পারিবারিক সহিংসতা: করোনার লকডাউনে আরেক মহামারি
সারাদেশে করোনাভাইরাসে লকডাউনের মধ্যে বেড়েই চলেছে পারিবারিক সহিংসতা। গত ১৫ এপ্রিল ফেসবুক লাইভে স্ত্রী তাহমিনা আক্তারকে কুপিয়ে হত্যা করেন ফেনীর বাসিন্দা ওবায়দুল হক টুটুল।
প্রতিবেশীরা ধারণা করছেন, তাহমিনা আক্তার পরিবার থেকে যৌতুক আনতে ব্যর্থ হওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছিলেন কথিত মাদকাসক্ত টুটুল।
গত ২৬ মার্চ থেকে ১২ এপ্রিলের মধ্যে, জাতীয় জরুরি হেল্পলাইনে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা সম্পর্কিত ৭৬৯টি ফোন কল এসেছে, যা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের বিশিষ্ট সহযোগী ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আমাদের এ সম্পর্কিত সংস্থাগুলোতে ঘরোয়া সহিংসতা সম্পর্কিত ফোন কলের সংখ্যা বেড়েছে। আমাদের মাঠ পর্যায়ের কর্মীরাও ঘরোয়া সহিংসতার ক্রমবর্ধমান প্রবণতা লক্ষ্য করেছেন।
তিনি আরও বলেন, এদিকে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা সংস্থাগুলো কাজ করতে পারছে না, আইনজীবীদের কর্মকাণ্ডও বন্ধ রয়েছে। এ কারণে রীতিমতো অসহায় বোধ করছে সংস্থাগুলো।
ড. দেবপ্রিয় যোগ করেন, আমরা মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রনকে স্থানীয় প্রশাসনকে এই বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন করার জন্য এবং উপজেলা স্তরের সমেত মাঠপর্যায়ে এই মহিলাদের সহায়তার ব্যবস্থা করার জন্য নির্দেশনা প্রেরণের আহ্বান জানাচ্ছি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) প্রতিবেদন অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত দেশে সহিংসতার ঘটনা ২৯ থেকে ৪২ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
সংস্থাটির সিনিয়র উপ-পরিচালক নীনা গোস্বামী বলেন, যখন ভিন্নমতের বিভিন্ন মানুষ একই ছাদের নিচে বাস করে, তখন সহিংসতা ঘটে। এটি কেবল বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বে ঘটছে। অফিস বন্ধ থাকায় আমাদের কোনো রিপোর্টের মামলা নেই, তবে আমরা আমাদের হেল্পলাইনে প্রচুর ফোন কল পাচ্ছি।
নীনা বলেন, সহিংসতার শিকার এই নারীদের সমর্থন করতে, মামলাগুলো ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) এর ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে বা স্থানীয় থানায় প্রেরণ করা হয়।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট ফওজিয়া করিম ফিরোজ বলেন, লকডাউনের আগে থেকেই পারিবারিক সহিংসতা প্রচলিত ছিল, তাই বন্ধের মধ্যে এটি কমবে এমন আশা করা যায় না।
'নিরাপত্তাহীনতা, হতাশা এবং সঙ্কটের সময়ে সহিংসতা সবসময় বেড়ে যায়। যেহেতু দেশটি অনিশ্চয়তায় ডুবে গেছে, এটি একটি সাধারণ ঘটনা। আমরা আমাদের হটলাইন নম্বরগুলিতে সাহায্যের জন্য কল পাচ্ছি।' বলেন তিনি।
ফউজিয়া বলেন, তবে এই মুহুর্তে তাদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র খোলা নেই বলে আমরা তাদের সহায়তা করতে পারছি না।
দেশে বিদ্যমান সহায়তা সংস্থা
শাটডাউন সত্ত্বেও ক্ষতিগ্রস্থদের সহায়তার জন্য ডিএমপির ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার উন্মুক্ত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রের এক প্রবীণ পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, আমরা এখন কম অভিযোগ পাচ্ছি। তবে আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার জন্য সর্বদা উন্মুক্ত।
ওই কর্মকর্তা আর বলেন, যদিও আমাদের সঙ্গে সম্পর্কিত কাউন্সেলর এবং আইনজীবীদের চেম্বারগুলো বন্ধ রয়েছে। তবে যদি কোনো সহিংসতার অভিযোগ আমাদের কাছে আসে তবে আমরা অবশ্যই তাদের সহায়তা করব। আমরা তাদের ফোনে পরামর্শদাতাদের এবং আইনী পরামর্শদাতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেব।
নারীদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা প্রাগ্রসর। পারিবারিক সহিংসতার শিকার নারীদের সহায়তা দিতে অনলাইনে কাউন্সিলিং সেবা দিচ্ছে সংস্থাটি।
এছাড়াও ডিএমপি ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার পরে একটি হটলাইন নম্বর খোলার এবং একটি আশ্রয় স্থাপনের পরিকল্পনাও রয়েছে তাদের।
পারিবারিক সহিংসতার বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট
'নারীদের উপর কোভিড -১৯ এর প্রভাব' শীর্ষক জাতিসংঘের এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে সমস্ত ধরনের সহিংসতা- বিশেষত নারী ও কন্যা সন্তানদের প্রতি পারিবারিক সহিংসতা - বিশ্বব্যাপী বেড়েছে।
দ্য গার্ডিয়ান জানিয়েছে, ২৩ মার্চ থেকে এপ্রিল ১২ এপ্রিলের মধ্যে যুক্তরাজ্যে কমপক্ষে ১৬টি পারিবারিক নির্যাতনের পর খুনের খবর পাওয়া গেছে।যা গত দশ বছরে এই ধরনের খুনের গড় সংখ্যার চেয়ে তিনগুণ বেশি।
লকডাউন কার্যকর হওয়ার পর থেকে জাতীয় পারিবারিক নির্যাতন হেল্পলাইনে অভিযোগ ২৫ শতাংশ বেড়েছে। যুক্তরাজ্য সরকার এই সময়ে দুর্বল ও নির্যাতনের শিকার ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার জন্য ৭৫০ মিলিয়ন পাউন্ডের একটি প্যাকেজ ঘোষণা করেছে।
এমনকি ভারতের জাতীয় নারী কমিশন ২৩ মার্চ থেকে ১৬ এপ্রিলের মধ্যে ২৫ দিনে ৫৮৭টি পারিবারিক নির্যাতনের অভিযোগ নথিভুক্ত করেছে। লকডাউনের আগের২৫ দিনে ৩৯৬ টি অভিযোগ পেয়েছিল তারা।
ফ্রান্স ও সাইপ্রাসে ১ মার্চ থেকে পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
অন্যদিকে, আর্জেন্টিনায় এই হার বেড়েছে ২৫ শতাংশ। সিঙ্গাপুরে পারিবারিক সহিংসতা স্বাভাবিকের চেয়ে ৩৩ শতাংশ বেড়েছে।
কানাডা, জার্মানি, স্পেন, যুক্তরাজ্য এবং আমেরিকার মতো প্রথম বিশ্বের দেশগুলোরর লোকেরা লকডাউনের সময় জরুরি আশ্রয়কেন্দ্র এবং ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সহায়তা কেন্দ্রের দাবি করছেন।
৫ এপ্রিল কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য বাংলাদেশ জরুরি উদ্দীপনা প্যাকেজ হিসাবে ৮.৫ বিলিয়ন বরাদ্দ করেছে। তবে পারিবারিক সহিংসতার মতো সামাজিক অপরাধের জরুরি প্রতিক্রিয়ার জন্য স্পষ্টভাবে কোনো পরিমাণ বরাদ্দ করা হয়নি।