে যেতেন। তাদের সমর্থন ছাড়া আমি এতদূর আসতে পারতাম না।'
৫ থেকে ১২ বছর বয়স পর্যন্ত জিমন্যাস্টিকস করেছেন ফাসিহি, একদিন তার জিম শিক্ষকের জোরাজুরিতে বদলে গেল সব, 'আমি যখন স্কুলে ছিলাম, একদিন আমার জিম শিক্ষক আমাকে বললেন স্প্রিন্টে অংশ নিতে। আমি এটা করতে চাইনি।' সেদিন ইসফাহানের আঞ্চলিক রেকর্ড ভেঙে দিয়েছিলেন এই অ্যাথলেট। এরপরই দৌড়ের প্রতি ভালোবাসা জন্মায় ফাসিহির।
২০১৬ সালে ফাসিহি প্রতিযোগিতামূলক দৌড়ে প্রথমবার অংশ নেন। তার দল সেখানে বেশ ভালো ফল অর্জন করে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে এশিয়ান ইনডোর চ্যাম্পিয়নশিপের ৪*৪০০ মিটার রিলেতে রৌপ্য পদক জিতে নেন ফাসিহি ও তার দল। এই অর্জনের পর ফাসিহির ক্যারিয়ার ঊর্ধ্বগামী হওয়ার কথা থাকলেও ইরান সরকার কোনো সাহায্য না করায় তা আর হয়নি। শেষ পর্যন্ত সব ছেড়ে ছুড়ে ব্যক্তিগত ট্রেইনার বনে যান ফাসিহি।
২০১৮ সালের শেষদিকে প্রতিযোগিতামূলক স্প্রিন্টে আরেকবার চেষ্টা করার সিদ্ধান্ত নেন ফাসিহি। এবার ঘটে এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা। অনুশীলন শুরু করার এক বছর পর ফাসিহি তার কোচদের মধ্যে একজন আমির হোসেইনিকে বিয়ে করে নেন। ফাসিহির অন্যতম ভরসার স্তম্ভ ও সমর্থক ছিলেন আমির। ২০২০ সালে ফাসিহির ক্যারিয়ার একলাফে উঠে যায় অনেকদূর। যা হওয়ার কথা ছিল ২০১৬ সালেই।
২০২১ সালে সার্বিয়ার অ্যাথলেটিক ক্লাব বিএকের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন ফাসিহি। তিনি যে পদ্ধতিতে চুক্তি করেন সেটিকে বলা হয় লিজিওনেয়ার- যার অর্থ, ভিন্ন দেশের ক্রীড়াবিদ হয়েও অন্য একটি দেশের স্পন্সরের মাধ্যমে তাদের পক্ষে লড়াই করা, অনেকটা ভাড়াটে যোদ্ধাদের মতোই এই কনসেপ্টটি। বলা বাহুল্য, ইরানের প্রথম নারী হিসেবে এমন চুক্তি করেন ফাসিহি। এই বিষয়ে তার মন্তব্য, 'লিজিওনেয়ার হওয়ার সিদ্ধান্তটা ঝুঁকিপূর্ণ হলেও এটি আমার জন্য একটি নতুন রাস্তা ছিল। আমার ভেতরে অনুভূত হচ্ছিল যে এটি আমার করা উচিত।' তার এই সিদ্ধান্ত ইরানের তরুণ নারী অ্যাথলেটদের অনুপ্রেরণা জোগাতে সাহায্য করবে বলে মনে করেন ফাসিহি।
২০২৩ সালে এশিয়ান ইনডোর অ্যাথলেটিকসে ৬০ মিটার স্প্রিন্টে মাত্র ৭.২৮ সেকেন্ড সময় নিয়ে সোনা জেতেন ফাসিহি। সেটি ছিল এই ইভেন্টে এশিয়ার দ্রুততম রেকর্ড। তবে দিনটি ফাসিহির এই কীর্তির জন্য যতোটা না বেশি মনে রাখার মতো, তারচেয়েও বেশি মনে রাখতে হবে অন্য একটি কারণে। জয়ের পর পোডিয়ামের দিকে হেঁটে যেতে যেতে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে ফাসিহি গর্জে ওঠেন, 'এটি ইরানের জনগণের জন্য। এটি ইরানের মানুষের খুশির জন্য।'
সেদিন ফাসিহি ইরানের পতাকাও গায়ে জড়াননি, মাথা নিচু করে সম্মান গ্রহণ না করে বরং নীরবে অশ্রুপাত ঘটে ফাসিহির চোখ দিয়ে, এমনকি ইরানের জাতীয় সঙ্গীতও গাননি তিনি। কিন্তু কেন এতসব প্রতিবাদ? কারণ, ২০২২ সালে ইরানি পুলিশের জিম্মায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া তরুণী মাসা আমিনি। এই ইরানি তরুণীকে পুলিশ আটক করেছিল হিজাব ঠিকঠাকভাবে না পড়ার 'অপরাধে'!
অলিম্পিকে অবশ্য ফাসিহি আরও দুই বছর আগেই সুযোগ পেয়েছিলেন। ২০২০ টোকিও অলিম্পিকে একটি বিশেষ পদ্ধতিতে অংশ নেওয়ার সুযোগ পান এই ইরানি নারী অ্যাথলেট, যেটিকে বলা হয় 'ইউনিভার্সালিটি প্লেসমেন্ট'। এই পদ্ধতিতে যে সব দেশ থেকে খুব কম সংখ্যক অ্যাথলেট অলিম্পিকে অংশ নিয়ে থাকে তাদেরকে উৎসাহিত করা হয়। টোকিওতে ফাসিহি নিজের প্রিয় ১০০ মিটার স্প্রিন্টে অংশ নেন।
১৯৬৪ সালের অলিম্পিকের পর ৫৭ বছরে ফাসিহিই ছিলেন অলিম্পিকে অংশ নেওয়া প্রথম ইরানি নারী অ্যাথলেট। সেবারও অলিম্পিক হয়েছিল টোকিওতে, ইরানের প্রথম নারী অ্যাথলেট হিসেবে অলিম্পিকে অংশ নিয়েছিলেন সিমিন সাফামেহর। তিনিও ফাসিহির মতোই ১০০ মিটার স্প্রিন্টে অংশ নেন।
টোকিওতে ৫০তম স্থানে শেষ করেন ফাসিহি। কিন্তু ইরান ও বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে ফাসিহির হিজাব পড়ে দৌড়ানো দেখে। অনেকে মন্তব্য করেন যে এই পোশাকের বাধার কারণেই ফাসিহির দৌড়ের গতি কমে গিয়েছে। সেইসঙ্গে তিনি ঠিকভাবে নজরে না আসায় স্পন্সরশিপের মতো গুরুত্বপূর্ণ জিনিসও হারাচ্ছেন। যদিও টোকিও অলিম্পিকেই নিজের দৌড়ানোর নায়ক শেলি অ্যান ফ্রেজার প্রাইসের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পান ফাসিহি, 'তার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর ভালো লাগা আরও বেড়ে যায়। তার জীবনধারা খুবই অনুপ্রেরণাদায়ক। সে একইসঙ্গে একজন অ্যাথলেট, মা এবং অনেক দাতব্য সংস্থাকে সাহায্যও করে।' টোকিওতে ফাসিহির নিজের পারফরম্যান্স তার সামর্থ্যের ধারেকাছেও ছিল না। যা তাকে আরও ভালো করতে উদ্বুদ্ধ্ব করে তোলে।
২০২৪ প্যারিস অলিম্পিকে সুযোগ পেতে বিশেষ কোনো পদ্ধতির সাহায্য নিতে হয়নি ফাসিহিকে। তাতে দারুণ উচ্ছ্বসিত তিনি, 'প্যারিস অলিম্পিক এই কারণে আরও বিশেষ কারণ আমি নিজের যোগ্যতায় এখানে সুযোগ পেয়েছি। ইউনাভার্সালিটি প্লেসমেন্টের সাহায্য আমার প্রয়োজন হয়নি।' ইরানে অনেক ধরনের সমস্যা থাকার পরও দমে যাননি ফাসিহি। নিজস্ব অর্থায়নে অনুশীলন থেকে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে গেছেন তিনি, কম পরিমাণে হলেও নিজের জন্য স্পন্সরশিপও জোগাড় করেছেন নিজেই। নিজের লক্ষ্য পূরণে কখনোই পিছপা হননি এই ৩১ বছর বয়সী অ্যাথলেট।
ফাসিহি বিশ্বাস করেন চীন, জাপান কিংবা ভারত যেভাবে বিভিন্ন খেলার পেছনে অর্থ ব্যয় করছে তাতে এশিয়ার অ্যাথলেটিকস সারা বিশ্বেই সামনে ভালো করবে। তবে সঙ্গে কিছু অসমতার কথাও বললেন ফাসিহি, 'কাতারে অ্যাথলেটদের অনুশীলন করানোর জন্য আমেরিকা থেকে কোচ আনতে হয়। এমনকি ফিজিওথেরাপিস্ট, এনালিস্ট কিংবা স্পোর্টস ফিজিশিয়ানও বিভিন্ন দেশ থেকে আসে। চীন ও জাপানের অ্যাথলেটিক্স দল আমেরিকার ফ্লোরিডাতে অনুশীলন করে।'
২০২৪ সালে দোহা ডায়মন্ড লিগে ১০০ মিটার স্প্রিন্টে অংশ নেন ফাসিহি। কিন্তু ফাইনালে তিনি আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, জ্যামাইকা ও হাঙ্গেরির তারকা দৌড়বিদদের সঙ্গে দৌড়ে সবার নিচের স্থানে শেষ করেন। প্যারিস অলিম্পিকে বিশ্বের সেরা দৌড়বিদদের সঙ্গে লড়বেন ফাসিহি, তিনি বাস্তবতায় বিশ্বাসী একজন মানুষ। তাই তিনি কেবল একটা জিনিসেই নিজের দৃষ্টি দেন যা তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন- তার নিজের পারফরম্যান্স। 'অলিম্পিকে খেলতে পারা অনেক বড় ব্যাপার। আমার লড়াই কেবল আমার নিজের সঙ্গেই। আমি নিজের সেরাটা ছাড়িয়ে যেতে চাই।'