খোশবাস নয়, ঢাকাইয়া কুট্টি নয়, তারা হলেন সোব্বাসী
ফেসবুকে 'সোব্বাসী' লিখে খুঁজলেই চলে আসে অনেকগুলো গ্রুপ। সেগুলোর কোনোটি শুধু ভাষা নিয়ে কাজ করছে, কোনোটি কাজ করছে পুরো গোষ্ঠী নিয়েই। কাজকর্মে কিছু ভিন্নতা থাকলেও উদ্দেশ্য সবার একটাই: সোব্বাসীদের টিকিয়ে রাখা। কিন্তু, কারা এই সোব্বাসী?
সোব্বাসী হলো- একটি ঢাকাইয়া গোষ্ঠী, যারা সোব্বাস ভাষায় কথা বলে। এই সোব্বাস শব্দটি এসেছে সুখবাস থেকে। সোব্বাস ঢাকাইয়ারা 'সুখ'কে বলে 'সোখ'। সুখে বাস করে বলে তাদের সুখবাস বলা হয়। সুখবাস থেকে সোখবাস, আর তা থেকে সোব্বাস। অর্থাৎ, সুখবাস> সোখবাস> সোববাস> সোব্বাস> সোব্বাসী।
কেন তাদের সোখবাস বলা হতো?
সুবেদার ইসলাম খাঁ ১৬১০ সালে ঢাকায় এসেছিলেন বিরাট এক বহর নিয়ে। উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম ভারতীয়, আফগান, ইরান-আরবি লোকজনও ছিল বহরে। আর সুবেদারের লোক বলে তাদের ঠাটবাটও ছিল আলাদা, পয়সাকড়িও ছিল বেশ। এ কারণেই বোধহয় আনিস আহমেদ ঢাকাইয়া আসলি গ্রন্থে বলে গেছেন, 'বহিরাগত পশ্চিম ভারতীয় ও পশ্চিমা অভারতীয়রা (ইরান-আফগান) নিজেদের সোব্বাস বা অভিজাত শ্রেণী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।' অনেকেরই তা-ই ধারণা — সুখে বসবাস করেন বলেই তাদের নাম হয়ে যায় সোব্বাসী।
তবে এ নামকরণ যে কারা করেছিলেন, তা জানা যায়নি।
মিশ্রিত ভাষা সোব্বাসীর উৎপত্তি
যেহেতু এ বহিরাগতরা বিভিন্ন ভূখণ্ড থেকে এ অঞ্চলে এসেছিলেন, তাই তাদের মুখের ভাষাও ছিল ভিন্ন ভিন্ন। নিজেদের মধ্যে তারা নিজেদের ভাষাতে কথা বললেও, বাইরের কারও সঙ্গে কথা বলতে হতো সাধারণ এক ভাষায়। আর সে ভাষাটি ছিল 'হিন্দুস্তানি' ভাষা। হিন্দুস্তানি ভাষাটি এসেছে খারিবুলি ভাষা থেকে। ভারতবর্ষের দরবারে তখন এ খারিবুলি ভাষাতেই কথা বলতে হতো। দাঁড়িয়ে বলতে হতো বলে তার নাম হয়েছিল খারিবুলি ভাষা। এ ভাষাটাই যখন বাইরে ছড়িয়ে গেল তখন সেটা হয়ে গেল হিন্দুস্তানি ভাষা।
আনিস আহমেদ তার ঢাকা পাঠ গ্রন্থেও এমনটাই লিখেছেন: '১৬১০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে পরবর্তী ৩০০ বছর যেসব পশ্চিম ভারতীয়, আফগান, ইরান-আরবিয় তথা বহিরাগত মুসলমান-হিন্দুরা ঢাকায় এসে বসতি স্থাপন করে, তারা এবং তাদের বংশধরেরা যে ভাষায় কথা বলত, সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা করতো এবং সামাজিক রীতিনীতি মেনে চলতো, তাকে এক কথায় ঢাকার হিন্দুস্তানি ভাষা ও হিন্দুস্তানি লোকসাহিত্য-সংস্কৃতি বলে অভিহিত করা যায়।'
তবে এ হিন্দুস্তানি ভাষারও কিন্তু কোনো লিখিতরূপ ছিল না। আমরা যেমন পরিবারের বাইরে কারও সঙ্গে কথা বলতে গেলে আঞ্চলিক ভাষার পরিবর্তে চলিত কথ্য বাংলা ভাষায় কথা বলি, তারাও তখন একইভাবে হিন্দুস্তানি ভাষায় কথা বলতেন। লেখার ভাষা তখন ছিল কেবলই ফারসি।
তবে ভাষা কখনো আটকে থাকে না। নদীস্রোতের মতোই সদা প্রবহমান ভাষা। ফলে আরবি, ইংরেজি, গুজরাটি, তুর্কি, পালি, পর্তুগিজ, ফরাসি, ফারসি, মুণ্ডা, সংস্কৃত, বাংলা, হিন্দুস্তানি — ঢাকায় বসবাসকারী পরিবারগুলোর মধ্যে এইসব ভাষা ও সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটতে থাকে দিনে দিনে। সোব্বাসী ভাষা এ মিশ্রণ ও সংমিশ্রণেরই ফলাফল।
সোব্বাসী একটি ঢাকাইয়া উপভাষা
সোব্বাসী ভাষা রক্ষায় দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছেন অনেক সোব্বাসী। এদের মধ্যে একজন মো. শাহাবুদ্দিন সাবু। তিনি সাভার সরকারি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত। তিনি বলেন, 'সোব্বাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত কথ্য হিন্দুস্তানি ভাষার ওপর ১৬১০ থেকে ১৮৩০ সাল পর্যন্ত ফারসি, ১৮৩১ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ইংরেজি ও উর্দু, ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত উর্দু, ১৯৭১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বাংলা ভাষার প্রভাব ছিল। ভাষাটি মূলত ১৪টি ভাষার মিশ্রিত রূপ। এ ভাষার ৬০ শতাংশই সংস্কৃত-বাংলা শব্দ। কারণ হিন্দুস্থানি ভাষা যখন এ অঞ্চলে আসা শুরু করল, তখন সেটা সংস্কৃত দ্বারা প্রভবিত হওয়া শুরু করলো।'
আজকের বাংলা ভাষা আর আঠারো শতকের বাংলা ভাষার মধ্যে যেমন অনেক তফাৎ, ঠিক সেভাবেই তখনকার হিন্দুস্তানি ভাষা আর এ চারশো বছর পর আজকের হিন্দুস্তানি (কথ্য সোব্বাসী) ভাষাতেও রয়েছে অনেক তফাৎ। কিন্তু, দুঃখের বিষয় সোব্বাসীর কোনো লিখিতরূপ নেই। এটি কেবলই একটি ঢাকাইয়া উপভাষা হিসাবে থেকে গেছে।
ঢাকাইয়া কুট্টি তবে কারা?
অতএব সোব্বাসীরা হলো সে গোষ্ঠী, যারা সেই সুবেদার ইসলাম খাঁ'র আমল থেকে এখানে এসে স্থানীয়দের সঙ্গে বসতি গড়ে তুলেছে। কেউ কেউ হয়তো ফিরেও গেছে। কিন্তু যারা রয়ে গেছে তারা হলো আদি বা আসলি ঢাকাইয়া। সোব্বাসীরাই যদি আদি ঢাকাইয়া হয়ে থাকে, তবে ঢাকাইয়া কুট্টি কারা?
অনেকেই ঢাকাইয়া কুট্টিদের 'আদি ঢাকাইয়া' হিসেবে জানেন। কুট্টি এবং সোব্বাসী দুটোই যে পুরো পৃথক দুই জাতি, তা আনিস আহমেদ তার ঢাকাইয়া আসলি গ্রন্থেও উল্লেখ করেছেন।
সাবুর মতে, কুট্টিদের সঙ্গে সোব্বাসীদের একটি বড় পার্থক্য হলো এ অঞ্চলে তাদের আগমনকাল। ঢাকার গোড়াপত্তনের সময় (১৬১০) থেকেই সোব্বাসীদের এ অঞ্চলের বসবাস। অপরদিকে কুট্টিরা এসেছে ১৭৭০ সালের পর। কুট্টি ভাষাকে অনেকে ঢাকার আদি ভাষা বলে মনে করেন বটে কিন্তু কুট্টি ভাষা ঢাকার আদি ভাষা নয়। কুট্টিদের নিয়ে মোশাররফ হোসেন ভূঞা তার ঢাকাইয়া কুট্টি ভাষার অভিধান বইয়ে লিখেছেন, ১৮ শতকের মধ্যভাগ থেকে পূর্ববঙ্গে চাল একটি গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি পণ্য ছিল। চাল রপ্তানিকারকেরা ছিলেন মাড়োয়ারি ও মধ্য ভারতের মানুষ। তারা পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন এলাকা থেকে ধান সংগ্রহ করে সেগুলো ঢেঁকিতে ভানতেন এবং কুটতেন। এসব ধান কুটতে ঢাকার আশপাশের এলাকা থেকে শ্রমিকেরা আসত। শ্রমিক-ব্যবসায়ী ও দিল্লির সৈন্যদের কথোপকথনের মধ্য দিয়ে একটি ভাষার উদ্ভব ঘটে। সেটিই কালের পরিক্রমায় 'কুট্টি' হিসেবে পরিচিতি পায়।
আবার হেকিম হাবিবুর রহমানের মতে, '১৭৭০ সালে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফরিদপুর থেকে দরিদ্র লোকেরা ঢাকায় এসে ভিড় জমায় এবং বসতি স্থাপন করে। ঢাকা শহরের আমীর-কবীরগণ খাজনার পরিবর্তে প্রজাদের নিকট হতে যে ধান আদায় করতেন, এসব লোকেরা তা ঢেঁকিতে ভানত এবং এ আয় দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করত। ধান থেকে চাল-তুষ বার করাকে ধান কোটা বলা হয়। এজন্যই এ শ্রেণীর লোকদের 'কুট্টি' বলে অভিহিত করা হতো।
সুতরাং একথা নিশ্চিত যে, ১৭৭০-এর পরে কুট্টি ভাষার আবির্ভাব। অন্যদিকে, সোব্বাসীর আবির্ভাব ১৬১০-এর দিকে। তবে, সোব্বাসী পুরোনো হলেও স্বীকৃতিতে এগিয়ে কুট্টি। কেননা ঢাকাইয়া ভাষা বলতে এখন মানুষ কুট্টি ভাষাকেই বোঝে। নাটক-সিনেমাতেও কুট্টি ভাষার ব্যবহার রয়েছে। এমনকি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সৈয়দ মুজতবা আলীর মতো সাহিত্যিকদের রচনাতেও কুট্টি ভাষার উল্লেখ দেখা যায়।
সোব্বাসীরা উর্দুতে কথা বলে না!
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পাটনা, ঊড়িষ্যা, বিহার থেকে অসংখ্য মানুষ এদেশে প্রবেশ করে। তাদের ভাষা ছিল উর্দু। এই উর্দুর সঙ্গেই নতুন ঢাকার মানুষ সোব্বাসীদের গুলিয়ে ফেলে।
ঢাকার আদি ভাষা নিয়ে বিভিন্ন লেখালেখি হয়েছে। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি ঢাকাই উপভাষা প্রবাদ-প্রবচন কৌতুক ছড়া নামক বইটিতে লেখা আছে, 'হেকিম হাবিবুর রহমান, সৈয়দ মোহাম্মদ তৈফুর প্রমুখের ভাষ্য অনুসারে, ঢাকার অধিবাসীগণ দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত। এক শ্রেণী 'কুট্টি' হিসেবে পরিচিত। অন্য শ্রেণি 'সুখবাসী বা সোব্বাসী' হিসেবে পরিচিত।'
একটা সময় পুরান ঢাকার পরিবারগুলোতে উভয় উপভাষারই প্রচলন ছিল। কিন্তু, আজ আদি ঢাকাইয়া বলতেই মানুষ ঢাকাইয়া কুট্টি নতুবা বিহারী মনে করে।
সোব্বাসী ভাষা নিয়ে একটি অভিধান গ্রন্থের প্রণেতা ও সম্পাদক মো. শাহাবুদ্দিন সাবু জানান, 'আমাদের আরেকটি পার্থক্য হলো সোব্বাসীরা কোথাও চন্দ্রবিন্দু ব্যবহার করে না। আমরা কথাও বলি খুব দ্রুত। যেমন শেখ সাহেব বাজারকে বলি সিক্সাসাববাজার, রায় সাহেব বাজারকে বলি রাসাবাজার।'
বই-পুস্তকে সোব্বাসীকে উর্দু ভাষা হিসেবে দাবি
এশিয়াটিক সোসাইটির ঢাকাই উপভাষা প্রবাদ-প্রবচন কৌতুক ছড়া বইটিতে রাজিব হুমায়ূন লিখেছেন, "সৈয়দ মোহাম্মদ তৈফুরের মতে, 'কুট্টিদের ভাষা ঢাকাইয়া বাংলা আর সোব্বাসীদের ভাষা ঢাকাইয়া উর্দু। তবে বিশুদ্ধ উর্দু থেকে এটি কিছুটা আলাদা।'"
বইটির 'পুরোনো ঢাকার বাংলা উপভাষা' নামক অধ্যায়ে বলা হয়েছে, 'পুরান ঢাকার অধিকাংশ মানুষই দাবি করেন তাদের মাতৃভাষা উর্দু। যদিও বাইরের মানুষের সাথে এরা বাংলাতেই কথা বলেন এবং লেখার ভাষাও তাদের বাংলা। তবে নিজ বাড়িতে উর্দুতেই কথা বলেন।'
এছাড়া বইটির একাধিক অধ্যায়ে সোব্বাসী ভাষার সঙ্গে উর্দুর মিশ্রণ এবং সোব্বাসীকে 'ঢাকাইয়া উর্দু' বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিভিন্ন উল্লেখিত শব্দেও সোব্বাসীদের শব্দ ভুলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে বলে জানান শাহাবুদ্দিন।
হেকিম হাবিবুর রহমানের ঢাকা পাচাস বারাস পাহলে বইয়ে উল্লেখ আছে, 'হিন্দুদের ছাড়া এ শহরে মুসলমানদের দুটি গোত্র আছে। এদের একটিকে খোশবাস এবং সুখবাস বলা হয়। তাদের ভাষা উর্দু।'
এ উর্দু-সোব্বাসী তর্ক নিয়ে মুখ খোলেন 'হামো ঢাকাইয়া সোব্বাসী সামাজিক সংগঠন'-এর সভাপতি হাজি মোহাম্মদ সামিরুদ্দীন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে সোব্বাসী ভাষা এবং সংস্কৃতি রক্ষার্থে কাজ করে যাচ্ছেন। মানুষের মাঝে এসব ভুল ধারণা এবং বই-পুস্তকে এরকম ভুল তথ্য তুলে ধরা নিয়ে তিনি বলেন, 'ঢাকাইয়া উর্দু বলে কোনো ভাষা নেই। আমরা সোব্বাস ভাষাতেই কথা বলি। উর্দুর সঙ্গে আমাদের কিছু শব্দের মিল থাকতে পারে, তা তো বাংলাতেও চীনা, পর্তুগীজ, তুর্কি নানান বিদেশি শব্দের সংমিশ্রণ আছে। তা-ই বলে এটি উর্দু না কোনোভাবেই। এটি হিন্দুস্তানি ভাষার একটি উপভাষা। বইপত্রেও যদি এমনকরে উপস্থাপন করা হয় তবে এ ভাষা কোণঠাসাই হয়ে থাকবে।'
অভিধানও আছে সোব্বাসীদের
নিজ ভাষাকে রক্ষার্থে শাহাবুদ্দিন সাবু ২০২১ সালে বাংলা-ঢাকাইয়া সোব্বাসী ডিক্সেনারি নামক একটি অভিধান বের করেন। বহুদিন ধরেই এর কাজ একটু একটু করে আগাচ্ছিলেন। '৯৮ সাল থেকেই তিনি শব্দ সংকলনের কাজ শুরু করেছিলেন। এরপর করোনার বন্ধেই দিনরাত পরিশ্রম করে এ অভিধান প্রকাশ করেছেন তিনি।
অভিধানটিতে বাংলা শব্দভুক্তি রয়েছে মোট ১৫ হাজার ৩০৪টি। এটিই সোব্বাসী ভাষার একমাত্র অভিধান বলে দাবি করা হয়।
কিন্তু কোনো ভাষাকে টিকিয়ে রাখতে হলে অভিধান দিয়ে তাকে টিকিয়ে রাখা যায় না। এজন্য দরকার সে ভাষার চর্চার। চর্চা না থাকলে ভাষার বিলুপ্তিই স্বাভাবিক। ইউনেস্কো-এর মতে, 'একটি ভাষা তখনই হারিয়ে যায়, যখন সে ভাষায় কথা বলার লোক হারিয়ে যায় কিংবা তারা অন্য ভাষায় কথা বলতে শুরু করে।'
ঢাকাইয়া সংস্কৃতি আসলে সোব্বাসী সংস্কৃতি
স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী হিসেবে ঢাকার আধুনিক সমাজ যখন গড়ে উঠতে শুরু করল, তখনই মুঘল আমলের ক্ষয়িষ্ণু ইমারতরাজির মতো ভাঙতে শুরু করলো ঢাকাইয়া সোব্বাসদের ভাষা, সামাজিক রীতিনীতি ও সংস্কৃতি। ঢাকাইয়া আসলি'র লেখক আনিস আহমেদের মতে, সোব্বাসদের ভাষা-সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও চর্চা আজ এমনই একপর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে, আগামী সিকি শতাব্দীর মধ্যে হয়তো এর কোনো অস্তিত্বই বিদ্যমান থাকবে না।
ঢাকাইয়া সংস্কৃতি বলতে আমরা যেসব আচার-অনুষ্ঠান জানি, এসব আদতে সোব্বাসীদের সংস্কৃতি। শবে বরাতে প্রতিবেশীদের মাঝে হালুয়া-মাংস বিতরণ, সেহরির সময় কাসিদা পাঠ করে রোজাদারদের ঘুম ভাঙানো, কাওয়ালি, ঈদের মিছিল বের হওয়া, বিয়েতে বাড়িতে বাড়িতে মহিলাদের বিয়ের গীত গাওয়া; এ প্রথাগুলো সোব্বাসীদের থেকেই ছড়িয়েছে অন্যান্য অঞ্চলে। এমনকি ঢাকাইয়া কুট্টিদের পোশাক হিসেবে টিভি নাটকগুলোতে যে সাদা পাঞ্জাবি, সাদা লুঙ্গি দেখানো হয়, তা ছিল মূলত সোব্বাসীদেরই পোশাক।
এ নিয়ে হাজী সামিরুদ্দীন যোগ করে বলেন, 'এই যে বলে ঢাকাইয়ারা দেরি করে ঘুম থেকে উঠে সকালে, সকালের নাস্তা খায় বিরিয়ানি-বাকরখানি — এগুলো তো আমাদের থেকেই এসেছে। আমরা আসার আগে এ অঞ্চলের মানুষ খেত গরু-মুরগির ঝোল তরকারি। আমাদের থেকেই ধীরে ধীরে গরুর চাপ, মুরগির চাপ খাওয়ার প্রচলন হয়েছে। কারণ আমাদের আদি পুরুষরা তো ঐ দিল্লি বা পশ্চিম ভারতীয় অঞ্চল থেকেই এসেছেন।'
খোশবাস এবং সুখবাসও এক নয়
হাজী সামিরুদ্দীন থেকে জানা যায়, সোব্বাসীরা সুবেদারের বিভিন্ন বিভাগের পদে কর্মরত ছিলেন। পরে তারা ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করেন। বর্তমানেও তারা চাকরি এবং ব্যবসা-বাণিজ্য দুভাবেই জীবিকা নির্বাহ করছেন। আনিস আহমেদের ঢাকাইয়া বাতচিৎ বইয়েও বলা আছে, ''খোশবাসরা প্রধানত বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য করেই জীবিকা নির্বাহ করতো। চকবাজার, মোগলটুলি, বেগম বাজার ছিল তাদের ব্যবসার কেন্দ্র। এই ঘরের সন্তানরা চাকরি করাকে অবজ্ঞা করতো। তাকে বলতো অন্যের গোলামি করা। সুন্নিদের মধ্যে সৈয়দ, শেখ, মোগল, পাঠান ও আম মুসলমানরা ছিল।'
তবে ঢাকাইয়া বাতচিৎ-এর মতো কিছু বইয়ে খোশবাস এবং সুখবাসদের এক ধরা হলেও, সামিরুদ্দীনের দাবি, সোখবাস আর খোশবাস সম্পূর্ণ আলাদা দুটি গোষ্ঠী। একই অভিমত পোষণ করে শাহাবুদ্দিন বলেন, 'খোশবাস আর সুখবাস শব্দ দুটো আলাদা। খোশবাসরা শিয়া এবং উর্দুভাষী। আমরা সোব্বাসীরা তা নই।' হেকিম হাবিবুর রহমান তার ঢাকা পাচাস বারাস পাহলে বইয়েও এ দুটোকে আলাদা গোষ্ঠী হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
সোব্বাসীরা গাইতে আর নাচতেও ভালোবাসে
সেই মুঘল আমল থেকেই সোব্বাসীরা কৃষ্টি-সংস্কৃতিতে এগিয়ে ছিল। সোব্বাসীদের সংস্কৃতিচর্চা নিয়ে ঢাকাইয়া আসলি গ্রন্থে বিশদ আলোচনা করেছেন আনিস আহমেদ: 'মুঘল ঘরানার ঢাকাইয়া সোববাস সমাজ ব্যবস্থায় তাওয়ায়েফদের নৃত্যগীত স্থানীয় সংস্কৃতির অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে।… সুরের মূর্ছনা, নূপুরের ঝঙ্কার আর তবলার বোলতালে তখনকার সোববাস ঢাকাইয়ারা আকণ্ঠ ডুবে ছিল।'
এসব তাওয়ায়েফদের নবাববাড়ি থেকে মাসিক ভাতা পাঠানো হতো। নবাব আব্দুল গণির নবাবী খেতাব পাওয়া উপলক্ষে ১৮৭৫ সালের পর প্রতিবছর ১ জানুয়ারী শাহবাগে ঢাকাইয়া সোব্বাসদের সর্বজনীন উৎসব হতো। তাওয়ায়েফদের নৃত্যগীত ছাড়াও হোলির গান, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত গজল, কাওয়ালি, ঢোল, তবলা, লাউনি (একদল অন্যদলের গানের প্রত্যুত্তর দিত), মিরাসি (বিয়ে, সুন্নতে খাতনা, নাক-কান ছেদানী, সাতোয়াসায় পেশাদার নারী গায়িকা ভাড়া করে আনা হতো) প্রভৃতি সামাজিক সঙ্গীতচর্চায় অভ্যস্ত ছিল সোব্বাসীরা। চৈত্র-সংক্রান্তি, মেলা, জন্মাষ্টমীতেও হিন্দু-মুসলমান সোব্বাসীরা হিন্দুস্থানি ভাষায় সঙ্গীত পরিবেশন করত।
বুড়িগঙ্গার পার ধরেই থাকে সোব্বাসীরা
আনিস আহমেদের ঢাকা পাঠ বইয়ে উল্লেখ আছে, 'বংশ পরম্পরায় বর্তমানে ঢাকায় হিন্দুস্তানি ভাষাভাষী পরিবারের সদস্য সংখ্যা আনুমানিক পাঁচ লাখের মতো হতে পারে। আর সোব্বাসী ভাষা চর্চাকারীর সংখ্যা লক্ষাধিক হবেনা।'
তবে শাহাবুদ্দিনের মতে, এখনো এ ভাষায় কথা বলতে পারে এমন সংখ্যা প্রায় ছয় থেকে সাত লাখ মানুষ। কিন্তু স্বীকৃতি না থাকায় ও মানুষ এটিকে উর্দু মনে করায় এ উপভাষা এক সময় বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে বলে তার আশঙ্কা।
সেই শুরু থেকে এখনও বেশিরভাগ সোব্বাসীই পুরান ঢাকাতেই বাস করছেন। গুটিকয়েক বাদে পুরান ঢাকার বাইরে যাননি কেউ তারা। মাত্র পাঁচটি থানা জুড়ে তাদের বসবাস। শাহাবুদ্দিন বলেন, 'আমাদের সোব্বাসীরা ঢাকা ছেড়ে বাইরেও যায় না। ধোলাইখালের পাড় থেকে শুরু করে চাংখারপুল হয়ে, হাজারীবাগ হয়ে, আমলীগোলা হয়ে, সাত মসজিদ রোডের পাশ দিয়ে গিয়ে বুড়িগঙ্গার বেল্ট, এটুকুতেই আছি আমরা। বর্তমানে ঢাকায় সূত্রাপুর, কোতোয়ালি, বংশাল, চকবাজার ও লালবাগ থানার অন্তর্গত বিভিন্ন মহল্লায় সোব্বাসীদের বাস।'
অভিধান রচনার পাশাপাশি ঈশপের গল্পের সোব্বাসী অনুবাদের মতো বই অনুবাদের কাজও করছেন শাহাবুদ্দিন। তিনি মনে করেন, ছোটো বাচ্চাদের গল্পের ছলে ছলে বললেই তারা হয়তো এ ভাষাকে আত্মস্থ করতে পারবে। নিজের এক মাত্র ছেলে তাবরেজের সঙ্গেও তিনি ঘরে এ ভাষাতেই কথা বলেন।
শাহাবুদ্দিন বলেন, 'আমার অভিধান হয়তো ভাষা শেখাতে পারবেনা, তবে অনেক যুগ পরে এ বইটা দেখে মানুষ বুঝতে পারবে যে, ২০২৩ সালেও মানুষ সোব্বাসীতে কথা বলত। আকাশকে তারা আসমান বলত।'