চীনের সামরিক শক্তি ভারতের চেয়ে বেশি- কতটা সত্যি?
লাদাখ সীমান্তে চীন-ভারত সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত ২৩ জন ভারতীয় সেনা নিহত ও শতাধিক গুরুতর আহত হয়েছে বলে খবর জানা গেছে।
অপরদিকে এই সংঘর্ষে চীনের কতজন সেনা নিহত হয়েছে, তা এখনো স্পষ্ট জানা যায়নি।
ঘটনার সূত্রপাত গত সোমবার রাতে। লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় দুই পক্ষ হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়ে বলে জানা গিয়েছে। এক পক্ষ অন্যপক্ষকে লক্ষ্য করে পাথরও ছুঁড়তে থাকে। ঘটনায় প্রাথমিক ভাবে বেশ কিছু সৈন্য আহত হন। পরে দুই পক্ষের বেশ কিছু সেনার মৃত্যু হয়।
বিষয়টি নিয়ে লাদাখ সীমান্তেই উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে বসেছেন দুই দেশের সেনা কর্তারা।
যে জায়গায় হাতাহাতি হয়েছে, সেখানেই দিন কয়েক আগে দুই সেনার কম্যান্ডাররা বৈঠক করেছিলেন। ভারতীয় এক সেনা অফিসার বলেছেন, ''চীন সম্ভবত পরিকল্পনামাফিক এই কাজ করেনি। কিন্তু তাঁরা ভাবতে পারেননি, ভারতীয় জওয়ানরা নিজেদের এলাকা রক্ষার জন্য এইভাবে ঝাঁপিয়ে।
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, এর ফলে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা ফের বৃদ্ধি পাবে।
কেন এই সংঘাত
লাদাখ সীমান্তের একটি বড় অংশে মানুষ বসবাস করে না। এই ভৌগোলিক অঞ্চলকে মূলত আকসাই চীন বলা হয়। ভারত মনে করে আকসাই চীন তাদের অংশ। চীন মনে করে আকসাই চীন তাদের। ১৯৬২ সালের যুদ্ধের পরে যাদের সেনা যেখানে ছিল, সেটাকেই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু দুই দেশই নিজেদের এলাকা বাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করে।
গালওয়ানের খুব কাছ দিয়ে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বা ডি-ফ্যাক্টো গিয়েছে। চীন তিব্বতের উপর দিয়ে পাকিস্তান পর্যন্ত একটি হাইওয়ে তৈরি করেছে। যাকে কারাকোরাম হাইওয়ে বলা হয়। ভারতের অভিযোগ, ওই হাইওয়ের জন্যই লাদাখের একটি অংশের দখল নিতে চায় চীন। তা করতে পারলে আরও সহজ একটি বাইপাস রাস্তা তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু ভারত তা হতে দিতে চায় না। গালওয়ান সমস্যার মূল কারণ এটিই।
এই বিরোধ মূলত শুরু হয়েছিল ১৮০০ শতক থেকে। তখন ব্রিটিশ, রাশিয়ান আর চীনা উপনিবেশের পারস্পরিক ক্ষমতার বলে এই অঞ্চলটি দখল করতে চায় তারা। পরবর্তীতে উপনিবেশিক শাসনের অবসানের পর ব্যাপারটা অমিমাংসিতই থেকে যায়।
কাশ্মীর উপত্যকার পূর্বে একটি দুর্গম, পাহাড়ী অঞ্চল লাদাখ। এর অংশ দাবি করে ভারত। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগ হয়ে গেলে জম্মু-কাশ্মীর নিয়ে সংঘাত বাড়ে পাকিস্তানের সঙ্গেও।
আজ থেকে ছয় দশক আগে ১৯৬২ সালে একই অঞ্চল নিয়ে যুদ্ধ হয়েছিল দু'দেশের মধ্যে। একমাসব্যাপী সে যুদ্ধে আকসাই চিনের ডি-ফ্যাক্টো অঞ্চল জয় করে নেয় চীন। এরপরই যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে চীন। এই যুদ্ধে প্রায় ৭০০ চীনা সেনা আর দ্বিগুণ ভারতীয় সেনার প্রাণহানি হয়েছিল।
১৯৬২ সালের যুদ্ধের পরে ভারত এবং চীনের মধ্যে এ ধরনের সংঘর্ষ হয়নি। প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেনি।
তবে হিমালয়ের এই যে অংশটা নিয়ে আজ দুইদেশের সামরিক বাহিনী মুখোমুখি হয়েছে তা ৫৮ বছর আগের সেই লড়াইয়ের চেয়ে অনেক বেশি আলাদা।
ভারতের শক্তি বনাম চীনের শক্তি
অনেকেই ধারণা করছেন, ভারতের চেয়ে চীনের সামরিক শক্তি বেশি, তাই ভারতের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে চীন। কিন্তু বোস্টনের হার্ভার্ড কেনেডি স্কুল অফ গভর্নমেন্টের বেলফার সেন্টার এবং ওয়াশিংটনের সেন্টার ফর নিউ আমেরিকান সিকিউরিটির সাম্প্রতিক গবেষণায় একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে এসেছে। ভারত তুলনামূলকভাবে চীনের চেয়ে উচ্চতর পাহাড়ী অঞ্চলে অবস্থিত। আর এমনই এক অবস্থানে ২০২০ সালের যুদ্ধটা হচ্ছে।
ভারতীয় বাহিনী খাড়া উপত্যকায় রুক্ষ ভূখণ্ডে অবস্থান নিয়েছে। ফলে যে কোনও চীনা আক্রমণ হলে সহজেই সেখান থেকে সরে যেতে পারবে না তারা। তার মানে যেকোন সময়ে চীনা আর্টিলারি আর ক্ষেপণাস্ত্র হামলার শিকার হতে পারে ভারতীয় সেনারা।
অন্য আরেকটি দিক থেকে চীনা সৈন্যরা ভারতীদের কাছ থেকে এগিয়ে আছে। নতুন প্রযুক্তি আর আধুনিক সমরাস্ত্র। চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, এই আধুনিক অস্ত্রগুলোর নকশা করা হয়েছে উপত্যকা আর উঁচু পাহাড়ি অঞ্চলের জন্য।
এছাড়াও চীনের অর্থনীতি ভারতের পাঁচ গুণ। সামরিক খাতে চীন যে পরিমাণ খরচ করে, ভারত করে তার চারভাগের এক ভাগ।
এই সবকিছু বিবেচনা করে চীনকে ভারতের চেয়ে বেশি শক্তিশালী বলে মনে করা হলেও, বেশকয়েকটি ক্ষেত্রে ভারতও সুবিধাজনক অবস্থানে আছে।
পারমাণবিক অস্ত্র
পারমাণবিক যুদ্ধ পৃথিবীর যুদ্ধপরিস্থিতি নিয়ে অভ্যস্ত বিশ্ববাসীর কাছে নতুন কিছু নয়। তবে এটা লক্ষ্য রাখা জরুরি, চীন ও ভারত দুদেশের কাছেই পারমাণবিক অস্ত্র আছে। চীন ১৯৬৪ সালে আর ভারত ১৯৭৪ সালে পারমাণবিক শক্তিধর দেশের কাতারে নাম লেখায়।
স্টকহোম আন্তর্জাতিক শান্তি গবেষণা ইনস্টিটিউট (এসআইআরপিআই) প্রকাশিত একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চীনের প্রায় ৩২০টি পারমাণবিক অস্ত্র আছে- ভারতের ১৫০টিরও দ্বিগুণ। উভয় দেশই তাদের অস্ত্রাগার গত বছরের তুলনায় বাড়িয়েছে। এসআইআরপিআই এর তথ্য অনুসারে, নতুন সমরাস্ত্র হিসেবে বেইজিংয়ের ৪০টি ও নয়াদিল্লির ১০টি যুক্ত হয়েছে।
উভয় দেশেরই মিসাইল, বোমারু বিমান এবং সাবমেরিন আছে। দুদেশই "প্রথম ব্যবহারের নীতি" মেনে চলে, অর্থাৎ যদি একপক্ষ আগে ব্যবহার করে তবেই অন্যপক্ষ ব্যবহার করবে।
বিমান বাহিনী
বেলফার সেন্টারের মার্চ মাসে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, চীনের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য ভারতে প্রায় ২৭০ যোদ্ধা এবং ৬৮টি যুদ্ধবিমান বিমান তৈরি আছে।
ফ্র্যাঙ্ক ওডনেল ও আলেকজান্ডার বোলফ্রাসের লেখা বেলফার সমীক্ষা দাবি করেছে যে, এমনকি চীনা সীমান্তের কাছাকাছি ছোট ছোট কয়েকটি বিমান ঘাঁটিও বজায় রেখেছে ভারত, যাতে যুদ্ধের সময় সেখান থেকে প্রয়োজনমতো বিমান সরবরাহ করতে পারে তারা।
এর বিপরীতে চীনের ১৫৭ জন যোদ্ধা ও এই অঞ্চলে স্থল-আক্রমণের জন্য একটি ছোট বিমানবহর রয়েছে। বেলফার সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, দেশটির পিপলস লিবারেশন আর্মি এয়ার ফোর্স (পিএলএএফ) এই অঞ্চলে আটটি ঘাঁটি ব্যবহার করেছে, তবে এর বেশিরভাগই বেসামরিক বিমান ক্ষেত্র।
গবেষণা সমীক্ষাটিতে আরও বলা হয়, তিব্বত ও জিনজিয়াংয়ের চীনা বিমান ঘাঁটিগুলির বেশ উঁচুতে অবস্থিত। এর পাশাপাশি আছে অঞ্চলটির অসুবিধাজনক ভৌগলিক ও আবহাওয়ার পরিস্থিতি। এর অর্থ চীনা যোদ্ধারা তাদের যুদ্ধ নকশা আর পরিকল্পনামাফিক প্রয়োজনীয় রসদ আর জ্বালানির অর্ধেক মাত্র নিয়ে আসতে পারবে এখানে।
অন্যদিকে ভারতীয় বিমান বাহিনী চীনের কথা মাথায় রেখেই এই অঞ্চলে অবকাঠামো উন্নয়নের দিকে নজর দিয়েছে। তৈরি করেছে সৈন্যদের থাকার বেস, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা আর মজবুত আকাশ সুরক্ষা।
স্থল বাহিনী
আকাশের যুদ্ধে ভারত পারদর্শী হলেও সিএনএএসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কাশ্মীরের মতো জায়গাগুলোতে এবং পাকিস্তানের সীমান্তে লড়াই করতে স্থলবাহিনীকেও মোতায়েন করেছে দেশটি।
সিএনএএসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, "গত কয়েক দশকে বেশকয়েকটি সীমিত আকারের ও মাঝারি-তীব্র যুদ্ধ করেছে। অন্যদিকে ১৯৭৯ সালে ভিয়েতনামের সঙ্গে যুদ্ধের পর চীন আর কোন যুদ্ধ করেনি। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে যুদ্ধের অভিজ্ঞতার দিক থেকেও এগিয়ে আছে ভারত।
মিত্রপক্ষ
হিমালয়ের এই অঞ্চলে ভারতের বিপক্ষে যুধহ করতে চীন হয়তো আঁটসাঁট বেঁধেই তৈরি হচ্ছে। কিন্তু শুধু সামরিক দিক থেকেই নয়, কূটনীতিক দিক থেকেও শক্তিশালী হওয়ার পরিকল্পনা করছে ভারত। গত কয়েক বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করছে ভারত।
এছাড়াও জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে যৌথ সামরিক প্রশিক্ষণের অভিজ্ঞতা আছে ভারতের।
অন্যদিকে পাকিস্তান ও রাশিয়ার সঙ্গে চীনের সামরিক সম্পর্ক থাকলেও যুদ্ধক্ষেত্রে পাশাপাশি সামরিক প্রশিক্ষণের অভিজ্ঞতা নেই চীনের।
যদিও সোমবার এই সংঘাতের পর চলমান উত্তেজনা প্রশমনে একমত হয়েছে দুই দেশই। বুধবার (১৭ জুন) ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ফোনালাপের পর এ কথা জানায় বেইজিং।
এক বিবৃতিতে জানানো হয়, দুপক্ষই লাদাখে শান্তি চায়। আগামীতে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেই কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানানো হয়। একই সঙ্গে সংঘাতে জড়িতদের কঠোর শাস্তি দিতে ভারতের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, এই সংঘাত আসলে কোন দিকে গড়াবে?
চীন ও ভারতের মাঝে বেশ শক্তিশালী বাণিজ্যিক সম্পর্ক আছে। আর এখন ভারতের সঙ্গে কোন সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার অর্থ হলো এই অঞ্চলে ইন্দো-মার্কিন জোট তৈরি হওয়া। চীন সেই ঝুঁকি এখন নিতে চাইবে না। তাই অনুমান করে নেওয়া যায়, হয়তো দুইপক্ষই সংঘাত এড়িয়ে যেতে চাইবে।