তুর্কি কোরমা যেভাবে এ দেশে এলো
ভারতীয় উপমহাদেশের তরকারির রাজা হলো 'কোরমা'। তুর্কি শব্দ 'কাভিরমা' থেকে শব্দটির উৎপত্তি, যা মূলত খাবারকে ভেজে কম আঁচে ধীরে ধীরে রান্না করার একটা পদ্ধতি। পরবর্তীতে ফারসি, আরবি ও উর্দুতে পারিভাষিক শব্দ হিসেবে 'কোরমা' শব্দটি জুড়ে যায়।
তুর্কি খাবার কাভুরমাও এই কাভিরমা থেকেই এসেছে। মাংস ভেজে মশলা মাখা ঝোলে ধীরে ধীরে রান্না করা থালার নামই মূলত কাভুরমা। এর সঙ্গে আজারবাইজানের 'কোভুরমা'-কে মিলিয়ে ফেললে কিন্তু ভুল হবে। এই খাবারে মাংসের সঙ্গে শুকনো বাদাম, টকযুক্ত আঙ্গুরের রস (ভার্জুইস) এবং কখনও কখনও শাকসবজিও যোগ করা হয়। অন্যদিকে আজারবাইজানের কোভুরমা মূলত শুকনো মাংসের একটা স্টু, যেখানে সংরক্ষিত শুকনো মাংসের টুকরা বা মাংসের কিমা ব্যবহার করা হয়, আর পোলাও বা দইয়ের সঙ্গে পরিবেশন করা হয়।
তুর্কি কাভুরমার আবার কয়েক প্রকার আছে। যেমন সবজি কাভুরমা, ভেড়ার মাংস আর সুগন্ধী ভেষজ পাতা দিয়ে রান্না করা 'ল্যাম্ব স্টু'। এই প্রকারের কাভুরমাটি মূলত পারস্য আর তুরস্কের রান্নার মিশ্রণে তৈরি।
আজারবাইজানের তুরসু কোভুরমা রান্না হয় ভেড়ার মাংসের সঙ্গে সংরক্ষিত লেবু আর শুকনো এপ্রিকট দিয়ে। এর সঙ্গে সুগন্ধ আর রঙের জন্য হলুদ গুঁড়া ব্যবহার করা হয়। আর নূর কোভুরমা রান্না হয় ডালিমের রসে ভেড়ার মাংস জারিয়ে।
অন্যদিকে পারস্যের খাবারের তালিকায় আছে খোরেশ, খোরমেহ বা গোরমেহ। মাংসের এক প্রকারের পদ বা কোরমা যা রান্না হয় সবজি, সুগন্ধী ভেষজ পাতা আর রেড কিডনি বিনস দিয়ে। ইরানিরা তাদের এই খাবারে দই আর কাঠবাদামও ব্যবহার করে। এর স্বাদ কিন্তু খুব বেশি ঝাঁঝাঁলো নয়, বরং বেশ মৃদু। তবে ঝোলটা বেশ ঘন হয়, ঘন করে জ্বাল দেয়া দুধের ঘনত্বের মতো প্রায়। খোরেশ বা খোরমেহ এর স্বাদ আসে ব্যবহৃত মশলা আর ভেষজ সুগন্ধী থেকে।
সীমান্ত পেরিয়ে গেলেই আফগানিস্তান। আফগানদের এই মাংসের পদের নাম হয়ে গেছে 'কোরমেহ'। এখানে এসে এর স্বাদও পালটে গেছে কিছুটা। লিমু ওমানি বা শুকনো লেবু যোগ করা হয় বলে এর স্বাদ কিছুটা টক। কিছু কিছু পুরানো রেসিপিতে লেবুর রসও ব্যবহার করার কথা বলা আছে।
কোন খাবার আসলে কখন কেমন করে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে গেছে তার ঠিকঠাক ইতিহাস খুঁজে বের করা মুশকিল। তবে ধারণা করা হয় আনুমানিক ১৮ শতকের দিকে পারস্য থেকে মোঘল রান্নাঘরে প্রবেশ করেছে কোরমা আর এর সঙ্গে প্রস্তুৎ প্রণালীতে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন মশলা, দই, কাঠবাদাম, রসুন ও অন্যান্য উপকরণ। এর ফলেই কোরমার একটা ঘন ঝোল এসেছে ভারতীয় উপমহাদেশের কোরমায়। আর যে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণটি যুক্ত হয়েছে তা হলো- পেঁয়াজ। এখনও উপমহাদেশের ধ্রুপদী কোরমার যে রেসিপি পাওয়া যায় সেখানে অন্যান্য উপকরণের সঙ্গে পেঁয়াজ থাকবেই- তা সে কেটে বা ভেজে বেরেস্তা করে হোক।
অর্থাৎ কোরমা হলো মাংস রান্নার একটা পদ্ধতি যেখানে প্রথমে খুব চড়া আঁচে মাংস ভেজে তারপর একেবারে কম আঁচে বিভিন্ন উপকরণের সঙ্গে রান্না হয়। ভারতীয় উপমহাদেশের রান্নার প্রণালিতে এই পদ্ধতিকে বলা হয় 'দমপোক্ত', অর্থাৎ কম আঁচে মুখ-বন্ধ পাতিলে দমে রান্না করা।
খাবার নিয়ে লেখালেখি করেন এমন অনেকেই মনে করেন, পারস্যের খোরমেহই ভারতের নান রকমের মশলার সংমিশ্রণে এসে আজকের 'কোরমা'র রূপ পেয়েছে। আর এই 'ফিউশন' ঘটেছে রাজপুত রাঁধুনী আর মোঘল রান্নাঘরের কর্তা মীর বাকরাওয়াল এর হাত ধরে। এমনকি এও বলা হয় যে, রাজপুতদের একটি গোষ্ঠী 'কুরমা' এর নাম অনুসারে মাংসের এই পদের নামকরণ হয়েছে। যদিও এই বক্তব্যের সত্যতা কতটুকু জানা যায় নয়া। কেননা 'আইন-ই-আকবরি' বা 'নকশা-ই-শাহজাহানি'তে মোঘল খাবারের বর্ণনায় কোরমা বা এই ব্যাখ্যা কোথাও পাওয়া যায়নি।
যদিও কালিয়া নামটি সেসসময়কার খাবারের তালিকায় পাওয়া যায়। ফুড হিস্টোরিয়ান নেহা ভারমানি বলেন, 'মোঘল রান্নাঘরে কোরমা'র উপস্থিতি পাওয়া যায় অনেক পরে, শাহ আলমের শাসনামলে। খুব সম্ভবত কালিয়া আর দো-পেঁয়াজা মিলে কালের বিবর্তনে করমায় রূপান্তরিত হয়েছে।
১৮ শতকের পরে কোরমা রেসিপি যে মোঘল খাবারের তালিকায় চলে এসেছে, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। মোঘল শাসকদের সঙ্গে সঙ্গে এই খাবার ছড়িয়ে গেছে উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। মোঘল সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর এর জীবনী 'বাজম-ই-আখির' লিখেছেন মুনশি ফয়জুদ্দিন দেহলভি। সেখানেও মোঘল শান-শওকত এর সঙ্গে মিল রেখে দস্তরখান, রাজকীয় টেবিলে এই খাবার খাওয়ার বর্ণনা আছে।
আজকের ভারতে তিন রকমের কোরমার উপস্থিতি আছে বলে জানা যায়।
১. উত্তর ভারতের কোরমা, যেখানে দই, কাঠবাদাম কাজুবাদাম আর মালাই এর ব্যবহার করা হয়। এই কোরমা আর আমাদের এ অঞ্চলের কোরমা প্রায় এক।
২. কাশ্মীরী কোরমা, যাতে মৌরি বীজ, হলুদ আর তেঁতুলের ব্যবহার পাওয়া যায়।
৩. দক্ষিণ ভারতীয় কোরমা যাতে অবশ্যম্ভাবী রূপে আছে নারকেলের ব্যবহার। মোঘলাই ও অযোধ্যার কোরমার রেসিপি পাওয়া যায়।
অযোধ্যার মুরগি কোরমার রেসিপি
উপকরণ:
১ টা মুরগি, টুকরো করে কাটা (ধুয়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে, চামড়া বা গিলা-কলিজা থাকবে না)
বড় পেঁয়াজ - ১টা (কুঁচি করে কাটা)
তেল - ৩ টেবিল চামচ
দই - ২ টেবিল চামচ
আদা বাটা - ১ টেবিল চামচ
রসুন বাটা - ১ টেবিল চামচ
ধনিয়া গুঁড়া - ১ টেবিল চামচ
গরম মশলা গুঁড়া - আধা চা চামচ
গোটা গোলমরিচ - ১/৪ চা চামচ
লবঙ্গ - ৩টা
এলাচ - ২টা
তেজপাতা - ২টা
কেওড়ার জল- ২ ফোঁটা
পানি - ১ কাপ
মালাই - ১/৪ কাপ, ভালো করে ফেটে নিতে হবে
লবণ ও মরিচ স্বাদমতো
জাফরানের কয়েকটি কেশর, সামান্য গরম দুধে ভিজিয়ে রাখতে হবে
প্রণালী:
১. প্রথমে মুরগির টুকরোগুলোকে ১ চা চামচ লবণ, ১ চামচ লেবুর রস ও ১ চা চামচ আদা-রসুন বাটা দিয়ে ভালো করে মেখে রেখে দিতে হবে ২ ঘণ্টার জন্য।
২. পাত্রে তেল দিয়ে তাতে গোটা গোল মরিচ, এলাচ আর তেজপাতা দিয়ে কিছুক্ষণ ভাজতে হবে। সুগন্ধ ছড়ালে এর মধ্যে কুঁচি করে কেটে রাখা পেঁয়াজ দিয়ে দিতে হবে। সোনালি করে ভেজে নিয়ে তুলে রাখতে হবে সবটা।
৩. তেজপাতা বাদে তেল থেকে তুলে নেওয়া মসলাগুলো মিহি করে বেটে নিতে হবে।
৪. এবার মাংসের পানি ঝরিয়ে ওই তেলের মধ্যে ছেড়ে দিয়ে ভালো করে ভেজে নিতে হবে।
৫. এতে বাকি থাকা আদা-রসুন বাটা, ধনিয়া গুঁড়া দিয়ে নাড়াচাড়া করে নিতে হবে, সাবধানে যেন মাংস না খুলে যায়। এরপর একটু একটু করে দই মিশিয়ে নাড়তে হবে যাতে পাত্রের তলায় লেগে না যায়। এভাবে অন্তত ১০ মিনিট পর্যন্ত দই দিয়ে নাড়তে হবে।
৬. মাংস থেকে যখন তেল আলাদা হয়ে যাবে তখন গরম মশলা, লবণ, ভাজা পেঁয়াজের পেস্ট আর তেজপাতা দিয়ে নাড়তে হবে। ১ মিনিট পর্যন্ত নেড়ে ভালো করে মিশিয়ে নেওয়ার পর তাতে পানি দিয়ে দিন। এবার পাত্রের মুখ ঢেকে কম আঁচে দমে রান্না হতে দিন।
৭. মাংস যখন নরম হয়ে যাবে তখন এর মধ্যে মালাই বা ক্রিম, জাফরান দিয়ে ২ মিনিট ঢেকে রান্না করুন।
৮. পরিবেশন করার আগে ১ চামচ পানিতে ২ ফোঁটা কেওড়ার জল মিশিয়ে ছড়িয়ে দিন মাংসের ওপর।
পুনশ্চ: কোরমার ওপর ধনেপাতা কুচি দিয়ে সাজানোর কোন প্রয়োজন নেই। এটা মূলত কালিয়ার ক্ষেত্রে যোগ করা হয়।