মদিনায় সুপার মডেলদের বিতর্কিত ফটোশ্যুটের পেছনের ঘটনা কী?
সৌদি আরবের পবিত্র মদিনা প্রদেশের আল উলা অঞ্চলে সম্প্রতি এক বিতর্কিত ফটোশ্যুটের অনুমতি দিয়েছিল দেশটির পর্যটন মন্ত্রণালয়। অনুমতি পাওয়ার পর আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সুপার মডেলদের আঁটসাঁট পোশাক পড়িয়ে 'আল উলায় ২৪ ঘণ্টা' শীর্ষক ফটোশ্যুটটি করে বিনোদন ম্যাগাজিন ভোগ' এর সৌদি আরব শাখা।
এ ঘটনায় সৌদিসহ বিশ্বের নানা দেশের মুসলিমরা ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। পবিত্র মদিনা নগরীর নিকটে এধরনের ইসলামি রীতিবিরুদ্ধ চিত্রধারণের তীব্র নিন্দা করেছেন অনেকেই।
আল উলা জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। এখানে রয়েছে ইসলাম পূর্ব সভ্যতা নবতিয়দের নির্মিত পাথর কেটে তৈরি করা দালান এবং ভাস্কর্য। ২৬ হাজার ২৬১ বর্গ কিলোমিটার আয়তনে বিশ্বের সবচেয়ে বড় উন্মুক্ত জাদুঘর হিসেবেও স্বীকৃত ঐতিহাসিক আল উলা। একমাত্র জর্ডানের পেত্রা নগরীর সঙ্গেই এটি তুলনীয়।
ফটোশ্যুটে মডেলদের পরিহিত পোশাকের নকশা এবং চিত্রধারণ পরিকল্পনা করেছেন লেবানিজ বংশদ্ভুত এলি মিরজাহি। তিনি নিজ প্রতিক্রিয়ায় জানান, আল উলার ভূ-প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আমরা কি করতে পারি, এটা ছিল তারই একটি প্রতিচ্ছবি।
বিখ্যাত দুই আলোকচিত্রি লুইজি এবং ল্যাঙ্গো ছিলেন মূল চিত্রগ্রাহক।
আল উলায় নানা ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আর শুয়ে ছবি তোলেন সুপার মডেলরা। ফটোশ্যুটের অংশ হিসেবে ইসলামি রীতিবিরুদ্ধ পোশাকেও হেঁটেছেন প্রকাশ্যে।
মদিনা নগরী থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরে হলেও, সৌদি প্রশাসন কিভাবে এ ধরনের ছবি তোলার অনুমতি দিতে পারে, তা নিয়েই ক্ষুদ্ধ ও ব্যথিত অনেক মুসলিম।
নেটিজেন মুসলিমদের প্রতিক্রিয়া:
সোমাইয়া কামাল নামের এক আরবী নারী টুইট করেন, আল উলা এলাকায় বিদেশি একটি ম্যাগাজিন আমাদের সংস্কৃতিকে অবমাননা করে যে ফটোশ্যুট করেছে; তা বিশ্বাসীদের বিশ্বাসের স্তম্ভ ধরে নাড়া দিয়েছে। ব্যথিত করেছে তাদের হৃদয়কে।
মোহাম্মদ তোবা নামের অপর একজন লেখেন, কি আশ্চর্য ধাঁধাঁ। যখন হাজিয়া সোফিয়ায় আবার আযানের ধ্বনি উঠছে, ঠিক তখনই নগ্ন নারীদের পৃথিবীর পবিত্রতম বালুকাভূমিতে প্রদর্শন করা হচ্ছে।
সৌদি নারীদের প্রকৃত দুর্দশা তুলে ধরে হায়াত ইয়ামানি নামের এক নারী লিখেছেন, লুজেইন হাথৌলের মতো সৌদি নারীদের যখন ন্যায়সঙ্গত দাবির জন্য কারাবাস দেওয়া হয়েছে, ঠিক তখনই ঈশ্বরপ্রেরিত দূতের শহরে সুপারমডেলদের অর্ধ-নগ্ন হয়ে ছবি তোলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে ।
এব্যাপারে এখন পর্যন্ত যা জানা গেছে, তাতে সরকারি নীতি পরিবর্তনের আভাসটাই বেশি। পশ্চিমা বিশ্বের আদলে সৌদি আরবে আধুনিকায়নের লক্ষ্যে দেশটির রাষ্ট্রক্ষমতার নিয়ন্ত্রক ক্রাউন প্রিন্স মোহামদ বিন সালমানের সংস্কার কার্যক্রমের অধীনেই এ অনুমতি দেওয়া হয়। তেল নির্ভর অর্থনীতি থেকে সরে এসে দেশকে আধুনিকায়ন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য উন্মুক্ত করার উদ্দেশ্যেই তিনি এসব সংস্কার করছেন, বলে দাবি করা হচ্ছে।
এসব সংস্কার সম্পন্ন করার মধ্য দিয়েই সৌদি যুবরাজ তার ভিশন ২০৩০ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে চান।
ভিশন ২০৩০ আসলে কী:
সৌদি আরবের 'ভিশন ২০৩০' পরিকল্পনার আওতায় ধর্মীয় বিধি-নিষেধ পালনের কড়াকড়ি অনেকটাই শিথিল করা হবে। কমানো হবে ধর্মীয় পুলিশের নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতা। নারী-পুরুষের প্রকাশ্যে মেলামেশা সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞাও বাতিল করা হবে। এছাড়াও, জনসমাগম স্থলে নারীদের ঢিলেঢালা পোশাক বা 'আবায়া' পড়ার যে নিয়ম আছে, বাতিল হবে সেটিও।
এই লক্ষ্যের আওতায় যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক ভোগ ম্যাগাজিনকে আল উলায় বিতর্কিত ফটোশ্যুটটি আয়োজনের অনুমতি দেওয়া হয়। যাতে অংশ নেন; কেট মস, মারিয়া কার্লা বসকোনো, ক্যান্ডিস সোয়ানেপল, জর্ডান ডান, অ্যাম্বার ভেলেটা, জিয়াও ওয়েন এবং অ্যালেক ওয়েকের মতো খ্যাতনামা সুপার মডেলরা।
আনুষ্ঠানিকভাবে আল উলা'য় পর্যটন আকর্ষণ করতেই এ আয়োজনের ইঙ্গিত দেওয়া হলেও, ঘটনার তীব্র প্রতিক্রিয়ার প্রেক্ষিতে সরাসরি কোনো বিবৃতি দেয়নি সৌদি সরকার।
সৌদিতে সংস্কার আসলে কী ধরনের:
দীর্ঘদিন ধরে সৌদি আরবের আভ্যন্তরীণ অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখেন এমন অধিকার কর্মীরা বলছেন, মোহাম্মদ বিন সালমান পশ্চিমা বিশ্বকে আধুনিকায়ন দেখাতে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছেন, তার সঙ্গে মানবাধিকার উন্নয়নের কোনো সম্পর্ক নেই। পশ্চিমা গণমাধ্যমে এসব সংস্কারের উদ্যোগ গুরুত্ব পেলেও, আড়ালে থাকছে দেশটির মানবাধিকার কর্মীদের ওপর অব্যাহত দমন-পীড়নের ঘটনা। এমনকি ধামাচাপা পড়ে গেছে তুরস্কের সৌদি কনস্যুলেটে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া সাংবাদিক জামাল খাসোগজিকে হত্যার ঘটনা। যার পেছনে সরাসরি ইন্ধন ছিল এমবিএস' খ্যাত সৌদি যুবরাজের।
শুধু তাই নয় আরব বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ ইয়েমেনেও সামরিক আগ্রাসনের মূল নায়ক তিনি। ইয়েমেনে সৌদি বিমান বাহিনীর নির্বিচার বোমাবর্ষণকে 'গণহত্যার' শামিল বলে নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘও। কিন্তু, তারপরও বিন সালমানের ক্ষমতার হ্রাস টেনে ধরার কোনো উদ্যোগ নেয়নি পশ্চিমা শক্তিগুলো। বরং, পর্দার আড়ালে বিন সালমানের অবস্থান পাকাপোক্ত করতেই ভূমিকা রাখে তারা।