তর্কের সময় আমরা চিৎকার কেন করি?
যেকোনো আলোচনা বা বিতর্কে কারও না কারও গলা উঁচু করা একটি প্রাত্যহিক ঘটনা। প্রায় সব রকমের রাজনৈতিক আলোচনাই এখন শেষ হয় চিৎকার-চেঁচামেচির মধ্যে দিয়ে।
যদিও সবাই ভালোভাবেই জানি, চিৎকার-চেঁচামেচি করে তর্কে জেতা যায় না এবং কোনো অবস্থাতেই চিৎকার-চেঁচামেচি ইতিবাচক ফলাফল আনে না, তবু কেন গলা উঁচু করি আমরা? নতুন গবেষণায় মিলেছে এর উত্তর। আত্মবিশ্বাসের অভাবই নাকি এর পেছনে কলকাঠি নাড়ে!
গবেষণা বলছে, ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বাড়তি আত্মবিশ্বাসী হলেও প্রতিবেশী, বন্ধু বা প্রতিপক্ষের ওপর আমরা তখনই চিৎকার করি, যখন তাদের বোঝানোর ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি চলে আসে আমাদের।
দীর্ঘদিন ধরে গবেষকরা মানুষের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের ব্যাপারটিই নতুন নতুন গবেষণায় প্রমাণ করে আসছিলেন।
যেমন ধরুন, ২০০২ সালে স্ট্যানফোর্ডে গবেষকদের একটি দল তিনটি ভিন্ন সমীক্ষায় দেখেন, অংশগ্রহণকারীরা নিজেদের সমবয়সী ও 'সাধারণ মানুষের' তুলনায় যেকোনো যুক্তিতে কম পক্ষপাতদুষ্ট বলে মনে করেন। ফলো-আপে উত্তরদাতাদের নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি কীভাবে পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে, সেই ব্যাখ্যা শোনানো হলেও তারা নিজেদের দাবিতে অটল থাকেন।
এই পদ্ধতিতে করা আরও অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, গড়পড়তা মানুষ নিজেদেরকে নীতি, সৃজনশীলতা, খেলাধুলাসহ অসংখ্য বিষয়ে 'সাধারণ মানুষের' চেয়ে শ্রেয় বলে মনে করে, যেটা গাণিতিকভাবে অসম্ভব।
তবে এসব গবেষণার বিপরীতে, নিজেদের সামাজিক দক্ষতা- যেমন, বন্ধুদের বোঝানো এবং মানুষকে প্রভাবিত করার মতো ব্যাপারে আমাদের ধারণা কী, এই শীর্ষক এক সাম্প্রতিক গবেষণায় সম্পূর্ণ ভিন্ন ফল উঠে এসেছে।
জার্নাল অব পার্সোনালিটি অ্যান্ড সোশ্যাল সাইকোলজিতে প্রকাশিত ২০১৭ সালের এক গবেষণা অংশগ্রহণকারীদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, সাধারণ মানুষের তুলনায় তাদের বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যা বেশি কি না, তাদের সামাজিক বলয় বাকিদের চেয়ে বড় কি না, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের গড়ের চেয়ে বেশি ফলোয়ার আছে কি না। সমাজ-বহির্ভূত প্রশ্নগুলোয় (যেমন, সাধারণ মানুষের তুলনায় তাদের শব্দজ্ঞান বেশি কি না) অংশগ্রহণকারীরা ব্যাপক আত্মবিশ্বাস দেখালেও, সামাজিক ব্যাপারগুলোয় তাদের আত্মবিশ্বাসে বেশ ঘাটতি ছিল। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সিংহভাগই বিশ্বাস করেন, সাধারণ মানুষের তুলনায় তাদের বন্ধু কম, তাদের সামাজিক বলয় ছোট এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের ফলোয়ার কম।
গত পাঁচ বছরে এই বিষয়ে একাধিক গবেষণায় প্রায় একই রকম ফলাফল উঠে এসেছে: মানুষ তার সামাজিক দক্ষতা নিয়ে কম আত্মবিশ্বাসী। উদাহরণস্বরূপ, কোনো সামাজিক বলয় থেকে মাত্রই বেড়িয়ে আসা লোকদের নিয়ে হওয়া এক গবেষণায় প্রায় সব অংশগ্রহণকারীই জানিয়েছেন, তারা যে পরিমাণ আগ্রহ দেখিয়েছেন, সেই তুলনায় আশেপাশের লোকজন তাদের ব্যাপারে কম আগ্রহী ছিল।
একজন অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে সংক্ষিপ্ত আলাপ করানোর পর অংশগ্রহণকারীদের জিজ্ঞেস করা হলে তারা জানান, অপর ব্যক্তিটি তাদের যতটা পছন্দ করেছেন বলে জানিয়েছেন, আদতে তারচেয়ে কম পছন্দ করেছেন।
এ দুটি আপাতদৃষ্টিতে পরস্পরবিরোধী ব্যাপার হলেও প্রকৃতপক্ষে পরিপূরক। অনুসন্ধানের ফলাফলগুলোকে এক করলেই আমরা বুঝতে পারব, কীসের তাড়নায় চিৎকার করে মানুষ।
অন্যদের তুলনায় নিজেদেরকে বেশি নৈতিক এবং কম পক্ষপাতদুষ্ট ভাবায় আমরা ব্যক্তিগত বিশ্বাসে আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠি। আবার একই সময়ে, আমরা ধরে নিই অন্যরা আমাদের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে না এবং কথা ঠিকমতো শুনছে না। যে কারণে অন্যদের বোঝানোর ক্ষমতা ও নিজের মতামত প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে আমাদের আত্মবিশ্বাস কমে যায়। সোজা কথায়, আমরা চিৎকার করি; কারণ ভাবি, আমরা পাওয়ার ওপর কথা বলছিলাম!
আত্মবিশ্বাসের ঘাটতিই আমাদের জোরাল ভাষা ব্যবহার করতে উদ্বুদ্ধ করে। কিন্তু কাউকে বোঝানো বা নিজের অভিমত প্রতিষ্ঠা করার বেলায় জোরাল ভাষার ব্যবহার সাধারণত হীতে বিপরীত ফল আনে। এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আমাদের আরও হতাশ করে তোলে। এই হতাশা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চিৎকার-চেঁচামেচির স্বরও জোরাল হতে থাকে।
মানুষকে বোঝানো ও সামাজিক প্রভাবের ব্যাপারে কয়েক দশকের গবেষণা বলছে, কেউ আমাদের কথা শুনছে না- এমন ভাবনা থেকেই আমরা চিৎকার করি। যে কারণে মতামত প্রকাশের বেলায় আমরা বেশি জোরে কথা বলি।
গবেষণা আরও বলছে, আমরা যদি একটু নরমভাবে কথা বলি, তাহলে আমাদের যুক্তি, উপদেশ ও আবেদনগুলো আরও বেশি কার্যকর হবে।
-
সূত্র: দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল