সংক্রমণে দ্বিতীয় শীর্ষ ভারতে অর্থনৈতিক মন্দায় গভীর সঙ্কট
ক্রমশ বেড়ে চলা সংক্রমণের সুবাদে ভারত- পরিণত হয়েছে দ্বিতীয় শীর্ষ করোনায় বিপর্যস্ত দেশে। আজ সোমবার (৭ সেপ্টেম্বর) নাগাদ দেশটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরের স্থান দখল করে। মহামারি সৃষ্ট মন্দা থেকে বেড়িয়ে আসা যখন দেশটির জন্য অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছে, ঠিক তার মধ্যেই আরও অবনতি হচ্ছে সংক্রমণ পরিস্থিতির।
বিগত ২৪ ঘণ্টা বা রোববার সারাদিনে ভারতে ৯০ হাজার ৮০২টি সংক্রমণ শনাক্ত হয়। ফলে ৪২ লাখে পৌঁছে যায় এপর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা। আর দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ব্রাজিলকে টপকে দ্বিতীয় স্থানে চলে আসে ভারত। শীর্ষে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় এখনও ২০ লাখ কম রোগী চিহ্নিত হয়েছে ভারতে। যুক্তরাষ্ট্রে এ সংখ্যা ৬২ লাখ। জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সোমবার ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়- নতুন করে আরও ১,০১৬টি মৃত্যুর কথা জানায়। যার ফলে এপর্যন্ত মহামারিতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো ৭১,৬৪২টিতে। পুরো বিশ্বে যা তৃতীয় শীর্ষ জাতীয় প্রাণহানির পরিসংখ্যান। খবর এপির।
অর্থনীতির বেহাল দশা:
প্রায় ১৪০ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারতে গত একমাস ধরে করোনায় সংক্রমিত হওয়াদের সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। দৈনিক সংক্রমণের সংখ্যায় যুক্তরাষ্ট্রকেও অনেক আগেই পেছনে ফেলেছে দেশটি।
এখন ভারতের ছোট শহর, মফস্বল ও গ্রামাঞ্চলে বিস্তার লাভ করছে জীবাণুটি। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার উদ্দেশ্যে সরকার যখন কড়াকড়ি ও চলাচল নিষেধাজ্ঞা শিথিল করছে, ঠিক তখনই সামনে বাধার প্রাচীর তুলে দিয়েছে সংক্রমণের ব্যাপকতা।
তবে মহামারির তীব্রতার মধ্যে কড়াকড়ি শিথিলের পক্ষে-বিপক্ষে সমালোচনাও চলছে। সোমবার নাগাদ সচল হয় বড় পরিসরের গণপরিবহন। রাজধানী নয়াদিল্লির অন্যতম যোগাযোগ ধমনী দিল্লি মেট্রো ট্রেন সার্ভিস চালু হয় এদিন।
টানা পাঁচমাস বন্ধ থাকার পর নয়াদিল্লি এবং আশেপাশের এলাকাগুলোর মধ্যে সংযোগের লক্ষ্যে এটি চালু করা হয়। প্রথমদিনে খুব একটা যাত্রী লক্ষ্য করা যায়নি মেট্রো ট্রেনগুলোয়। স্টেশনগুলোও ছিল প্রায় শূন্য। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ট্রেন যাত্রায় সতর্ক ছিল কর্তৃপক্ষ। শুধুমাত্র উপসর্গহীন ব্যক্তিদেরই ট্রেনে চড়ার ছাড়পত্র দেওয়া হয়। পাশাপাশি ট্রেনের ভেতর মাস্ক পরিধান করা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা নিশ্চিত করা হয়। যাত্রীদের দেহের তাপমাত্রা পরীক্ষাও ছিল বাধ্যতামূলক।
তবে মেট্রো ট্রেনে যাত্রী কম থাকলেও মানুষের ভিড়ে মুখর ছিল কিন্তু দিল্লির রাজপথ। মহামারির আগের মতোই দলবেঁধে বাজারে গিয়ে কেনাকাটা করতে দেখা গেছে নাগরিকদের। আগামী বুধবার শহরটির পানশালাগুলোও খুলে দেওয়া হচ্ছে।
সবকিছু পুনরায় খুলে দেওয়ার এ চেষ্টা নতুন গতি লাভ করে গত প্রান্তিকে ভারতের অর্থনীতি প্রায় ২৪ শতাংশের রেকর্ড সংকোচনের প্রেক্ষিতে।
মহামারি অবশ্য ভারতের ক্রমশ নিম্নগামী অর্থনীতির বুকে নতুন শক্তি নিয়ে আঘাত করেছে। পরিস্থিতি সঙিন হয়ে ওঠে ২০১৬ সালে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নোট বাতিল পদক্ষেপের পর থেকেই। তারপরের বছরই দ্রুতগতিতে পণ্য ও পরিষেবা কর- দ্রুত বাস্তবায়নের মাধ্যমে তার সরকার বাণিজ্যিক পরিবেশে আরও চাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু, গত ২৪ মার্চের লকডাউনের পর থেকে দেশটির অর্থনীতি যেভাবে নাজেহাল হয়েছে, তা ছিল সাম্প্রতিক তিন দশকের মধ্যে নজিরবিহীন ঘটনা।
মার্চে নরেন্দ্র মোদি যখন দেশজুড়ে লকডাউন জারি করেন, তার প্রেক্ষিতে ৪ ঘন্টার মধ্যে থেমে যায় সকল প্রকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। ওই মুহূর্তেই বেকার হয়ে পড়ে লাখ লাখ দিনমজদুর ও অস্থায়ী কর্মী। ভারতের দরিদ্র অঞ্চল থেকে আসা পরিযায়ী এ শ্রমিকেরা পরবর্তীতে অনাহারে ধুঁকে ধুঁকে মরার চাইতে দলে দলে শহর ছেড়ে গ্রামের পথে পা বাড়ায়।
জীবন না জীবিকা:
কর্মীগোষ্ঠীর বিপুল অভ্যন্তরীণ পুনঃঅভিবাসন শুধু যে অর্থনীতির প্রাণশক্তি কেড়ে নিয়েছে শুধু তাই নয়, এর ফলে দেশটির সকল প্রান্তেও ছড়িয়েছে করোনার সংক্রমণ। এখন সংক্রমণের ঘটনা দৈনিক বাড়তে থাকলেও উন্মুক্ত করা হয়েছে উচ্চঝুঁকিতে থাকা অনেক অঞ্চল। স্থানীয় কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, মানুষের রুজি-রোজগারের অবলম্বন বাঁচাতে এ সিদ্ধান্ত এড়ানোর কোনো উপায় ছিল না।
''জীবন যেমন গুরুত্বপূর্ণ, জীবিকাও তার চাইতে কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়'' বলছিলেন ভারতের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তা রাজেশ ভূষণ। গত সপ্তাহেই তিনি এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে এ মন্তব্য করেন।
ভারতের ৬০ % করোনা সংক্রমণের ঘটনা লক্ষ্য করা গেছে; অন্ধ্র প্রদেশ, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র, এবং উত্তর প্রদেশে। সবগুলোই ভারতের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্যের কাতারে পড়ে। ইতোপূর্বে যেসব এলাকায় নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছিল, এখন সেখানেও বাড়েছে সংক্রমণ।
প্রথমদিকে বিপুল আকারে সংক্রমণ ধরা পড়ার প্রেক্ষিতে, রোগী শনাক্তে জোর পদক্ষেপ নিয়ে ভাইরাসের বিস্তার কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছিল দিল্লি রাজ্য সরকার। কিন্তু, অর্থনীতিকে উন্মুক্ত করার পর থেকেই ফের সাম্প্রতিক সময়ে আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা বাড়তে দেখা যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, মেট্রো ট্রেনের মতো গণপরিবহন উন্মুক্ত করার ফলে মহামারির তীব্রতা আরও বাড়বে।
সাম্প্রতিক সময়ে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ভারতের অ্যান্টিজেন পরীক্ষার উপর বেশি নির্ভরতায় ব্যর্থতার দিকটি তুলে ধরে। এ পরীক্ষার খরচ কম, কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফলাফল পাওয়া যায় এবং এর মাধ্যমে একদিনে ১০ লাখের বেশি মানুষকে পরীক্ষা করা সম্ভব হয়।
''তবে প্রায়শই এর ফলাফল সম্পূর্ণ নির্ভরযোগ্য হয় না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে শনাক্ত না করার ঝুঁকিও থেকে যায়'' জানান ভেল্লোরের ক্রিশ্চিয়ান মেডিকেল কলেজের সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ ডা. গঙ্গাদীপ কাং।
ভারতে কোভিড-১৯ রোগীদের সেরে ওঠার হার ৭৭.৩ % এবং মৃতের সংখ্যাও কমেছে ১.৭২ শতাংশ।
কিন্তু, অর্থনৈতিক সঙ্কটই এখন মুখ্য চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে দেশটির নীতি-নির্ধারক মহলে। এখন যেকোনো ভাবে কাজে ফিরতে চায় লকডাউনের কারণে জীবিকা হারানো লাখো দিন-মজদুর। এদের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সুযোগ এবং সামর্থ্যও একেবারেই কম।
ভারতীয় অর্থনীতির সকল প্রাণকেন্দ্রে মহামারির প্রভাব অনুভূত হচ্ছে। বাদ পড়েনি দরিদ্রতম রাজ্যগুলোও। এমন কিছু রাজ্যে ভাইরাসের বিস্তার অপ্রতুল স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে প্রায় মারাত্মক চাপের মুখে ফেলেছে। বাড়িয়েছে সীমিত সম্পদ ও অবকাঠামোর উপর সঙ্কট।
এস.পি. কালান্ত্রি নামের এক স্থানীয় স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, ''ভারতের গরিবদের জন্য এখন দুটো রাস্তা খোলা; হয় এই মুহূর্তে অনাহারে মৃত্যুর সম্ভাবনা গ্রহণ করা, নইলে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে যেকোনো মুহূর্তের মৃত্যুকে মেনে নেওয়া। স্বাভাবিক তারা নিতান্তই বাধ্য হয়ে দ্বিতীয় সমাধানের দিকেই হাঁটবেন। আর এখন গ্রামেও মহামারি ছড়াচ্ছে প্রান্তিক দরিদ্রের মধ্যে। তাই মহামারি কমার কোনো লক্ষ্মণ অন্তত আমি দেখতে পাচ্ছি না।''