ভারতের অরণ্যকে পুনর্জীবন দিচ্ছেন যে নারী
তুলসী গোবিন্দ গৌড়া'র নিজের জন্মসাল মনে নেই। তবে বয়সটা যে ৮০ পেরিয়েছে সেটা বেশ বুঝতে পারেন তিনি। কর্ণাটকের বাসিন্দা এ নারী রাজ্যটির একটি বিশাল বিরানভূমিকে তিলে তিলে ঘন জঙ্গলে পরিণত করেছেন।
গত কয়েক দশক ধরে তার লাগানো চারার পরিমাণ ৩০ হাজারের বেশি।
এ কাজের জন্য অনেক পুরস্কার আর সম্মাননাও জুটেছে তার। পেয়েছেন ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার পদ্মশ্রীও। এ পুরস্কারের পর এখন তিনি সবার নজরের কেন্দ্রে। নিজের গ্রাম হোনালিতে এখন দলবেঁধে মানুষজন তাকে দেখতে আসেন।
স্কুলে বাচ্চারা বাসে করে তার বাড়িতে আসে। 'ওদের দেখলে ভালো লাগে,' বলেন তিনি। তাদেরকে বৃক্ষরোপণের উপকারিতার কথা বলেন তিনি।
রেললাইনের কাঠ ও জাহাজ তৈরির জন্য ব্রিটিশরা ভারতের অনেক বুনোপাহাড়ারের গাছ কেটে ফেলেছিল। তুলসী'র বাড়ি উত্তর কান্নাড় জেলা ব্রিটিশদের এরকম বৃক্ষনিধনের শিকার।
ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পরও ভারতে শিল্পায়ন ও নগরায়নের কারণে বৃক্ষনিধন অব্যাহত ছিল। সরকারি হিসাবমতে, ১৯৫১ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত দেশটির ৪২ লাখ জমি উন্নয়ন কাজের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।
ছোটবেলা থেকেই বন বাঁচানোর কাজ করেছেন তুলসী। পড়ালেখাটা আর করা হয়ে ওঠেনি। জঙ্গল থেকে কাঠ কুড়িয়ে আনতে যেতেন। মায়ের কাছে শিখেছিলেন কীভাবে বড়, স্বাস্থ্যবান গাছের বীজ থেকে নতুন গাছ তুলতে হয়। কিশোরী বয়সেরই বাড়ির পেছনে তৈরি করেছিলেন ঘন এক জঙ্গল।
১৯৮৩ সালে ফরেস্ট অফিসার আদুগোড়ি নানজাপ্পা ইয়েলাপ্পা রেড্ডি'র দায়িত্ব পড়েছিল কর্ণাটকে বড় একটি অনাবাদি জায়গায় বনায়ন করার। তিনি যে নার্সারিতে যোগদান করেছিলেন, সেখানে কাজ করতেন তুলসীও।
কাজের প্রথমদিনেই তুলসী'র সঙ্গে দেখা হয় তার। বর্তমানে ৮৬ বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত এ কর্মকর্তা স্মৃতিচারণ করেন, 'তার হাতে একপ্রকার জাদু ছিল। স্থানীয় গাছ চিনতে পারা, সযত্নে সংগ্রহ করা, ও বীজ থেকে চারা তৈরি নিয়ে তার যে জ্ঞান ছিল তা আপনি কোনো বইতে পাবেন না।'
স্থানীয়দের কাছে 'বৃক্ষদেবী' নামে পরিচিত তুলসী খালিপায়ে রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়ে পদ্মশ্রী গ্রহণ করেছিলেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, সারাজীবন পায়ে কখনো জুতো গলাননি। অবশ্য তার আদিবাসী গোত্রের জন্য এটি প্রচলিত একটি বিষয়।
তুলসীর গোত্রের নাম হালাক্কি-ভক্কালিগাস। তাদের সংখ্যা প্রায় ১৮০,০০০। তবে সরকার কখনো তাদেরকে তফসিলভুক্ত করেনি। ২০০৬ সাল থেকে তফসিলি স্বীকৃতির জন্য আবেদন করে যাচ্ছেন তারা।
তুলসীর গোত্রের শতকরা ৯৫ জন মানুষ গরীব। তাদের জেলার দশাও করুণ: রাস্তাঘাট ভাঙা, স্কুলগুলো চলে না, নেই কোনো জরুরি হাসপাতাল সেবা।
এই কয়েক মাসে তুলসীকে দেখতে তার বাড়িতে আসা মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেছে বলে জানান তিনি। তারা তার কাছে প্রায়ই জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে জানতে চান।
তুলসী বোঝেননা জলবায়ু পরিবর্তন কী। তিনি কেবল জানেন, পৃথিবীর গাছ এ প্রাণীর আবাসস্থল কেড়ে নিয়েছে মানুষ। বনজঙ্গল আর ইকোসিস্টেম ধ্বংস করেছে তারা।
তুলসী এটাও খেয়াল করেছেন, তারা এলাকায় বর্ষা মৌসুম এখন আরও বেখেয়ালি আর বিপজ্জনক। এ বর্ষা বন্যা আর ভূমিধসের মাধ্যমে মানুষের মরণ নিয়ে আসে।
'এ চিত্রের পরিবর্তন ঘটতে অনেক সময় লাগবে,' তুলসী বলেন। 'এই যে জঙ্গলের গাছগুলো দেখে আমার মনে হয়, মানুষ চাইলে এখনো গাছপালা না কেটেই উন্নয়ন ঘটাতে পারে,' আশা প্রকাশ করেন তিনি।
তুলসীর পুত্র ও পৌত্র নিজেদের ও অন্যের জমিতে কাজ করেন। কাঠ ও ঔষধের জন্য তারা জঙ্গলের ওপরেই ভরসা করেন। হালাক্কি-ভক্কালিগাস গোত্রের মানুষদের ভেষজ গাছপালা নিয়ে বিশেষ জ্ঞান সর্বজনবিদিত।
ক্রমেই শরীর ভেঙে আসছে বলে জানান তুলসী। আজকাল মৃত্যু নিয়ে বেশ ভাবেন তিনি।
'সবচেয়ে ভালো মরণ হবে শাখাপ্রশাখাযুক্ত বড় একটা গাছের নিচে মরতে পারলে। জীবনের অন্যকোনো কিছুর চেয়ে তাদেরকে আমি অনেক বেশি পছন্দ করি,' বলেন তুলসী।