কোভিডে গুরুতর অসুস্থরা স্থায়ীভাবে শ্রবণশক্তি হারাতে পারে: গবেষণা
কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ার পর স্বাদ ও গন্ধের অনুভূতি হারানোর বিষয়টি এখন প্রমাণিত। পাশাপাশি শ্রবণশক্তিও হারাতে পারেন গুরুতর অসুস্থ ব্যক্তি। হঠাৎ করেই এ সমস্যা দেখা দিতে পারে এবং সঙ্গে সঙ্গেই চিকিৎসা করা না হলে, স্থায়ীভাবে বধির হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
ইতোপূর্বে, অনেক চিকিৎসক রোগীদের কানে শোনার ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার বিষয়টি রিপোর্ট করছেন। এবিষয়ে গবেষণায় জড়িতরা অন্য চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণের সত্যতা খুঁজে পেয়েছেন।
ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল- বিএমজে কেস রিপোর্টস প্রকাশ করে ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডন- এর বিশেষজ্ঞ দলটির গবেষণা।
নিবন্ধে আগে থেকেই অ্যাজমা আক্রান্ত ৪৫ বছরের এক কোভিড রোগীর উদাহরণ তুলে ধরা হয়। ওই ব্যক্তি কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ার পর তার অবস্থার মারাত্মক অবনতি হয়েছিল। পরবর্তীতে তাকে হাসপাতালের আইসিইউ'তে ভর্তি করা হয়। জীবন বাঁচাতে তাকে ভেন্টিলেটরে রাখা হয়। এবং দেওয়া হয়েছিল জীবাণুনাশক রেমডেসিভির এবং বেশ কিছু স্টেরয়েড জাতীয় হরমোন।
চিকিৎসকদের আপ্রাণ চেষ্টায় সে যাত্রা প্রাণে বেঁচে যান ওই ব্যক্তি। এক সপ্তাহ পরই মুক্তি পান আইসিইউ থেকে। তবে এরপর থেকে দুই কানে শব্দের টানা প্রতিধ্বনি শুনতে থাকেন এবং এক পর্যায়ে বাম কানে শোনার ক্ষমতা পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেন।
গবেষক দল জানান, আগে থেকেই ওই ব্যক্তির কানে কোনো সমস্যা ছিল না এবং তার কানের পর্দাও ছিল সম্পূর্ণ অক্ষত। তাকে এমন কোনো ওষুধও দেওয়া হয়নি, যা শ্রবণশক্তি হ্রাসে প্রভাব ফেলতে পারে। চিকিৎসকরা তাই কারণ অনুসন্ধানে আরও উৎসাহী হয়ে ওঠেন।
অনেক সময় ওষুধের কোনো উপাদান শরীর গ্রহণ করতে পারে না। ওই ব্যক্তির দেহে তেমন সমস্যা ছিল না। ফ্লু বা এইচআইভি'র মতো যেসব রোগে শ্রবণশক্তি হারাতে পারে, রোগীটি সেসব থেকেও মুক্ত ছিলেন। সারা জীবনে ওই ব্যক্তি কোনোদিন শ্রবণশক্তি নিয়ে কোনো সমস্যার শিকার হননি।
আরও পরীক্ষার পর দেখা যায়, রোগীর বাম কানের শব্দ সংবেদনশীল স্নায়ুতে প্রদাহ দেখা দিয়েছে। স্টেরয়েড জাতীয় হরমোন প্রয়োগে তা কিছুটা সারিয়ে তোলা সম্ভব হয়।
করোনা জনিত অসুখে শ্রবণ ক্ষমতা হারানো নিয়ে- এটাই যুক্তরাজ্যের প্রথম কেস রিপোর্ট। তবে অন্যান্য কয়েকটি দেশে অল্প সংখ্যক হলেও, এমন ঘটনার কথা জানা গেছে।
গবেষণার সহ-লেখক ডা. স্টেফানিয়া কৌম্পা জানান, কোভিড ঠিক কীভাবে শ্রবণশক্তি কেড়ে নিচ্ছে- তা জানা না থাকলেও, এর সম্ভাব্যতা ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।
''সার্স কোভ-২ ভাইরাস কানে প্রবেশ করে শব্দ সংবেদনশীল স্নায়ুকোষের মৃত্যু ঘটাতে পারে। অথবা জীবাণুটি সেখানকার কোষে ইনফেকশন সৃষ্টি করলে তার ফলে প্রদাহ সৃষ্টিকারী রাসায়নিক- সিটকিনস নিঃসৃত হতে পারে। সিটকিনস অত্যন্ত তেজস্ক্রিয় ধরনের জৈব-রাসায়নিক উপাদান হওয়ার এর ফলে কানের অভ্যন্তরে ক্ষতি হয়'' তিনি বলছিলেন।
''এজন্যই স্টেরয়েড প্রয়োগে আংশিক সফলতা পাওয়া গেছে। কারণ এধরনের হরমোন কোষে প্রদাহের মাত্রা কমায় এবং তার মাধ্যমে সিটকিনস নিঃসরণের মাত্রাও হ্রাস করে'' কৌম্পা যোগ করেন।
গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে যাদের ভর্তি হতে হয়েছে, তাদের কেউ কেউ শ্রবণশক্তি হারিয়েছেন কিনা- তা পরীক্ষা করে দেখার আহ্বান জানিয়েছে গবেষক দলটি। পাশাপাশি এমন ঘটনা দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে জরুরি চিকিৎসা দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
এব্যাপারে কৌম্পা বলেন, ''কেউ যদি শুধু এক কানে শোনার ক্ষমতা হারান, সেটাও তার জীবন-যাপনে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। অবশ্যই এ সমস্যা নিরাময়ের তাৎক্ষনিক উদ্যোগ থাকা উচিৎ।''
ম্যানচেষ্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিওলজি বা শ্রবণবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কেভিন মুনরো এ গবেষণায় জড়িত ছিলেন। তিনি জানান, হাম ও মাম্পসের জীবাণু শ্রবণশক্তি কমাতে পারে- তা আগে থেকেই জানা ছিল কিন্তু, এখন কোভিড থেকে সেরে ওঠাদের অনেকেই আমার সঙ্গে তাদের বধিরতার সমস্যা উল্লেখ করে যোগাযোগ করেছেন।
এমন ১২১ জন ব্যক্তিদের মধ্যে এক জরিপ পরিচালনা করেন তিনি। দেখা যায়, এদের মধ্যে ১৬ জন কোভিড আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। কোভিড মুক্ত হয়ে সেখান থেকে ছাড়া পাওয়ার কমবেশি দুই মাস পর- তারা শ্রবণশক্তি হারানোর কথা জানিয়েছেন।
কোভিড মুক্তি এবং কানে না শুনতে পাওয়ার এই সমস্যা নিয়ে তার গবেষণা দলটি আরও অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে, বলে মুনরো নিশ্চিত করেছেন। বিশেষ করে, কোভিড-১৯ অসুস্থতা নাকি ভাইরাস এ অবস্থা সৃষ্টির জন্য দায়ী, সেটাই তারা খতিয়ে দেখছেন। পাশপাশি বাদ দেওয়া হচ্ছে না রোগীর দুর্বল শারীরিক অবস্থা বা ওষুধ প্রয়োগের প্রভাবও।
- সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান