দুর্বার রাজশাহীর সব ক্রিকেটারের চেক আবারও বাউন্স
উইকেট বা ব্যাটসম্যান বিবেচনায় একজন পেসার ওভারে কয়টি বাউন্সার করবেন, সেটা জানা থাকে নির্দিষ্ট সেই পেসারের। অবস্থার পরিবর্তনে পাল্টায় তার পরিকল্পনাও। কিন্তু দুর্বার রাজশাহীর দেওয়া চেক কতোবার বাউন্স করবে, এটা যেমন দলটির ক্রিকেটাররা জানেন না; বিষয়টি নিয়ে ধারণা নেই রাজশাহী কর্তৃপক্ষেরও। পারিশ্রমিক বাবদ ক্রিকেটারদের দেওয়া চেক দ্বিতীয় দফায় বাউন্স করেছে।
প্রথম দফায় রাজশাহীর কয়েকজন ক্রিকেটারের চেক বাউন্স করেছিল। পরে রাজশাহীর পক্ষ থেকে জানানো হয়, দলের সত্ত্বাধিকারী শফিক রহমান দেশের বাইরে থাকায় ভেরিফাই করতে না পেরে ক্রিকেটারদের টাকা দেয়নি ব্যাংক। এ দফায় দেশেই আছেন শফিক, তার স্বাক্ষরিত চেকই জমা দিয়েছিলেন রাজশাহীর ক্রিকেটাররা। কিন্তু রাজশাহীর সব ক্রিকেটারের জমা দেওয়া চেক বাউন্স করেছে। ম্যাসেজ পাঠিয়ে টাকা না দেওয়ার ব্যাপারে ক্রিকেটারদের জানিয়েছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
দেশি একাদশ নিয়ে রোববার রংপুর রাইডার্সের বিপক্ষে নাটকীয় জয়ের পর সংবাদ সম্মেলনে রাজশাহীর অধিনায়ক তাসকিন আহমেদ মজা করে বলেন, 'মিরপুরের উইকেটের মতো চেক বাউন্স না করলেই হয়।' এই ম্যাচের আগে অনেক কিছুর মধ্য দিয়ে যেতে হয় দলটির ক্রিকেটারদের। ম্যাচের দিন হঠাৎ করেই হোটেল বদলায় রাজশাহী, ওয়েস্টিন থেকে শেরাটনে নিয়ে যাওয়া ক্রিকেটারদের। ম্যাচের কয়েকঘণ্টা আগে বিদেশি ক্রিকেটাররা জানান, পারিশ্রমিক না পেলে রংপুরের বিপক্ষে খেলবেন না তারা।
দেশি ক্রিকেটারদের খেলা নিয়েও ছিল অনিশ্চয়তা ছিল। কয়েক ঘণ্টা আগে ২৫ শতাংশ পারিশ্রমিকের চেক দিয়ে দেশি ক্রিকেটারদের মানায় রাজশাহী কর্তৃপক্ষ। চেক পেয়ে সবাই মিলে ছবি তুলে তা ফেসবুকে পোস্ট করেন এনামুল হক বিজয়, লেখেন, 'অল ইজ ওয়েল।' দেশি ক্রিকেটারদের সব ঠিক হয়ে গেলেও বিদেশি ক্রিকেটাররা ম্যাচ না খেলার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। পরে টাকা নিয়ে গিয়ে কড়া নাড়লেও তারা দরজা খোলেননি তারা।
দেশি ক্রিকেটারদের নিয়ে গড়া একাদশ নিয়েই ম্যাচটি জেতে রাজশাহী। রাতে টিম হোটেলের উদযাপনের দেখা যায় রাজশাহীর মালিকপক্ষের একজনকে কাঁধে উল্লাস করছেন ক্রিকেটাররা। সব ভুলে যাদের নিয়ে ম্যাচ জয়ের আনন্দ উদযাপন করেন, তাদের কাছ থেকেই ফের হতাশা মিলেলো ক্রিকেটারদের। মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত কারও অ্যাকাউন্টে টাকা জমা হয়নি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ক্রিকেটার জানান, তাদের অ্যাকাউন্টে যে টাকা জমা হবে না, এটা তারা বুঝে ফেলেছেন। এ সময় তিনি দৈনিক ভাতা না পাওয়ার ব্যাপারটিও জানান।
রাজশাহীর এই ক্রিকেটার বলেন, 'আমরা আগের দফায় অনেক কষ্টে ২৫ শতাংশ টাকা পাই। এ দফায় চেক পেয়ে স্বস্তি পাচ্ছিলাম। কিন্তু চেক জমা দেওয়ার পর আবারও সেই আগের কাহিনী। আগে তো তবু কয়েকজনের চেক বাউন্স করেছিল, কারণ অনেকেই জমা দেয়নি। এবার আমরা যারা চেম জমা দিয়েছি, সবার চেক বাউন্স করেছে। কেউ টাকা পাইনি। ব্যাংক থেকে ম্যাসেজ দিয়ে জানানো হয়, টাকা আমাদের অ্যাকাউন্টে জমা হবে না। এই ম্যাসেজ দেখার পর সত্যিই আর বলার কোনো ভাষা ছিল না। কিছু বলার নাই আসলে।'
পারিশ্রমিক না পাওয়ার পাশাপাশি আরও হতাশা আছে রাজশাহীর ক্রিকেটারদের। ১৮ দিনের দৈনিক ভাতা জমে গিয়েছিল তাদের, সোমবার চারদিনের ভাতা পেয়েছেন তারা। এখনও ১৪ দিনের ভাতা বাকি। এ বিষয়ে রাজশাহীর আরেকজন ক্রিকেটার বলেন, 'এটা আমাদের রুটি-রুজি। পারিশ্রমিক তো দিচ্ছেই না, দৈনিক ভাতাও আমাদের ১৮ দিনের বাকি পড়েছিল। সেখান থেকে মাত্র চার দিনের দিয়েছে। এটা হতে পারে না। তারা ব্যবসায়ী, নিজের টাকার হিসাব ঠিকই আছে। কিন্তু আমাদের বেলায় কেন এই আচরণ, সেটা মাথায় ঢুকছে না। আমরা মাঠে আমাদের কাজ করলেও তারা তাদের কাজ করছে না। কতোবার তারা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবে, কোথায় গিয়ে থামবে, আল্লাহ জানেন।'
ক্রিকেটারদের কথাতেই স্পষ্ট, তারা কতোটা বিরক্ত। এই বিরক্তি অবশ্য আরও আগে থেকেই। প্রথম দফার ২৫ শতাংশ পারিশ্রমিক না পেয়ে চট্টগ্রামে একদিন অনুশীলন বয়কট করেন রাজশাহীর ক্রিকেটাররা। দিয়ে রাখেন ম্যাচ বয়কটের হুমকিও। চট্টগ্রাম পর্বে এমন কিছু না হলেও মিরপুরে ঠিকই দেখা গেল ম্যাচ না খেলার মতো শক্ত অবস্থান নেওয়ার মতো ব্যাপার। এরপরও অবশ্য পারিশ্রমিকের বিষয়টি মিটমাট করছে না রাজশাহী। এ কারণে শনিবার বিসিবির দুজন পরিচালক জানান, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বিষয়টির সুরাহা করার চেষ্টা করবেন তারা।
যদিও সেটা হয়নি, উল্টো পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়েছে। এমন অবস্থায় বিসিবি আরও সজাগ দৃষ্টি রাখছে বলে জানিয়েছেন বিসিবির ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের চেয়ারম্যান ও বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্য সচিব নাজমুল আবেদীন ফাহিম। মঙ্গলবার তিনি বলেন, 'এখনও যারা পারিশ্রমিক পরিশোধ করেনি, তাদের নিয়ে আলাপ হয়েছে। তারা কিছু কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আমরা যথেষ্ট ভালোভাবে তাদের বার্তা দিতে পেরেছি যে পারিশ্রমিকের প্রক্রিয়াগুলো কেমন হবে। আমাদের প্রত্যাশা কী, কতদিনের মধ্যে কী চাই, সেই সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা তাদের দিয়েছি। তারা কথা দিয়েছে, সেভাবেই তারা এগিয়ে যাবে। তবে আগে আমরা আলাপ-আলোচনার পর অপেক্ষা করতাম। একটা সময় পর দেখতাম কাজ হয়ে গেছে। তবে এখন আমরা নিয়মিত ভিত্তিতে চেক করব তারা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সেগুলো পূরণ করতে পেরেছে কিনা।'
'যারা একটু বা বেশ খানিকটা পিছিয়ে আছে, তাদের সঙ্গে বেশি আলাপ হয়েছে। তারা কীভাবে এই অচল অবস্থা পার করবে, সেটা নিয়েই কথা হয়েছে। তারা কিছু কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, আমরা সেগুলো শুনেছি। তাদেরকে আমরা কিছুটা সময় দিয়েছি প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ করার জন্য। তবে যেটা বললাম, এখন থেকে প্রায় প্রতি মুহূর্তেই তাদের ফলো করব প্রতিশ্রুতিগুলো কতোটা রাখছে। তাদের যতোটুকু সম্ভব চাপে রাখবো। ক্রিকেটাররা পারিশ্রমিক নিয়ে যেন সন্তুষ্ট থাকে, এই বিষয়টা যেন তারা নিশ্চিত করে।' যোগ করেন তিনি।
নতুন করে চেক বাউন্সের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজশাহীর ম্যানেজার ও জাতীয় দলের সাবেক ওপেনার মেহরাব হোসেন অপি বলেন, 'গেম ডেভেলপমেন্টের মিটিং ছিল। তাই সকালেই আমি মাঠে চলে এসেছি। ঘটনাটা কী, আমার জানা নেই। টিম হোটেলে গিয়ে কথা হলে আমি জানতে পারব। কোনো ক্রিকেটার আমাকে এখনও পর্যন্ত কিছু জানায়নি। যেহেতু তারা কিছু বলেনি, তাই এখন মন্তব্য করতে চাই না। আমি নিজেও এখনও পাইনি টাকা। মালিকপক্ষ আমাকে একটা তারিখ দিয়েছে। সেই দিনের অপেক্ষায় আছি। তবে অন্যান্য ক্রিকেটার বা বাকিদের ২৫ শতাংশ দেওয়া হয়েছে। গত পরশু আরও ২৫ শতাংশ অর্থের চেক দেওয়া হয়েছে।'