অনেক সাধনার ফল স্বপ্নের এই সিরিজ
স্বপ্নের রং কেমন হয়, স্বপ্ন ছোঁয়া যায়? এসব প্রশ্ন তাসকিন আহমেদের কাছে রাখা যেতে পারে। উত্তরের নিশ্চয়তা নেই, তবে বাংলাদেশের ডানহাতি এই পেসার যা বলবেন; তাতে হয়তো আশ্বস্ত হওয়া সম্ভব। ধ্বংসস্তূপ থেকে ফিনিংস পাখির মতো উড়াল দিয়ে সাফল্যের আকাশে কীভাবে লাল, নীল, বেগুনী রেখা টেনে দিতে হয়, সেটা তার চেয়ে আর কেইবা ভালো জানে!
গল্পটা অনেকেরই জানা, এই তাসকিনকে দলে নেওয়ায় অনেকে সমালোচনার ঝড় তুলতেন। আলো ছড়াতে না পেরে বাদ পড়তে হতো প্রায়ই। সেই তাসকিনই এখন জাতীয় দলের পেস আক্রমণের প্রাণ। দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে ওয়ানডে সিরিজ জয়ের নায়ক তিনি, তৃতীয় ম্যাচে আগুনে বোলিংয়ে ৫ উইকেট নিয়ে ম্যাচ সেরা। ৩ ম্যাচে ৮ উইকেটে সিরিজও সেরাও বাংলাদেশের এই গতি তারকা। যা তার ক্যারিয়ারে প্রথম।
স্বপ্নের এক সিরিজ, এক ম্যাচের পর সেরা হওয়ার দুটি ট্রফি হাতে উচ্ছ্বাসের ভাষাই যেন হারিয়ে ফেলছিলেন তাসকিন। স্বপ্নের এই সিরিজের দেখা এমনিতেই মিলে যায়নি, অনেক সাধনা করতে হয়েছে তাসকিনকে। বছর দুই-আড়াই আগেই হারিয়ে যেতে বসেছিলেন তিনি, কোথাও ছিল না তার নাম। ২০১৯ বিশ্বকাপের দলের জায়গা না পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তাসকিন। বিষাদে মুষড়ে পড়া এই পেসার কিছুতেই আলোর পথ খুঁজে পাচ্ছিলেন না।
একটা সময়ে এসে তাসকিনের মনে হয় মনে হয়, 'নিজেকে নতুন করে গড়ে তুলতে হবে।' করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরুর পরপরই মিশনে নেমে পড়েন তাসকিন আহমেদ। ফিটনেস নিয়ে কঠিন খাটুনি খেটে নিজেকে দেন নতুন রূপ। বল হাতেও নিজেকে বদলে ফেলেন, দেখা মেলে অন্য এক তাসকিনের। যেন তারই দ্বিতীয় 'ভার্সন'।
২০২১ সালে শ্রীলঙ্কা সফরে গিয়ে টেস্ট সিরিজে তিনি বুঝিয়ে দেন নিজেকে কতোটা বদলেছেন। সাড়ে তিন বছর পর টেস্টে সুযোগ পেয়ে ক্যান্ডির নিষ্প্রাণ উইকেটেও মাপা লাইন-লেংন্থে গতির ঝড় তুলে তাসকিন যেভাবে লঙ্কান ব্যাটসম্যানদের ভোগান, বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসে তা রীতিমতো উদাহরণযোগ্য। এর পর নতুন পথচলা। নিয়মিত টেস্ট এবং ওয়ানডে খেলে আসছেন তিনি। ডাক মেলে টি-টোয়েন্টিতেও।
দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যাওয়ার আগে তাসকিন বলেছিলেন, 'সব সময় প্রক্রিয়ায় মনোযোগটা বেশি থাকে। আমি ভালো খেলি, খারাপ খেলি, নিজের প্রক্রিয়াটা ধরে রাখা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ স্বপ্ন অনেক বড়, আমি বিশ্বের সেরা বোলার হতে চাই। এ জন্য সব সময় নিজের ফিটনেস ও বোলিং যেন উন্নতি হয়, সেদিকে মনোযোগ দিচ্ছি।' কে জানে, বিশ্বসেরা হওয়ার যাত্রাটা দক্ষিণ আফ্রিকা থেকেই শুরু হলো তার।
প্রোটিয়াদের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডেতে ৩৮ রানের জয়ে বড় অবদান ছিল তাসকিনের। ১০ ওভারে ৩৬ রানে ৩ উইকেট নেন তিনি। দ্বিতীয় ওয়ানডেটা ভালো যায়নি, ৪ ওভারে ৪১ রান খরচায় থাকেন উইকেটশূন্য। ঘুরে দাঁড়াতে সময় নেননি, সিরিজ জয়ের মিশনে একাই ধসিয়ে দেন প্রোটিয়াদের ব্যাটিং লাইন আপ। ৯ ওভারে আগুন ঝড়া বোলিংয়ে ৩৫ রানে নেন ৫টি উইকেট। যা বিদেশের মাটিতে তার ক্যারিয়ার সেরা বোলিং।
বাংলাদেশের প্রথম বোলার হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকায় ওয়ানডেতে ৫ উইকেট নেওয়ার কীর্তি গড়েন তাসকিন। বাংলাদেশের তৃতীয় পেসার হিসেবে বিদেশের মাটিতে ৫ উইকেট ঝুলিতে উঠলো তার। তাসকিনের আগে মাশরাফি বিন মুর্তজা ও জিয়াউর রহমানের এই কীর্তি ছিল। এ ছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে শেষ ১০ বছরে বিদেশিদের মধ্যে প্রথম বোলার হিসেবে ওয়ানডেতে ৫ উইকেট নেন তাসকিন। তার আগে ২০১২ সালে সর্বশেষ ৫ উইকেট নিয়েছিলেন শ্রীলঙ্কার কিংবদন্তি পেসার লাসিথ মালিঙ্গা।
স্বপ্নের এক সিরিজ শেষে আনন্দের সীমা নেই তাসকিনের, 'খুবই খুশি ও গর্বিতবোধ করছি। এই প্রথম আমি সিরিজ সেরার পুরস্কার পেলাম। গেল দেড় বছর ধরে আমি একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করছি। প্রত্যেক ম্যাচেই আমার অধিনায়ক আমাকে সমর্থন করেছেন। আমার কাজ বুঝিয়ে দিয়েছেন। পরিস্কারভাবে বলে দিয়েছেন ফাস্ট ও আক্রমণাত্মক থেকে উইকেট তুলে নিতে। এখানে আমি বোলিংটা বেশ উপভোগ করেছি। আমাকে এখনও শিখতে হবে যে ফ্ল্যাট উইকেটে কিভাবে ৫ উইকেট নেওয়া যায়।'