পৃথিবীকে শীতল করতে ‘এযাবৎকালের সর্বাধিক সাদা’ রঙ আনলেন গবেষকেরা
'সাদার চেয়ে বেশি সাদা'- বাংলাদেশি একটি বিজ্ঞাপনচিত্রে অতীতে এ প্রত্যয় ব্যবহার করা হয়েছিল। এবার তেমনি এক দেয়াল রাঙানোর সাদা রঙ নিয়ে এলেন যুক্তরাষ্ট্রের একাডেমিক গবেষকরা। 'এযাবৎকালের সর্বাধিক সাদা' এই রঙটি নিয়ে তাদের দাবি, এর ব্যবহারে বাড়িঘর শীতল থাকবে এবং জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় সহায়তা হবে।
নতুন এই রঙ ৯৮% সূর্যালোক এবং ইনফ্রারেড তাপকে বিকিরিত করে বায়ুমণ্ডলের মাধ্যমে মহাকাশে প্রেরণ করে। পরীক্ষাতে দেখা যায়, তীব্র সূর্যের আলোতেও এ রঙ পৃষ্ঠতলকে বিদ্যমান তাপমাত্রার চাইতে সাড়ে চার ডিগ্রি সেলসিয়াস ঠান্ডা করে। আগামী এক-দুই বছরের মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে এ রঙ বাজারে মিলবে বলে গবেষকরা আশাবাদী।
কয়েক শতাব্দী ধরে ভবন শীতল রাখার জন্য ছাদে সাদা রঙ ব্যবহার হয়ে আসছে। তবে বৈশ্বিক উত্তাপ পৃথিবীজুড়ে তাপমাত্রা বাড়িয়ে তোলায় এখন আধুনিকভাবে বৈজ্ঞানিক উপায়েই ছাদের পৃষ্ঠে সাদা রঙ ব্যবহৃত হচ্ছে। ভারতের আহমেদাবাদ এবং আমেরিকার নিউইয়র্ক সিটিতে ইতিমধ্যে এ কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে।
বর্তমানে দেয়ালে যেসব বিকিরণ ক্ষমতাযুক্ত সাদা রঙ ব্যবহার করা হয়ে থাকে, নিঃসন্দেহে তা গাঢ় রঙের তুলনায় ভাল। কিন্তু এটি সূর্যরশ্মির মাত্র ৮০-৯০% ফিরিয়ে দিতে সক্ষম। তাছাড়া এই রঙ সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি শোষণ করে নেয়, ফেরাতে পারে না। ফলে ঘরের তাপমাত্রা হ্রাসে তেমন ভূমিকা রাখতে পারে না। কিন্তু নতুন রঙের এ ক্ষমতা রয়েছে। এটি প্রাকৃতিকভাবেই ঘরকে শীতল রাখবে। ফলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণকারী যন্ত্রের ব্যবহার কমে যাবে, কমবে কার্বন নিঃসরণ।
"আমাদের এই রঙ পৃথিবীকে শীতল করতে সহায়তা করে বৈশ্বিক উষ্ণতা হ্রাসে সাহায্য করবে। আমরা তাই একে বলি 'কুল পেইন্ট' বা শীতল রঙ", বলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পারডিউ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জিউলিন রুয়ান।
"এটি এতটাই সাদা যে সর্বোচ্চ পরিমাণে সূর্যালোক মহাকাশে প্রতিফলিত করার ক্ষমতা রাখে"।
রুয়ান জানান, ৯৩ বর্গ মিটার (এক হাজার বর্গফুট) অংশজুড়ে এ রঙ করালে ১০ কিলোওয়াটের শীতলতা পাওয়া যাবে।
"বেশিরভাগ বাড়ির কেন্দ্রে যে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণকারী যন্ত্র ব্যবহৃত হয়, এটি তার চাইতেও শক্তিশালী"।
এসিএস অ্যাপ্লাইড মেটেরিয়ালস এন্ড ইন্টারফেসেস শীর্ষক জার্নালের একটি প্রতিবেদনে নতুন এই রঙের কথা প্রকাশিত হয়েছে।
তিনটি কারণ এই রঙের পরিবেশ শীতলীকরণের পেছনে দায়ী। প্রথমত, এখানে পিগমেন্ট বা রঙ্গক হিসেবে বেরিয়াম সালফেট ব্যবহার করা হয়েছে যা অতিবেগুনী রশ্মি শোষণ করে না। বিপরীতে, সাধারণ দেয়ালের রঙে টাইটানিয়াম ডাই অক্সাইডের পিগমেন্ট ব্যবহৃত হয়।
দ্বিতীয়ত, এই পিগমেন্টের ঘনত্ব প্রচুর, প্রায় ৬০%।
তৃতীয়ত, পিগমেন্টের কণাগুলো বিভিন্ন আকার-আকৃতির। একটি পার্টিকল বা কণা দ্বারা ছড়ানো-ছিটানো আলোর পরিমাণ তার আকারের উপর নির্ভর করে, সুতরাং বিভিন্ন পরিসরের পিগমেন্ট ব্যবহার করা হলে তা বেশিমাত্রায় সূর্য থেকে বিচ্ছুরিত আলোক বর্ণ ছড়িয়ে দিতে পারে।
গবেষকরা জানান, এই অতি-সাদা রঙ তৈরীতে কোন বিশেষ তরল লাগে না। এটি একটি স্ট্যান্ডার্ড অ্যাক্রিলিক দ্রাবক ব্যবহার করে এবং একে বাজারে প্রচলিত পেইন্টের মতোই তৈরি করা যেতে পারে। তাদের দাবি, দামে এটি দেয়ালের অন্যান্য রঙের কাছাকাছিই হবে, যেহেতু বেরিয়াম সালফেট, টাইটানিয়াম ডাই অক্সাইডের চেয়ে সস্তা।
রঙটির ঘর্ষণরোধী পরীক্ষাও করা হয়েছে ইতিমধ্যে, তবে এর স্থায়িত্ব মূল্যায়নের পরীক্ষা এখনো বাকি। ছাদের দেয়ালে প্রয়োগের পর রোদ-বৃষ্টি সামলে কতদিন পর্যন্ত এটি এর অতি-সাদা রঙ ধরে রাখতে পারে সেটি যাচাই করে দেখা লাগবে বলে জানান গবেষকেরা।
চোখধাঁধানো হলেও এ রঙ মানুষের দৃষ্টিশক্তির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ নয় বলে জানান রুয়ান। তিনি বলেন, "যেকোন পৃষ্ঠ সূর্যের আলোকে বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিবিম্বিত করে, ফলে কোন একটি নির্দিষ্ট দিকে আলোকের শক্তিশালী প্রতিফলন ঘটে না। এই রঙটি কেবল উজ্জ্বল সাদা, তুষারের চেয়ে খানিকটা বেশি সাদা "।
বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষকদের দলটি যৌথভাবে রঙটির স্বত্ব দাবি করেছে। পাশাপাশি বাণিজ্যিকায়নের উদ্দেশ্যে একটি বড় কর্পোরেশনের সাথেও কথা চলছে।
গবেষণা দলের সঙ্গে যুক্ত নন এমন একজন, যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির আলোক-বিচ্ছুরণ বিশেষজ্ঞ লুকাস শের্টেল বলেন, "শীতল করার জন্য পেইন্ট ব্যবহার করার ধারণা নতুন নয় তবে এখনও সমাজে এর উচ্চ সম্ভাবনা রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, এই গবেষণার ফলে এটি এখন ব্যাপকভাবে ব্যবহারের সুযোগ তৈরী হবে; একে বাণিজ্যিকভাবে ছড়িয়ে দেয়া যাবে। গবেষণাটি আরও সফল হলে এই জাতীয় প্রযুক্তি কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করতে এবং বিশ্বব্যাপী প্রভাব ফেলতে ভূমিকা রাখবে বলে আমি মনে করি"।
জলবায়ু সংকট সম্পর্কিত সমাধান মূল্যায়নকারী দাতব্য সংস্থা, প্রজেক্ট ড্রডাউন অনুমানের ভিত্তিতে জানায়, সাদা এবং সবুজ ছাদ ব্যবহার করা গেলে ২০৫০ সালের মধ্যে ৬০০ মিলিয়ন থেকে ১.১ বিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইডের ব্যবহার কমানো সম্ভব। এ পরিমাণ দুই থেকে তিন বছরে যুক্তরাজ্যের মোট বার্ষিক নিঃসরণের কাছাকাছি।
- সূত্র- দ্য গার্ডিয়ান