কেন থ্রেডসের এ তাৎক্ষণিক সাফল্য পরে ব্যর্থতায় পরিণত হতে পারে?
ধরা যাক, কোটি কোটি ব্যবহারকারী থাকা একটি বৃহৎ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান নতুন একটি সোশ্যাল নেটওয়ার্ক চালু করেছে৷ প্রতিষ্ঠানটি নিজেদের বিদ্যমান অন্য প্ল্যাটফর্মগুলোর জনপ্রিয়তা ব্যবহার করে নতুন সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মটিকে জনপ্রিয় করতে চাচ্ছে। এমনকি সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মটি সফল হলে সেটি অন্য একটি জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্মকে মারাত্মক হুমকির মধ্যে ফেলবে।
প্রযুক্তির বাজারে এমন ঘটনা কিংবা প্রচেষ্টার কথা অহরহই শোনা যায়। কিন্তু এক্ষেত্রে সফল হওয়া ততটা সহজ নয়। ঠিক যেমনটা ইন্সটাগ্রামের পৃষ্ঠপোষকতায় টুইটারের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বাজারে আসা নতুন প্ল্যাটফর্ম থ্রেডসের ক্ষেত্রেও ভাবা হচ্ছে।
এমনি একটি চেষ্টা করা হয়েছিল ২০১১ সালে; গুগল কর্তৃক তৎকালীন নতুন সোশ্যাল নেটওয়ার্ক প্ল্যাটফর্ম 'গুগল প্লাস' উন্মুক্তের মধ্যে দিয়ে। অনেকেই তৎকালীন সময়ে অ্যাপটিকে গুগল কর্তৃক 'ফেসবুক কিলার' হিসেবে অভিহিত করেছিল।
গুগল প্লাসকে জনপ্রিয় করতে গুগল নিজের সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করা ব্যবহারকারীদের কাজে লাগায়। প্রথম বছরের মধ্যেই প্ল্যাটফর্মটি প্রায় ৯০ মিলিয়ন ব্যবহারকারী যুক্ত করতে সক্ষম হয়।
কিন্তু এই মিলিয়ন মিলিয়ন ব্যবহারকারীকে খুব বেশিদিন ধরে রাখতে পারেনি গুগল। যার ফলে ২০১৮ সালের মধ্যে অ্যাপটি সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতার তালিকা থেকে একেবারে ছিটকে যায়।
গুগলের একটা বিশাল সংখ্যক ব্যবহারকারী থাকার পরেও সেটা গুগল প্লাস দীর্ঘমেয়াদে ধরে রাখতে পারেনি। সাময়িকভাবে অনেকেই সোশ্যাল অ্যাপটি ব্যবহার করলেও পরবর্তীতে সেটি ছেড়ে বেশিরভাগই ফেসবুক ব্যবহার করতে থাকে। একইসাথে ইন্সটাগ্রামসহ আরও নতুন নতুন প্ল্যাটফর্ম আসায় গুগল প্লাস যেন সময়ের সাথে সাথে হারিয়েই যায়।
সিলিকন ভ্যালির ইতিহাসে বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো নিজেদের সক্ষমতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আরও বড় ও লাভবান হয়ে ওঠার ঘটনা বেশ অহরহই দেখা যায়। কিন্তু গুগল প্লাসের ঘটনাটি প্রমাণ করে যে, বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান হলেই যে সোশ্যাল মিডিয়ার মার্কেটে সফলতা অর্জন করা যাবে এমন নিশ্চয়তা নেই।
থ্রেডস উন্মুক্তের পর বর্তমানে ঠিক এই চ্যালেঞ্জটিই মেটার সিইও মার্ক জাকারবার্গকে মোকাবেলা করতে হবে। প্রকাশ্যে না হলেও বাস্তবিক অর্থে বাজারে টিকে থাকতে নতুন এ প্ল্যাটফর্মটিকে টুইটারকে কার্যকরীভাবে টেক্কা দিতে হবে।
এরই ধারাবাহিকতায় উন্মুক্তের প্রথম পাঁচ দিনে থ্রেডস ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০০ মিলিয়নের মাইলফলক স্পর্শ করেছিল, যা চ্যাটবট প্রযুক্তি হিসেবে বিশ্বে রীতিমতো সাড়া ফেলে দেওয়া চ্যাটজিপিটিকেও পেছনে ফেলে দিয়েছে!
তবে প্রথমদিকে আলোড়ন সৃষ্টি করলেও সময়ের সাথে সাথে থ্রেডসকে প্রাসঙ্গিক রাখতে ও ব্যবহারকারীদের ধরে রাখতে বেগ পেতে হতে পারে বলে মনে করছেন প্রযুক্তি বিশ্লেষকেরা। জাকারবার্গকে ব্যবহারকারীদের জন্য নিজেদের বন্ধু ও পছন্দের তারকাদের উপস্থিতি নতুন এ অ্যাপটিতে নিশ্চিত করতে হবে।
একইসাথে থ্রেডস যাতে স্প্যামে পরিপূর্ণ না থাকে সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া অ্যাপটি আপডেটের ক্ষেত্রেও বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে। সহজ করে বললে ব্যবহারকারীরা যে প্রতিনিয়ত থ্রেডস ব্যবহার করবে, সেটার পক্ষে যৌক্তিক কারণ সৃষ্টি করতে হবে।
এ বিষয়ে ইন্ডিপেন্ডেন্ট মোবাইল এনালিস্ট ও মেটা অ্যাপস সম্পর্কে অভিজ্ঞ এরিক সিউফার্ট বলেন, "আপনি যদি এমন একটি অ্যাপ বাজারে আনেন যেটার ফিচার পুরোপুরি প্রস্তুত নয়, তখন সেটা বিপরীতমুখীভাবে কাজ করে। তখন অনেকেই পরবর্তীতে আর অ্যাপটি ব্যবহার নাও করতে পারে।"
গত ৫ জুলাই থ্রেডস উন্মুক্তের পর অবশ্য অ্যাপটি অভাবনীয় সাড়া ফেলেছিল। মাত্র কয়েক ঘণ্টায় প্ল্যাটফর্মটিতে ১০ মিলিয়ন ব্যবহারকারী যুক্ত হয়েছিল। নতুন এ অ্যাপটির দ্রুত ব্যবহারকারী বৃদ্ধিকে সিউফার্ট 'বস্তুনিষ্ঠভাবে চিত্তাকর্ষক ও অভূতপূর্ব' বলে উল্লেখ করেছেন।
গত বছরের জুলাইয়ের হিসেব মতে, প্রতিদিন টুইটার ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২৩৭.৮ মিলিয়ন বলে প্রকাশ করা হয়েছিল। এর প্রায় চার মাস পর ইলন মাস্ক টুইটার কিনে নেওয়ার পর থেকে নানা বিধিনিষেধে এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা আরও কমেও যেতে পারে।
থ্রেডসের তাৎক্ষণিক সাফল্যে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন প্রতিদ্বন্দ্বী টুইটারের বর্তমান বস মাস্ক। থ্রেডস বাজারে আসার দিনেই টুইটারের পক্ষ থেকে মেটার বিরুদ্ধে মামলার হুমকি দেওয়া হয়েছে।
মাস্কের আইনজীবী অ্যালেক্স স্পিরো অভিযোগ করেন, টুইটারের সাবেক কর্মকর্তাদের মেটা ইচ্ছাকৃতভাবে থ্রেডস তৈরিতে নিয়োগ করেছে। এসব কর্মকর্তারা টুইটারের অতি গোপনীয় তথ্য ও ইলেকট্রনিক ডিভাইস সম্পর্কে জানতেন।
তবে মাস্কের টুইটারের তুলনায় জাকারবার্গের থ্রেডস অডিয়েন্স সংযুক্তের ক্ষেত্রে বেশ সুবিধা ভোগ করবে। টুইটার সেকেন্ডারি কোনো প্ল্যাটফর্ম থেকে পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে না। অন্যদিকে থ্রেডস মেটাভুক্ত একটি অ্যাপ।
সোশ্যাল মিডিয়ার জগতের অনেকাংশই মেটার দখলে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ওয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার ইত্যাদি বহুল জনপ্রিয় সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মগুলোর মালিক মেটা। সব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানটির রয়েছে প্রায় ৩ বিলিয়নের চেয়েও বেশি নিয়মিত ব্যবহারকারী।
অন্যদিকে অ্যাপ ব্যবহারকারীকে একইসাথে অন্য আরেকটি অ্যাপ ব্যবহারে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে জাকারবার্গের পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতাও রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে মেসেঞ্জারের কথাই বলা যাক। ২০১৪ সাল পর্যন্ত ফেসবুকের মাধ্যমেই ব্যবহাকারীরা মেসেজিং করতেন।
কিন্তু ২০১৪ সালে মাস্ক ফেসবুক থেকে মেসেজিং সার্ভিসকে পৃথক করে আলাদা অ্যাপ হিসেবে মেসেঞ্জারকে বাজারে আনা হয়। এতে করে প্রায় সকল ফেসবুক ব্যবহারকারীই মেসেঞ্জার ব্যবহার করতে থাকে; যা আজও সফলতার সাথে চলছে।
অন্যদিকে থ্রেডস খুব ঘনিষ্ঠভাবে জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া ইন্সটাগ্রামের সাথে যুক্ত। নতুন সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মটি চালু করতে ইন্সটাগ্রাম অ্যাকাউন্টের প্রয়োজন হয়। এমনকি ব্যবহারকারীরা নিজেদের ইন্সটাগ্রাম অ্যাকাউন্টের সকল ফলোয়ার চাইলেই থ্রেডসেও যুক্ত করতে পারেন। এতে করে ব্যবহারকারীদের নতুন করে ফলোয়ার বানানোর বিড়ম্বনা পোহাতে হয় না।
গত সপ্তাহে মেটা বস জাকারবার্গ জানান, থ্রেডস সম্প্রসারণে এমন অনেক কিছুই করা যেত যেটা মেটার পক্ষ থেকে উন্মুক্তের সময় করা হয়নি। এমনকি বহু প্রমোশনাল কার্যক্রমও তিনি এখন পর্যন্ত শুরু করেননি।
অন্যদিকে অনেক ব্যবহারকারীই আবার ইন্সটাগ্রামের পরিচিত কিছু ফিচার থ্রেডসে যুক্ত না করা নিজেদের বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। যেমন, ট্রেন্ডিং হ্যাশট্যাগ দেখার জন্য যে সার্চ ফাংশন থাকে সেটি থ্রেডসে যুক্ত করা হয়নি।
এ সম্পর্কে টেক ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে অভিজ্ঞ অনিল দাস বলেন, "এমন অনেক ফিচারই আছে যেটা থ্রেডসে এখনো উন্মুক্ত করা হয়নি। সম্ভবত প্রথমদিকে সমালোচনা কমিয়ে আনতে ও ডিজাইনকে ঠিকঠাক রাখতে এমনটা করা হয়েছে।"
ইনস্টাগ্রাম প্রধান এডাম মোসেরি এক থ্রেডস পোস্টের মাধ্যমে গত সপ্তাহে জানান, ব্যবহারকারীদের অনুরোধের ওপর ভিত্তি করে থ্রেডস অ্যাপে যুক্ত করার মতো নতুন ফিচারের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে।
তবুও একটি প্রতিষ্ঠিত সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম থেকে সরিয়ে ব্যবহারকারীদের অন্য আরেকটি নতুন সোশ্যাল মিডিয়ায় যুক্ত করার প্রচেষ্টাটি শেষ পর্যন্ত সফল নাও হতে পারে।
২০১১ সালে গুগলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও প্রতিষ্ঠানটির তৎকালীন সিইও ফেসবুকের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে গুগল প্লাস বাজারে আনলেও এক পর্যায়ে ব্যবহারকারীরা নতুন এ প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহারে অনীহা প্রকাশ করেন। এমনকি অনেকে জিমেইল ব্যবহার করলে গেলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও গুগল প্লাস ব্যবহার করতে অনুপ্রাণিত করায় গুগলের প্রতি নিজেদের বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন।
গুগলের সাবেক কর্মীদের মতে, নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য ছাড়াই শুধুমাত্র ফেসবুককে টেক্কা দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে প্ল্যাটফর্মটি তৈরি করা হয়েছিল। একজন ব্যবহারকারী ভিন্নতা ছাড়া ফেসবুক ছেড়ে কেন গুগল প্লাস চালাবেন, সেটি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তারা।
জাকারবার্গ অবশ্য থ্রেডসের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিল গেটসের অতীত কার্যক্রম থেকে অনুপ্রেরণা পেতে পারেন। একটা সময় ছিল যখন পারসোনাল কম্পিউটার জগতে গেটসের মাইক্রোসফট অপারেটিং সিস্টেমের একচেটিয়া রাজত্ব ছিল। ঠিক এই বিষয়টিকেই কাজে লাগিয়ে নতুন নতুন পণ্য ছড়িয়ে দেওয়া ও প্রতিদ্বন্দ্বীদের মোকাবেলা করেছিলেন এ ধনকুবের।
১৯৯৫ সাল থেকে মাইক্রোসফট অপারেটিং সিস্টেমের সাথে ওয়েব ব্রাউজার হিসেবে ইন্টারনেট এক্সপ্লোরারকে জুড়ে দেওয়া শুরু হয়। যার ফলে অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই লাখ লাখ কম্পিউটারের ডিফল্ট ওয়েব ব্রাউজার হিসেবে ইন্টারনেট জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। যদিও এমন একচেটিয়া পদক্ষেপের কারণে ১৯৯৮ সালে মাইক্রোসফটকে আইনি জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল।