সহানুভূতি, দানশীলতা ও দূষণ হ্রাস; বিশ্ব মহামারির কালে আশা জাগানিয়া পাঁচ সংবাদ
অস্বীকার করার উপায় নেই, সমগ্র মানবজাতির জন্য এখন বড় দুঃসময়। সকল চেষ্টাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দেশে দেশে করোনা ভাইরাস বিস্তার লাভ করছে। ক্রমশ ভারি হচ্ছে সংক্রমিত রোগী ও তাদের মৃত্যুর সংখ্যা। কোথাও অবরুদ্ধ করে ফেলা হচ্ছে শহরকে, কোথাওবা পুরো দেশই অচল হয়ে পড়ছে সংক্রমণ রোধের চেষ্টায়। একে-অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন গৃহবন্দি কোটি কোটি মানুষ। তবে এতসব দুসংবাদের ভিড়ে এখনও কিছু কিছু ইতিবাচক ঘটনা আমাদের সামনে এই বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার আশা সৃষ্টি করছে। খবর বিবিসির।
১. কমছে দূষণ
করোনার কারণে শুধু নানা দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হয়েছে তা নয়, বরং একের পর এক দেশ যখন লকডাউনের পথে হাঁটছে তার সঙ্গে সঙ্গেই পৃথিবীর পরিবেশ দূষণের মাত্রাও উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে।
করোনায় সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত উত্তর ইতালি ও চীনের বাতাসে ক্ষতিকর নাইট্রোজেন অক্সাইড গ্যাস নিঃসরণ ব্যাপক হ্রাস পেয়েছে বলে রেকর্ডকৃত তথ্যে জানা গেছে।
নাইট্রোজেন অক্সাইড একাধারে মানবদেহের জন্য একটি ক্ষতিকর রাসায়নিক যৌগ। যা পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি ঘটিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের পেছনেও অবদান রাখে। তবে এখন অজস্র শিল্পাঞ্চল বন্ধ এবং যানবাহন চলাচল কমায় এর নিঃসরণও কমেছে।
নিউইয়র্কের কিছু গবেষক বিবিসিকে জানান, শুধু নাইট্রোজেন অক্সাইড নয়; গবেষণায় দেখা গেছে গাড়ির ইঞ্জিন থেকে নির্গত কার্বন মনোক্সাইডের নিঃসরণ গত বছরের তুলনায় ৫০ শতাংশ কমেছে।
করোনায় সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত এয়ারলাইন্সের ব্যবসা। বানিজ্যিক উড়োজাহাজের উড্ডয়ন প্রায় বন্ধ থাকার সুবাদে বায়ুমন্ডলে জীবাশ্ম জ্বালানি তেল পোড়ানোর ফলে নির্গত গ্রিনহাউজ গ্যাসের নিঃসরণ আরও কমার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।
সমগ্র পৃথিবীর প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য যা এক দীর্ঘমেয়াদি সুখবর।
২. পরিচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে খালের পানি
খালের জন্য বিখ্যাত শহর ইতালির ভেনিস। করোনার কারণে পর্যটন বন্ধ থাকায় সেখানকার খালগুলো যেন সতেজ হয়ে উঠেছে স্বচ্ছ পানির ঢেউয়ে।
খোদ ভেনিসবাসীরাই বলছেন তাদের বিখ্যাত খালগুলোর পানির মান এখন অনেক উন্নত হয়েছে।
উত্তর ইতালির এই জনপ্রিয় পর্যটন নগরীতে আগে খালের পানি শান্ত হয়ার সুযোগ পেতোনা নৌকায় পর্যটকদের চলাচলের কারণে। এখন পানি শান্ত থাকায় তাতে মিশে থাকা পলি নিচে জমা হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।
আগে বারো মাস ঘোলা থাকা এই পানি এখন এতোটা পরিষ্কার যে মাছের চলাফেরা পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সেখানে বিচরণ করতে ফিরে এসেছে রাজহাঁস আর ডলফিনের দল।
৩. সাহায্য ও সৌহার্দের নজির
বিশ্ব মহামারি তো আর যেনতেন কথা নয়, প্রতি শতবছরে একবার এমন মহাদুর্যোগ দেখা দেয়। অধিকাংশ মানুষ তাই করোনার আতংকে অতিরিক্ত কেনাকাটা করছেন, টয়লেট পেপার আর টুনার ক্যান কেনা নিয়ে দোকানে গিয়ে ক্রেতাদের লড়াই করার সংবাদ আছে অজস্র।
তবে মুদ্রা অপর পিঠটাকে অস্বীকার করা উচিত হবে না। মহাদুর্গতির এই সময়ে অনেক মানুষ ভালোবাসা, দয়া আর দানের আদর্শ নজির স্থাপন করে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন।
করোনার কারণে জিনিষপত্রের দাম বাড়ায় রাস্তায় রাস্তায় অভাবী মানুষের জন্য খাবারের প্যাকেট রেখে যাচ্ছেন তুরস্কের মানুষ। বৃদ্ধ এবং দরিদ্র মানুষের দুয়ারে দুয়ারে প্রয়োজনীয় মুদিবাজার এবং ওষুধ পৌঁছে দেওয়ার জন্যে নিউইয়র্কে গত ৭২ ঘণ্টায় স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে এগিয়ে আসেন ১৩শ মানুষ।
ফেসবুক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় যুক্তরাজ্যের নানা এলাকাভিত্তিক বিশেষ স্বেচ্ছাসেবী ফেসবুক গ্রুপগুলোতে লাখ লাখ মানুষ যোগ দিয়েছেন। কানাডাতেও এসব গ্রুপের সদস্য হওয়ার প্রবণতা এতোটাই বেড়েছে যে সেখানে এখন এর নাম দেওয়া হয়েছে 'কেয়ারমংগারিং' বা অন্যের প্রতি সাহায্যে এগিয়ে আসার হুড়োহুড়ি।
এর মাঝে অস্ট্রেলিয়া নিয়েছে এক ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ। সেদেশে বয়োজ্যষ্ঠে আর শারীরিকভাবে অক্ষম নাগরিকদের জন্য বিশেষ 'ক্রয় ঘন্টা' চালু করা হয়েছে- যাতে তারা এই সময়টা অপেক্ষাকৃত নিরুদ্বেগ বা শান্তিতে প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পারেন।
অস্ট্রেলিয়ায় মানুষ প্রচুর অর্থ দান করছেন, অনলাইনে শেয়ার করছেন সহজে রান্নার রেসিপি, ব্যায়ামের উপায়। সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার এই সময়ে সবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ইনবক্সে এসে জমা হচ্ছে পরিচিত-অপরিচিত বহু মানুষের মন ভালো করে দেওয়ার বহু ক্ষুদে বার্তা। অনেকে নিজের রেস্তোরা ব্যবসাগুলোকে দরিদ্র মানুষের জন্য খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রে রূপ দিয়েছেন।
৪. জোরালো হচ্ছে মৈত্রীর বন্ধন
নিজ কাজের ব্যস্ততার মাঝে অনেক সময় আমরা নিজেদের প্রতিবেশী এমনকি প্রিয়জনদের কথা ভুলে যাই। করোনা ভাইরাসের কারণে কিন্তু বিশ্বের অনেক দেশে সামাজিক সৌহার্দ্য বৃদ্ধির নজির দেখা যাচ্ছে।
ইতালিতে যখন মৃত্যুর উপত্যকা ঠিক তখনই একে-অপরের মনোবল বাড়াতে নিজ নিজ বাড়ির বারান্দা থেকে একযোগে গান গেয়ে একে-অন্যের মনোবল বাড়াচ্ছেন অনেক মহল্লার মানুষ।
দক্ষিণ স্পেনের একজন শরীরচর্চা পরামর্শক তার এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের মধ্যখানে অবস্থিত এক আঙ্গিনায় ক্লাসের আয়োজন করছেন। আর আশেপাশের বাড়ির বারান্দা থেকে সেই ক্লাসে যোগ দিচ্ছেন সেখানকার বাসিন্দারা।
বহু মানুষ এই সুযোগে বন্ধু ও প্রিয়জনের সঙ্গে ফোনে বা ভিডিও কলে বহুদিন বাদে আড্ডা জমাচ্ছেন। মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করে বন্ধুদের দলগুলো তাদের ব্যক্তিগত আড্ডায় 'ভার্চুয়াল পাব' সেশন চালু করছে। ঘর থেকে কাজ করা বিবিসির সংবাদকর্মীরাও এই দলে আছেন। আমরা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পরিবারের সংবাদ কর্মীরাও আছি এই দলে।
আরেকটি ভালো ব্যাপার যেটি হচ্ছে তা হলো; স্বাস্থ্য কর্মীদের পেশাগত ঝুঁকি নিয়ে এখন অনেক আলোচনা হচ্ছে। সরকার, বেসরকারিখাত এবং বিশ্ব জনতা এখন তাদের সুরক্ষা নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন।
ইউরোপে হাজার হাজার মানুষ তাদের বাড়ির বেলকনি থেকে হাততালি দিয়ে ভাইরাস প্রতিরোধ যুদ্ধের এই অগ্রসৈনিক ডাক্তার এবং নার্সদের অভিবাদন জানিয়েছেন। লন্ডনে চিকিৎসা শাস্ত্রের ছাত্ররা পেশাদার স্বাস্থ্য সেবা কর্মীদের বাচ্চাদের দেখাশোনা এবং বাড়ির অন্যান্য কাজ করে দেওয়ার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন।
৫. বাড়ছে উদ্ভাবনী শক্তি ও সৃজনশীলতা
কোটি কোটি মানুষ ঘরে বন্দি হয়ে মনমরা হয়ে থাকলেও, অনেকে কিন্তু এই সময়টাকে নানা উদ্ভাবনী কাজে লাগাচ্ছেন।
সামাজিক গণমাধ্যম ব্যবহারকারীদের অনেকেই বিচ্ছিন্ন থাকাকালে তাদের প্রিয় শখ যেমন নিত্যনতুন বই পড়া, রান্নাবান্না, সেলাই বা ছবি আকার অভিজ্ঞতা শেয়ার করছেন।
ওয়াশিংটন ডিসির পাবলিক লাইব্রেরীর মতো অনেক বড় বড় পাঠাগার এখন ভার্চুয়াল বুক ক্লাব খুলেছে। ইতালির মিশেলিন স্টারপ্রাপ্ত পাচক (শেফ) মাসিমো বোততুরা তার ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে 'কিচেন কোয়ারেন্টিন' নামক একটি নতুন ভিডিও সিরিজ পোস্ট করছেন। ভোজনরসিকের দল ঘরে বসে যেন সহজ রেসিপির মাধ্যমে মজার মজার সব রান্না করতে পারেন সেজন্যেই এই উদ্যোগ।
অস্ট্রেলিয়ার সিডনি মানমন্দির রাতের আকাশ আর নক্ষত্রদের নিয়ে বিশেষ ভিডিও সরাসরি সম্প্রচার করছে।
বিখ্যাত পপ শিল্পী কোল্ডপ্লে ব্যান্ডের ক্রিস মার্টিন এবং 'কান্ট্রি' ধাঁচের গানের জনপ্রিয় গায়ক কিথ আরবান নিজেদের মজার মজার সব অভিজ্ঞতার কথা অনলাইনে লাইভ সম্প্রচার করে মানুষের মনোবল অটুট রাখার চেষ্টা করছেন।