কে২ পর্বতশৃঙ্গে 'জনজট': একদিনে চূড়ায় উঠেছিলেন ১৪৫ আরোহী
এভারেস্ট হয়তো বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ, কিন্তু কে২-ও এভারেস্টের চেয়ে কোনো অংশে কম যায় না। এভারেস্টের উচ্চতা ৮,৮৪৮ মিটার, অন্যদিকে কে২ ৮,৬১১ মিটার উঁচু।
কে২ কারাকোরাম রেঞ্জে অবস্থিত। এ শৃঙ্গে বটলনেক নামক একটি অংশ রয়েছে যা অতিক্রম করা দুঃসাধ্য। ১৯৫৪ সালে এ পর্বতের চূড়ায় প্রথমবার ওঠার পর থেকেই বটলনেক পর্বতারোহীদের জন্য দুঃস্বপ্নের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই তো কয়েক বছর আগেও কেবল দুঃসাহসী পর্বতারোহী ছাড়া অন্যরা এ শৃঙ্গ চড়ার সাহস করতেন না।
কে২-এর চেয়ে এভারেস্টে চড়া অনেক সহজ বলে মনে করা হয়। সেজন্যই ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত পাওয়া উপাত্ত অনুযায়ী, মানুষের এভারেস্ট জয় করা হয়েছে ১০ হাজার ৬৫৮ বার। আর কে২'র ক্ষেত্রে এ সংখ্যা কেবল ৩৭৭।
কিন্তু হুট করে কিছু একটা বদল এসেছে। এ গ্রীষ্মে হঠাৎ করে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এ শৃঙ্গটি জয়ের জন্য লাইন ধরেছেন পর্বতারোহীরা। এর ফলে, সম্প্রতি কেবল একদিনেই ১৪৫ জন পর্বতারোহী কে২'র চূড়ায় উঠতে পেরেছেন। এ সংখ্যাটি ১৯৫৪ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত এ পর্বতে ওঠা মানুষের সংখ্যার সমান।
আর এ আরোহীরা ওঠার জন্য বেছে নিয়েছেন পর্বতটির সবচেয়ে কঠিন একটি স্থানকে। ঝুলন্ত শৈলশিরার নিচে সরু, খাড়া ওই প্যাসেজটি যেকোনো সময় ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই বটলনেকটি সবসময় তীব্র ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়েছে। এই এলাকায় হিমবাহ ও বরফের খণ্ড পতনেরও অনেক নজির রয়েছে।
২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে ১০ জন নেপালি পর্বতারোহীর একটি দল প্রথমবারের মতো শীতকালে কে২ জয় করে ইতিহাস গড়েন। ওই দলের নির্মল পুর্জা ও মিংমা জি এরপর থেকে নিজেরাই কে২'র চূড়ায় অন্য আরোহীদের পৌঁছে দেওয়ার ব্যবসায় শুরু করেছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নির্মল পুর্জা গর্বভরে জানিয়েছেন, তিনি একই দিনে কে২-এর চূড়ায় নিজের ৩৩ জন ক্লায়েন্টকে নিয়ে গিয়েছেন।
বসন্ত ও শরৎকালে হিমালয়ের আট-হাজারি পর্বতে ওঠা নিষেধ থাকায় নিজেদের আয়ের বিকল্প উৎস খুঁজতে শুরু করেন নির্মল ও মিংমা। এজন্য তারা বেছে নেন পাকিস্তানের পাঁচটি আট হাজারি পর্বতকে। বর্তমানে তাদের ক্লায়েন্ট আরোহীরা দলবেঁধে ওপরে ওঠার মাধ্যমে খুব সহজেই এ পর্বত জয় করছেন।
দুই গাইড এসব পর্বতের জন্য এভারেস্টে চড়ার কৌশল ব্যবহার করেছেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে যন্ত্রপাতি ও সুদক্ষ শেরপার নিশ্চয়তা। তারা পর্বতের শীর্ষ পর্যন্ত দড়ির ব্যবস্থা করেছেন। বিশেষত বটলনেক অংশে শক্ত রজ্জুর ব্যবস্থা কে২ চড়া অনেক সহজ করে দিয়েছে এ সময়ের পর্বতারোহীদের জন্য। এমনকি জট না বাঁধাতে ওঠা ও নামার জন্য আলাদা আলাদা দড়ির পথের ব্যবহার করেছেন নির্মল ও মিংমা।
এখন স্থানীয় কোম্পানি, নেপালি এজেন্সি, ও পশ্চিমা গাইডরা কে২-কে নিয়ে নতুন করে আগ্রহ দেখাচ্ছে। একসময় যে পর্বতকে কেবল সবচেয়ে দুঃসাহসী আরোহীদের জন্য বিবেচনা করা হতো, তা গত এক বছরে এভারেস্টের একটি প্রতিরূপে পরিণত হয়েছে। বাণিজ্যিক আগ্রহ, আবহাওয়ার পূর্বাভাস, দড়ির ব্যবস্থা, শতশত অক্সিজেন সিলিন্ডার, এবং বিশাল সংখ্যক নেপালি শেরপা- এগুলোই কে২-কে সব ধরনের পর্বতারোহীর কাছে আরোহণযোগ্য করে তুলেছে।
এ পর্বতে এখন আরোহীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪০০-এর কাছাকাছি। হাই-অ্যাল্টিটিউড ক্যাম্পের সংখ্যা কম হওয়ায় আরোহীদের স্থান সংকুলান হতে কষ্ট হচ্ছে। এমনকি জায়গা দখলের জন্য মারামারির কথাও শোনা গেছে। পর্বতটিতে তাপমাত্রা মাইনাস ১৭ ডিগ্রির মতো। এটিও চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে শেরপাদের জন্য। যাত্রাপথে পাথরের আঘাতে আহত হয়েছে তিনজন কর্মী।
এখন পর্যন্ত এ পর্বতে তিনটি মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটার কথা অনানুষ্ঠানিকভাবে জানা গেছে। তবে সেগুলোর কোনোটি বটলনেক এলাকায় ঘটেনি। তবে এ কথা মনে রাখতে হবে যে নেপালে ব্যক্তিগত হেলিকপ্টারে করে এভারেস্ট ও অন্যান্য আট-হাজারি পর্বত থেকে আরোহীদের উদ্ধার করা হয়। পাকিস্তানে সে কাজটা করে থাকে সেনাবাহিনী, তাও কেবল সামরিক কমান্ডের আদেশের অধীনে।
- সূত্র: এল পাইস