স্টুডিও পদ্মা: ৩৭ বছর ধরে তারকাদের প্রিয় যে ফটো স্টুডিও
"৪০০, নিউ ইস্কাটন রোড– এক অভিজাত ঠিকানা। একটা ছোট দোতলা মার্কেট ছিল এখানে। নিচে ১০টা দোকান, ওপরে আরও ১০টা। এখানেই ছিল, অভিনেতা আমিরুল হক চৌধুরীর 'ঢাকা কফি হাউজ'। তার পাশেই 'স্টুডিও পদ্মা'। কফি হাউজের আড্ডায় জড়ো হতেন দেশের বিখ্যাত সব অভিনেতা, গায়ক, সাংবাদিক আর রাজনীতিবিদেরা। যেই আড্ডা ছড়িয়ে পড়ত স্টুডিও পদ্মা জুড়েও। সেসময় পদ্মা শুধু ছবি তোলার জায়গা ছিল না– তার চেয়েও বেশি ছিল তারকাদের মিলনমেলা," স্মৃতিচারণ করছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম আলোকচিত্রী আক্কাস মাহমুদ। স্টুডিও পদ্মার কর্ণধার তিনি।
বাংলামোটর থেকে মগবাজার মোড়ে যাওয়ার পথে এখনো পথচারীদের চোখ আটকায় স্টুডিও পদ্মার দরজায়। উত্তর ঢাকার প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের বিশাল এক পোর্ট্রেট টাঙানো সেখানে। দরজা খোলে ভেতরে ঢুকলে চোখে পড়ে জয়া আহসান, চঞ্চল চৌধুরী, সাবিনা ইয়াসমিন, মুন্নী সাহা, সাকিব আল হাসানের মতো নানান অঙ্গনের তারকা-বিখ্যাতজনদের ছবি। এখনো পদ্মার নিয়মিত গ্রাহক তারা। আশির দশকে শুরু হওয়া এই স্টুডিও কীভাবে ৩৭ বছর পরও তার জনপ্রিয়তা টিকিয়ে রেখেছে– তা নিয়েই আলাপ হয় আক্কাস মাহমুদের সাথে।
অন্যধারার এক স্টুডিও পদ্মা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষে কিছুদিন সাংবাদিকতায় যুক্ত ছিলেন আক্কাস মাহমুদ। তারুণ্যের পত্রিকা 'সাপ্তাহিক বিচিন্তা'য় কাজ করতেন তিনি। এরপর ফটোগ্রাফির প্রতি ঝোঁক থেকেই নানা ফ্যাশন ফটোগ্রাফি ম্যাগাজিন ঘাঁটতে গিয়ে নতুন ধরনের ফটো স্টুডিওর চিন্তা আসে মাথায়। বিখ্যাত আলোকচিত্রী মনজুর আলম বেগের প্রতিষ্ঠান বেগার্ট ইনস্টিটিউট অভ ফটোগ্রাফি থেকে ডিপ্লোমা করেন তিনি।
"বেগ স্যার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন কী করতে চাই। তখন জানিয়েছিলাম, আমার ফটো স্টুডিও গড়ার ইচ্ছার কথা। স্যার অবাক হয়ে বলেন, 'ফটো স্টুডিওর জন্য তো কেউ প্রশিক্ষণ নিতে আসে না। তুমি কেন আসলে!' তখন আমি বললাম, বাংলাদেশে ফটো স্টুডিও তো অনেক আছে; কিন্তু আসলেই স্টুডিও বলতে যা বোঝায়- তা খুব কম। আমি একটা অন্যধারার স্টুডিও খুলতে চাই। যেখানে আধুনিক সব সরঞ্জাম থাকবে, অভিজাত তারকারা ছবি তুলতে আসবে। শুধু ছবি তোলার জায়গা হবে না সেই স্টুডিও। ছবি নিয়ে আড্ডা, পড়াশোনা সবই হবে সেখানে। উত্তর শুনে স্যার খুব এপ্রিশিয়েট করলেন আমাকে" – বলছিলেন আক্কাস মাহমুদ। পোর্ট্রেট ছবির জন্য দেশের সেরা আলোকচিত্রী হিসেবে পরিচিত হওয়ার স্বপ্ন ছিল তার।
পরবর্তীতে কলকাতার 'গ্লোবাল প্রেস এজেন্সি' থেকেও ডিপ্লোমা করেন তিনি। ১৯৮৫ সালে ইস্কাটনের খুরশিদ মহল মার্কেটের ২০ ফুট বাই ৬ ফুটের একটি দোকানে শুরু করেন স্টুডিও পদ্মা। ইস্কাটন তখন ঢাকার অন্যতম কূটনৈতিক এলাকা। চীন, পাকিস্তান, ইতালি আর ফ্রান্সের দূতাবাস ছিল এই ইস্কাটনেই। বিদেশি রাষ্ট্রদূতসহ সরকারি সচিব-আমলা, দেশসেরা অভিনেতা-অভিনেত্রী, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকদের বাস ছিল এখানে।
স্টুডিও পদ্মার ছবি আর কফি হাউজের বিখ্যাত কাটলেট, আলুর চপের মোহে নানান অঙ্গনের তারকারা জড়ো হতেন ৪০০, ইস্কাটন রোডের ঠিকানায়। বরেণ্য অভিনেতা গোলাম মোস্তফা, হাসান ইমাম, আসাদুজ্জামান নূর, আলী জাকের, আফজাল হোসেন, সাংবাদিক মিনার মাহমুদ, লেখক তসলিমা নাসরিন, নায়ক সালমান শাহ, গায়ক আব্দুল জব্বার তো নিয়মিতই আসতেন।
আক্কাস মাহমুদের ভাষ্যে, "স্টুডিও-কেন্দ্রিক এই আড্ডায় সাংবাদিক মিনার মাহমুদ একদিন না আসলে তার পেটের ভাত হজম হতো না! গোলাম মোস্তফা ভাইয়ের যেদিন শ্যুটিং থাকতো না– সেদিন একদম ঘড়ি ধরে ঠিক সময়ে চলে আসতেন বনানী থেকে ইস্কাটনে। প্রডিউসাররা তাকে খুঁজতেও আসত এখানে। নাটক-সিনেমার চুক্তি, এডভান্স নেওয়া সবই চলতো আড্ডার ভেতর। সেসময় মার্কেটের সামনের রাস্তায় রিকশা দিয়ে যাওয়ার সময় মেয়েরা ঘাড় ঘুরিয়ে এদিকে তাকিয়ে থাকত প্রিয় তারকাদের দেখতে। বিখ্যাত তারকাদের এক নজর দেখা পাওয়ার আশায় এফডিসির মতো ভিড় জমতো এই মার্কেটের সামনেও!"
এখানকার সেই আড্ডার সূত্র ধরেই মার্কেটের দোতলায় আরেকটি ঘর ভাড়া নিয়ে শুরু হয়েছিল 'মুক্তিযুদ্ধ ও ললিতকলা গ্রন্থ কেন্দ্র'। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক আড্ডা, তর্ক, গল্পের ঝড় উঠত সেখানে। সাথে চলতো মুড়ি ভর্তা খাওয়া আর টিভি দেখা।
স্টুডিও পদ্মার সে সময়কার এনালগ ফোন নম্বর ছিল ৪১২০৭০। তখনকার দিনের বহু যুবকের প্রিয় নম্বর ছিল সেটি। বুয়েট, ঢাবির শিক্ষার্থীরা পত্রিকায় টিউশনের বিজ্ঞাপনে, প্রিয়জনদের আলাপে ব্যবহার করত এই টেলিফোন নম্বর। সাংবাদিক মিনার মাহমুদ আর তসলিমা নাসরিনের প্রেমের সাক্ষীও ছিল সেই টেলিফোন।
সাবেক রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সেই দোতলা খুরশিদ মহল মার্কেট ভেঙ্গে বহুতল বিল্ডিং হয়ে যাওয়ার পর– অনেকটাই ভাটা পড়ে স্টুডিও পদ্মা আর কফি হাউজের আড্ডায়। আগের সেই জৌলুস না থাকলেও আজো আড্ডাপ্রিয়রা ভুলে যাননি স্টুডিও পদ্মাকে। সাংবাদিকরা আসেন এখনো। দেশের রাজনীতি, সমাজনীতি, গান-বাজনা, ট্রেড ইউনিয়ন, সাংবাদিক ইউনিয়ন সব কিছু নিয়েই চলে গল্প। এই সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময়ই স্টুডিও থেকে ছবি নিতে এসে আড্ডায় মেতেছিলেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক সুকান্ত গুপ্ত অলক। তার কাছে স্টুডিও পদ্মা এক আবেগের জায়গা।
স্টুডিও পদ্মায় তোলা ছবিতে তারকা বনেছেন অনেকেই
"সময়টা ১৯৮৬ বা ১৯৮৭ সালের দিকে হবে। তখন এফডিসি একটা সার্কুলার দিলো 'নতুন মুখের সন্ধানে'। তারা ক্রাইটেরিয়া দিলো প্রত্যেক ক্যান্ডিডেটের পোস্টার সাইজের তিন এঙ্গেলের তিনটা ছবি জমা দিতে হবে। সেটার জন্যও আমাদের এখানে অনেকেই ছবি তুলতে আসতো। মজার ব্যপার হলো- তখন স্টুডিও পদ্মায় ছবি তুলতে এসেছিলেন সোহেল চৌধুরী, মান্না, দিতি। এরা আমাদের এখান থেকে ছবি তুলেই স্টার হয়েছেন। ছবি দেখিয়ে সুযোগ পাওয়ার পর তারা আমাদের সাথে দেখা করেও গিয়েছেন। মান্না আর সোহেল চৌধুরী দুজনেই এসে বলছিলেন 'আপনার ছবি দিয়েই আমি নায়ক হয়েছি" – স্মৃতির ঝুলি হাতরে বলেন আক্কাস মাহমুদ।
সে সময়ের আরেক মজার স্মৃতি মনে করে তিনি বলেন, "সে সময়ে পোস্টার সাইজের প্রতি ছবিতে খরচ পড়তো ৩০ টাকা করে। যেটা একটা বড় এমাউন্টই ছিল। সাধারণত মানুষজন ছবি তোলায় হিসেবি হত তখন। পাঁচ-ছয়টা পোজে ছবি তুলেই বন্ধ করে দিত। কিন্তু, সোহেল চৌধুরী ছবি তুলতে এসে বলেছিল আপনি তুলতে থাকেন। যত রোল খরচ হয়- অসুবিধা নাই। আমি টাকা দিয়ে দিব। দুই রোল ছবি তোলার পর আমিই টায়ার্ড হয়ে গেছিলাম। বলছিলাম, 'সোহেল ভাই, আর লাগবে না। এটার মধ্য থেকেই আপনি চান্স পেয়ে যাবেন'। তিনি বললেন, 'আরেকটা শট বাকি আছে'। তখন তিনি বের হয়ে একটা অডিও প্লেয়ার নিয়ে আসলেন। বললেন, 'এখানে অডিও বাজবে, আমি ডান্স করব, আর আপনি ছবি তুলে দিবেন'। তার নাচের মাঝেই পোজ দিয়ে ছবি তোলা হলো শেষে। এই ঘটনাটা খুব মনে পড়ে আমার। পরবর্তীতে সোহেল চৌধুরী অনেক বড় স্টার হয়েছিলেন"।
মডেল ফটোগ্রাফিও করতেন আক্কাস মাহমুদ। মৌ, নোবেল, তানিয়া, পল্লবকে প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়ে খুলেছিলেন 'কারুজ মডেলিং এজেন্সি'।
ফিল্ম রোলের যুগে পদ্মা
আশির দশকে যখন স্টুডিওতে এনালগ ক্যামেরার ফিল্ম রোলে সাদা-কালো ছবিই ভরসা– তখন কেমন ছিল পদ্মার কাজ সে উদাহরণও দিলেন আক্কাস মাহমুদ। সেসময় স্টুডিওতে বাটি লাইটে ছবি তোলা হত। যেগুলো থেকে উৎপন্ন হত প্রচুর তাপ। গরমে স্টুডিওর ভেতর ঘেমে নেয়ে একাকার হতেন আলোকচিত্রী। সকালে স্টুডিওতে আসার সময় এক্সট্রা পাঞ্জাবি নিয়ে আসতেন আক্কাস। যেন অর্ধেক দিন কাজ করে, ঘামে ভেজা জামা পাল্টে নেওয়া যায়।
ছবি এডিটিং-এও ছিল নানান কায়দা। সেসময় তো আর ফটোশপের সুবিধা ছিল না। একটা ফিল্মে ১২টা ছবি হতো; যা করার ফিল্ম নেগেটিভের উপর সরাসরি হাতের নৈপুণ্যেই করতে হত। ছবির নানান খুঁত ঢাকার জন্য প্রথমে সরু পেন্সিল ব্যবহার করতেন আক্কাস মাহমুদ। একটা ১০০ পাওয়ারের লাইটের সামনে দুই-আড়াই ইঞ্চির নেগেটিভ ধরে ছবির সব খুঁটিনাটি দেখা হত প্রথমে। যেসব জায়গায় এডিট করা দরকার সেখানের সাদা রঙের উপর পেন্সিলে দাগ দিয়ে সমান করা হত। কিন্তু, পেন্সিলের কাজটা পুরোপুরি মসৃণ হতো না। সেজন্য পরবর্তীতে চিকন তুলির সাহায্যে পাতলা আলতার প্রলেপ দিয়ে দাগ মুছে ফেলা হত নেগেটিভে। এরপর ওয়াশ করলে ছবি বেশ 'স্মুদ' আসতো।
এখনো ১৯৮০-৯০ দশকের ছবির নেগেটিভ কপি সযত্নে রাখা আছে স্টুডিও পদ্মায়। তখন ৪ কপি পাসপোর্ট সাইজ ছবি তুলতে খরচ হতো ২৫ টাকার মতো। সেসময়ে সাদা-কালো ছবি ডেলিভারিতে সময় লাগতো তিন-চার দিন, আর রঙিন ছবিতে আট-দশ দিন।
উৎসব মানেই ছিল স্টুডিওতে গ্রুপ ছবি
"এখন স্টুডিও ফটোগ্রাফিটা আর আগের জায়গায় নাই। এই যে আপনার সাথে এতক্ষণ আলাপ করছি, আজ থেকে ২০ বছর আগে আসলে, সময়টা কোনোভাবেই দিতে পারতাম না হয়তো। কারণ এ সময়ে স্টুডিওটা থাকতো কাস্টমারে ভরা। তখন ঈদের দিন মানুষের প্রথম কাজ হতো নতুন কাপড়-চোপড় পরে, নামাজ পড়ে, সেমাই খেয়ে স্টুডিওতে এসে একটা গ্রুপ ছবি তোলা। তখন তো আর ডিজিটাল স্টুডিও ছিল না। স্টুডিওতে একটা সিনারি আঁকা থাকতো ব্যাকগ্রাউন্ডে। ঝর্ণা, নৌকা, গাছপালার আবহ করা। পরিবার বা বন্ধুবান্ধব নিয়ে সেজেগুজে স্টুডিওতে এসে– সেই ব্যাকগ্রাউন্ডের সামনে ছবি তুলতেন মানুষজন" জানান আক্কাস মাহমুদ।
উৎসব কেন্দ্রিক এখন ফ্যাশন হাউজের যেমন বিশেষ প্রস্তুতি চলে, আগের দিনে স্টুডিওতেও চলতো সেই প্রস্তুতি। দুই ঈদ আর পহেলা বৈশাখে স্টুডিও মালিকদের লক্ষ্য থাকতো সারা বছরের খরচ তুলে নেওয়ার। উৎসবের আগে একদিন স্টুডিও বন্ধ রেখে, পুরো স্টুডিও রঙ করা, ব্যাকগ্রাউন্ডের জন্য নতুন দৃশ্য আঁকা, বাইরে আলোকসজ্জা করা ছিল সেই প্রস্তুতির অংশ।
স্টুডিও পদ্মাকে টিকিয়ে রাখাই এখন লক্ষ্য
হাতে হাতে স্মার্টফোন, ক্যামেরার যুগে আয়োজন করে স্টুডিওতে ছবি তোলার চল আর নেই বর্তমানে। পদ্মায় এখন বেশি তোলা হয়– বিভিন্ন দেশের ভিসার জন্য অফিশিয়াল ছবি। পাসপোর্ট সাইজের ছবির জন্য এই সময়েও ঢাকার বিভিন্ন প্রান্ত, এমনকি বাইরের জেলা থেকেও স্টুডিও পদ্মায় অনেকেই আসেন ছবি তুলতে। স্টুডিও পদ্মার প্রতি ভালোবাসা থেকেই এই গ্রাহকরা আসেন বলে মনে করেন আক্কাস মাহমুদ।
এ ছাড়াও ফ্যাশন ফটোগ্রাফি, নিউজ প্রেজেন্টার হিসেবে অডিশনের ফটোগ্রাফি, নির্বাচনী প্রচারণার পোস্টারের ছবি তোলার জন্য অনেকের কাছেই স্টুডিও পদ্মাই সেরা গন্তব্য।
বর্তমানে স্টুডিও পদ্মার ফটোগ্রাফার টিমে আছেন পাঁচ জন। বিয়ের ফটোগ্রাফির জন্য 'ওয়েডিং কালারস' নামে আক্কাস মাহমুদের আছে আলাদা টিম। নানান সময়ে ফটোগ্রাফি বিষয়ে বিভিন্ন কোর্সে ক্লাস নেন তিনি।
তার মতে, দেশে প্রতি মাসে ৩০টা করে স্টুডিও আর ৫টা করে কালার ল্যাব বন্ধ হয়। এই সময়েও স্টুডিও টিকিয়ে রাখাই একটা বড় চ্যালেঞ্জ। তবু ফটোগ্রাফি জগতের অভিজাত ঠিকানা 'স্টুডিও পদ্মা'কে সবসময় চলমান রাখাই আক্কাস মাহমুদের লক্ষ্য। ডিজিটাল যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আরও আধুনিক সরঞ্জামে সবসময় সমৃদ্ধ রাখতে চান তিনি স্টুডিও পদ্মাকে।