মহাভারত থেকে ব্রিটিশ রাজ: ভারতবর্ষে বনভোজনের খাবারের ইতিহাস ও বৈচিত্র্য
'কারণ জানি না কিন্তু আমার বাড়ির রোজকার খাবারের চেয়ে বনভোজনের খাবার অনেক বেশি মজাদার লাগে!' ইংরেজ লেখক এনিড ব্লাইটনের লেখা 'দ্য ফেমাস ফাইভ' নামক কিশোর উপন্যাস সিরিজের বিখ্যাত উক্তি এটি। যারা বইগুলো পড়েছেন তাদের কাছে এ বাক্যটি নিঃসন্দেহে 'আইকনিক'।
এ উপন্যাস সমগ্রের চরিত্র জুলিয়ান, ডিক, অ্যান, জর্জ এবং তাদের পোষা কুকুর টিমির লোভনীয় বনভোজনের রোমাঞ্চকর গল্প পড়ে বড় হওয়া মানুষ আমি। তাদের মুখরোচক খাবারগুলোর স্বপ্নে বিভোর থাকতাম। তাই বড্ড অনুশোচনা হতো যে বাংলায় কাটানো আমার শৈশবের বনভোজনগুলোর কিয়দংশও কেন সেগুলোর মতো নয়!
পছন্দের গল্পগুলোর মতো চেরি কেইক, শসার স্যান্ডউইচ, ঘরে তৈরি হ্যাম, জ্যাম টার্ট, সেই বিখ্যাত জিঞ্জার বিয়ার কোনোটাই ছিল না। বনভোজনে আমার খাবারের থলেতে থাকত অল্প টোস্ট করা পাউরুটির ছোট ছোট ফালি, একটা ডিম সেদ্ধ, জয় নগরের মোয়া, একটা কলা, বাঙালির উপাদেয় মিষ্টান্ন এবং তাল-খেজুরের গুড়।
শুধু সেদ্ধ ডিমটুকু নিয়ে বাকি খাবার পাস করে দিতাম কেবল আমার স্বপ্নের ফেমাস ফাইভ বনভোজনগুলোর স্বাদ নিতে। তাই বলে বলছি না যে আমাদের খাবারগুলো একেবারেই মজাদার আর রঙ-বেরঙের ছিল না।
শীতের কোনো এক রোববারে আমাদের একান্নবর্তী পরিবার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের কাছাকাছি সবুজ মাঠের দিকে চলে যেত। হাতে থাকত নানা রঙের, নানা আকারের পাত্র। সেগুলোর ভেতরে থাকত বাঙালির শীতের খাবার। এই যেমন, শুকনো আলুর দম, করাইশুঁটির কচুরি, সবজির চপ, গাজর দিয়ে বানানো ক্রকেট (চপজাতীয়) আরও কত কী! পানীয় হিসেবে বড়দের জন্য থাকত দুধ চায়ের ফ্লাস্ক, আর আমাদের ছোটদের জন্য এক বক্স ম্যাঙ্গো ফ্রুটি।
আমি মোটামুটি সব ধরনের বনভোজনই উপভোগ করতাম। তবে একটার জন্য সবচেয়ে বেশি মুখিয়ে থাকতাম। আমার কাকার ক্লাবে যে বার্ষিক ভোজনের আয়োজন করা হতো তার জন্য। সেখানে উর্দি-পরা স্টাফরা একে একে সুস্বাদু স্যান্ডউইচ, কুচি কুচি করে কাটা মুরগির মাংস, ভাজা মাছের ভর্তা, খাসি মাংসের ক্রকেট পরিবেশন করে যেত। ফেমাস ফাইভ ফুডের সাথে যে হুবহু মিলে যেত তা নয়, তবে অন্তত কিছুটা হলেও তো সদৃশ ছিল!
ক্লাবের সেই মেন্যু ঔপনিবেশিক কোলকাতার অতীত স্বরণ করিয়ে দিত। পটলাক বনভোজনগুলো (যেগুলোতে সবাই একেকটা করে খাবার আনত) ছিল তখনকার সামাজিক কার্যকলাপের অবিচ্ছিন্ন অংশ।
ইতিহাসবিদ মেগান ইলিয়াস তার ২০১৪ সালে লেখা লাঞ্চ: আ হিস্ট্রি বইয়ে লেখেন, 'ব্রিটিশরা ভারতে উপনিবেশ নিয়ে আসার সাথে তাদের বনভোজনও নিয়ে আসে।' তাদের ঝুড়িতে ইউরোপীয় এবং ভারতীয় খাবার দুটো ধরণই থাকত: হ্যাম, নান বা পরোটা, স্ত্রিমরোল চিকেন (এ নামে ডাকা হতো কারণ হাড্ডি ছাড়ানো মুরগির মাংসকে আগে চ্যাপটা বানিয়ে তারপর ক্রাম মিশিয়ে ভাজা হতো), আলুর কাটলেট অথবা রিসোলস, সসেজ, মসলাদার গোশত, লেটুস এবং টমেটো। আর ফলের মধ্যে থাকত আলফান্সো আম ও এদেশীয় জুজুবি (খেজুরজাতীয়)।
এই বনভোজনগুলোকে পুরোটা খাবারকেন্দ্রিক এক সাদাসিধে আয়োজন ভাবলে ভুল হবে। তার প্রমাণ পাওয়া যায় জেনিফার ব্রেনান কারিস আন্ড বাগলস: আ মেমোয়ার অ্যান্ড কুকবুক অভ দ্য ব্রিটিশ রাজ বইয়ে। খাবার টেবিলগুলো ঢাকা থাকত ধবধবে সাদা স্নো হোয়াইট টেবলক্লথ দিয়ে, তার উপর সাজানো থাকত সিলভার কাটলারি, ক্রিস্টাল গ্লাস এবং হাত ধোয়ার জন্য ফিঙ্গার বোলস। আর সেই উর্দি-পরা ভৃত্যরা পরিবেশন করত কোল্ড শ্যাম্পেইন (লক্ষ্য ছিল সাহেবদের আভিজাত্য প্রদর্শন)।
প্রাচীন ভারতীয় বনভোজন
এ তো গেল ব্রিটিশ 'সাহেবদের' নিয়ে আসা কোল্ড শ্যাম্পেইনের 'আভিজাত' বনভোজনের ধরন। তা কেমন ছিল প্রাচীন ভারতের বনভোজন? এ অঞ্চলের মানুষ কিন্তু তখনও তাদের নিজেদের ঢঙে আমোদের জন্য বহিরাঙ্গনে খাওয়ার আয়োজন করত। ভারতীয় ধ্রুপদী শিল্পকলা ও সাহিত্যে তৎকালীন উচ্চবিত্ত শ্রেণির বনভোজন ও গার্ডেন পার্টির অহরহ উদাহরণ পাওয়া যায়।
কৌশাম্বীতে শুঙ্গ সাম্রাজ্যের (খৃষ্টপূর্ব ১৮৫-৭৩) সময়ে নির্মিত একটি টেরাকোটা ভাস্কর্যে এমনই একটি উদাহরণের দেখা মেলে। ভাস্কর্যটিতে খোদাই করা আছে 'রথে করে কয়েকজনের একটি দল বনভোজনের উদ্দেশ্যে কোথাও যাচ্ছে'। বেশ স্পষ্টভাবেই বোঝা যায় সবার মাঝখানে রাখা আছে রাঁধা খাবার, সাথে কিছু ভাত, মিষ্টি, গোল কেইক আরও কত কী!
তবে এর চেয়েও ঢের জাঁকালো বনভোজনের দেখা মেলে মহাভারতে। মহাকাব্যটিতে বর্ণিত এক বনভোজন এতটাই বিলাসবহুল যে পণ্ডিত রাজেন্দ্রলাল মিত্র সেটাকে টিউটনিক নাইটসদের ক্যারোসেল'র সাথে তুলনা দেন। কৃষ্ণ, বলরাম এবং অর্জুনের ওই বনভোজনে ছিল সব ধরনের অ্যালকোহল।
পাকা কদম থেকে বানানো কদম্বরি, মহুয়া ফুলের পাপড়ি দিয়ে তৈরি মাধবিকা, দেশি মদ ও সুগন্ধি ফুলের রাম (এক প্রকার মদ)। এছাড়াও ছিল মাংসের রোস্ট ও তরকারি; ডালিম ও তেঁতুলের সস; সরেল, আম ও আচার দিয়ে সেদ্ধ হরিণের মাংস। আরও ছিল ঘি মাখিয়ে লেবু, পুদিনা, হিং, ডালিম সাজানো হরেক রকমের রাঁধা মাংস। খাবার টেবিল এমনভাবে সাজান থাকত তাকালে প্রথমেই চোখে পড়ত শিকের গাঁথান ঘি মাখান মহিষের মাংস।
খৃষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে বাৎস্যায়নের রচিত কামসূত্রে 'উদয়ন যাত্রা'র কথা পাওয়া যায়। এগুলো ছিল বিত্তবানদের দিনব্যাপী বনভোজন। সাথে থাকত তাদের গণিকারা। ভৃত্যরা একে একে খাবার এনে দিত। বনভোজন শেষে মনিবেরা স্মৃতিচিহ্ন স্বরূপ নিয়ে যেত গাছের কোনো ডাল, পাতা কিংবা কোনো বুনোফুল।
জাঁকালো বনভোজনে মোগল সম্রাটরাও পিছিয়ে ছিল না। তারা তাদের সভাসদদের সাথে নিয়ে সুসজ্জিত বাগানে বসে আমোদ করত; কখনও কখনও বসত চাঁদের আলোয়, খোলা আকাশের নিচে। এক্ষেত্রে পারস্য শিল্পী মীর সাঈদ আলীর ষোল শতকের সেই বিখ্যাত চিত্রকর্মের কথা আনা যেতে পারে। 'তিমুরের রাজকন্যা' নামের সেই চিত্রকর্মে দেখা যায় একটি প্যাভিলিওনের বসে আছে হুমায়ূন। তার রাজকীয় ভৃত্যরা চিনার গাছের ছায়া বসা অতিথিদের এনে দিচ্ছে খাবার ও পানীয়।
আরেক চিত্রশিল্পী চার্লস বাস্কারভাইলের ছবিতে আরও সাম্প্রতিক রাজকীয় বনভোজের বর্ণনা পাওয়া যায়। তিনি বলেন, ১৯৩৭ সালে জয়পুরের মহারাজা এক মহাভোজের আয়োজন করেন যেখানে খাবারগুলোকে একটা লরিতে করে পাঠাতে হয়েছিল। সেদিন ব্যঞ্জন হিসেবে ইউরোপীয় খাবারের পাশাপাশি ছিল হরেক রকমের দেশীয় খাবার; বন্য শূকরের মাথার তরকারি এবং ঝাল করে বাটা পালং শাকের ভাজি। আর হুইস্কি, বিয়ার, গিমলেট (লেবুর শরবর জাতীয় পানীয়), সাইডার এবং জল তো আছেই!
প্রথায় পরিণত
প্রাচীন রাজকীয় বনভোজনগুলোয় থাকত 'মাত্রাতিরিক্ত' বিলাসিতা। আর অন্যদিকে সাধারণ মানুষের বনভোজনের মূলে থাকত প্রকৃতির প্রতি সহজাত টান।
ভারতের বহু অঞ্চলে বহিরাঙ্গনে একসাথে খাওয়ার কাজটি এখন প্রথায় পরিণত। ভারতীয় সব সম্প্রদায়েরই স্বতন্ত্র 'বনভোজন-খাবার' রয়েছে।
তামিল মাসের ১৮তম দিনে তামিলনাডুর লোকজন কবেরি কিংবা অন্য নদীর ধারে 'আদি পেরুক্কু' উদযাপন করতে জড়ো হয়। দিনটিতে মূলত বর্ষার আগমনকে কেন্দ্র করে নদীতে পুজো দেওয়া হয়। এর পরপরই শুরু হয় আল ফ্রেসকো বনভোজন। নদীর তীরে আয়োজন করা এ ভোজনোৎসবে থাকে বেশ কয়েক রকমের ভাত; মসলাদার সুগন্ধ ভাত, লেবুর ভাত, তেঁতুল ভাত, নারিকেল ভাত, দই ভাত ইত্যাদি। লেখিকা সুধা তিলকের জানান এ খাবারগুলো কলাপাতায় মুড়িয়ে প্যাক করতে সুবিধে হয়।
এর পাশের রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশে কার্তিক মাসের সেরা আকর্ষণ হলো 'কার্তিক বনভোজনালু'। এদিনে কোনো আমলা গাছ বা ভারতীয় গুজবেরি গাছের নিচে বসে খাওয়ার বিধান প্রচলিত। হিন্দু পুরাণে বর্ণিত যে পাঁচ ধরণের গাছে ভগবান বাস করে আমলা গাছ তার মধ্যে একটি। এ গাছের নিচে বসে আহার করলে শারীরিক বিশুদ্ধি আসে বলে বিশ্বাস করা হয়। কার্তিক বনভোজনালুতে সাধারণত নিরামিষ খাবারের আয়োজন থাকে যেমন পুলিহোরা অথবা তেঁতুল ভাত, মচমচে পেঁচান ভাদিয়ালু, পুন্নুকুলু, মিষ্টি পুর্নালু, মসলাদার ডাল এবং আরও অনেক তরকারি।
তামিল নাডুর রভুথার মুসলিম সম্প্রদায়ের খাবারের অন্যতম এক চ্যাম্পিয়ন হাজিরা সায়েদ। তার কাছ থকে জানা যায় তিরুনেলভেলিতে ঝর্ণাগুলোতে বনভোজন করার একটা রেওয়াজ আছে। বর্ষাকালের নিয়মিতভাবে পালিত এ ভোজনগুলোতে থাকে নারিকেল দুধের ভাত, তেঁতুল ভাত, মাংস, পেঁয়াজের কোরমা ও বেগুন চাটনি। খাবার বাড়ি থেকে রেঁধে নিয়ে আসা হয় অথবা ভোজনের স্থানে তাবু বানিয়ে সবাই মিলে রাঁধা হয়।
চড়ুইভাতি
বাংলায় চিরাচরিত বনভোজনগুলোকে বলা হয় চড়ুইভাতি। এগুলো সাধারণত বড় কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই হুটহাট করে সেড়ে নেওয়া হয়। বাড়ি থেকে যে যা উপকরণ পারে এনে একটা খোলা জায়গায় চুলা বানিয়ে সাদামাটা খাবার রান্না করা হয়। ছেলেমেয়ে উভয়ে নিজেদের কাজ বুঝে নেয়; কাটাকুটোর কাজ সাধারণত মেয়েরাই করে আর রান্নার কাজটা করে ছেলেরা।
প্রতি বছর শীতে আমার বাঙালি পরিবারও বনভোজনের আয়োজন করে। চিনসুরার পাশের একটি গ্রামে আমাদের এক খামারবাড়ি আছে। সেখানেই হয় এ আয়োজন। তবে আমাদের এই চড়ুইভাতি ধাঁচের পারিবারিক বনভোজনগুলোতে নিজেদের আর রাঁধা হয় না। চন্দননগর থেকে আসা ভাড়াটে রাধুঁনিরা বিশাল এক সামিয়ানা টাঙিয়ে মজার মজার খাবার রাঁধতে বসেন। ভাজা মাছের মাথা দিয়ে ডাল, বেগুন ভর্তা, আলু আর বরবটিসহ বাধাকপি, সরিষার তেল দিয়ে নিজেদের পুকুরের মচমচে ভাজা মাছ, আর গরম গরম ভাত তো আছেই! তবে ভোজনের মূল আকর্ষণ হলো বাতাবিলেবুর অল্প রস মেশানো খাসীর লালচে বাদামী তরকারি। এটি সারাবছরই আমাদের ভাতের পাতে থাকে, তবে শীতের সূর্যের নিচে খেতে একটু বেশিই সুস্বাদু লাগে।
ভাষান্তর: নীতি চাকমা