হোটেলের ব্যবহৃত সাবান ও শ্যাম্পুগুলো যাচ্ছে কোথায়?
একজন ভ্রমণকারী হিসেবে দেশের হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট কিংবা গেস্ট হাউজে ভ্রমণ করলে অবশ্যই ২৫ গ্রাম ওজনের মেরিল, লাক্স অথবা কেয়া সাবানের বার চোখে পড়বে। একইসাথে কালো প্যাকেটের সানসিল্ক কিংবা রিভাইভের শ্যাম্পু এবং ছোট সবুজ প্যাকেটের ক্লোজ-আপ টুথপেস্টও বাথরুমে রাখা থাকে।
এসব ক্ষেত্রে বেশিরভাগ শ্যাম্পুর প্যকেটগুলো ব্যবহার করা হলেও উল্লেখযোগ্য সময়ই সাবানগুলো অর্ধেক ব্যবহৃত অবস্থাতেই থেকে যায়। এরপর যখন অতিথিরা হোটেল রুম থেকে চেক আউট করে তখন কর্মচারীরা সেই সাবান ও শ্যাম্পুর প্যাকেটগুলো শেষমেশ ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দেয়।
কক্সবাজারের সুগন্ধা সমুদ্র সৈকতের পাশে অবস্থিত হোটেল সি কক্স এমনি একটি হোটেল। এতে সবমিলিয়ে ৯১টি রুম রয়েছে। এ সম্পর্কে হোটেলটি ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা আতাউল্লাহ বলেন, "প্রতিদিন আমাদের হোটেলে গড়ে ১০০ পিস মেরিল সাবান, ২৬০ থেকে ২৭০ পিস রিভাইব শ্যাম্পু এবং ৯০ পিস ক্লোজ-আপ টুথপেস্টের দরকার হয়।"
অন্যদিকে কক্সবাজারের ওশেন প্যারাডাইজ হোটেলের সাবেক কর্মী বশির আশরাফ (ছদ্মনাম) বলেন, "বড় বড় হোটেলগুলোর সাথে স্কয়ার কিংবা ইউনিলিভারের মতো কোম্পানিগুলোর চুক্তি করে থাকে। এ কোম্পানিগুলোর হোটেলগুলোতে কাস্টমাইজড লিকুইড শাওয়ার জেল ও শ্যাম্পু সরবরাহ করে থাকে। এক্ষেত্রে ওয়াশরুমগুলোতে জেল ডিসপেন্সারও ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও এ হোটেলগুলোতে কাস্টমাইজড টয়লেট্রিজ টিউব থাকে যেটা অনেক সময় অতিথিরা নিয়ে চলে যায়।"
স্কয়ার টয়লেট্রিজের ট্রেড মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টের সাথে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান, কোম্পানিটির সাথে কক্সবাজারের ১২০ টি হোটেল ও গেস্ট হাউজের চুক্তি রয়েছে।
চুক্তি অনুযায়ী এসব হোটেলগুলোতে কোম্পানিটি প্রায় এক লাখ পিস সাবানের বার, আড়াই লাখ পিস শ্যাম্পুর প্যাকেট ও প্রায় ৬০০ লিটার হ্যান্ডওয়াশ সরবারাহ করে থাকে। তবে ঠিক কী পরিমাণ শাওয়ার জেল তারা পাঠায়, সেটি নির্দিষ্ট করে জানাতে পারেনি।
হোটেলগুলো ব্যবহৃত সাবান কিংবা শ্যাম্পুগুলো রিসাইকেল করার জন্য ফের কোম্পানিটিতে পাঠানো হয় না। এর মানে হচ্ছে, শুধু একটি পর্যটন স্পট থেকেই শ্যাম্পুর প্রায় আড়াই লাখ প্লাস্টিকের প্যাকেট ও অর্ধেক ধরলেও প্রায় ৫০ হাজার ব্যবহৃত সাবান রিসাইকেল করা হচ্ছে না।
তাহলে ব্যবহৃত সাবান ও শ্যাম্পুর প্যাকেটগুলো যাচ্ছে কোথায়? এমন প্রশ্নের জবাবে আতাউল্লাহ বলেন, "আমরা সেগুলো ময়লার ভাগাড়ে ফেলে দেই এবং সেখান থেকে পৌরসভার লোকেরা সেগুলো সংগ্রহ করে।"
অন্যদিকে ওশেন প্যারাডাইজের সাবেক কর্মী বশির বলেন, "আমরা, কর্মচারীরাও ঐ সাবানগুলো ব্যবহার করি না। এগুলো ফেলে দেওয়া হয়।"
ব্যবহৃত সাবান ও শাম্পুর প্যাকেটগুলো যাচ্ছে কোথায়?
কক্সবাজারে ময়লা-আবর্জনা ফেলার জন্য বাঁকখালী নদীর কাছাকাছি মোট চারটি ভাগাড় রয়েছে। সেখানে শহরটির ময়লাগুলো ফেলা হয়। কক্সবাজার সিটি কর্পোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি মাসে শহরটি থেকে প্রায় ৮৮ টন কঠিন বর্জ্য অপসারণ করা হয়। এই হিসেবে হোটেল ও মোটেলগুলোর বর্জ্যও অন্তর্ভুক্ত।
অন্যদিকে কক্সবাজার ডেভেলপমেন্ট অথোরিটির তথ্যমতে, পৌরসভাটিতে তরল বর্জ্যের জন্য কোনো কেন্দ্রীয় সুয়েজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (এসটিপি) নেই। এসটিপির মাধ্যমে মূলত তরল বর্জ্য থেকে পরিবেশ দূষণকারী মুখ্য সব উপাদানগুলোকে পৃথক করা হয়।
বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশজুড়ে ৪৫ টি জেলায় রেজিস্ট্রেশনকৃত ৫৫০ টি হোটেল ও রেস্টুরেন্ট রয়েছে। এরমধ্যে ১৮ টি পাচ তারকা হোটেল, ছয়টি চার তারকা হোটেল এবং ২২ টি তিন তারকা হোটেল।
পর্যটন নগরী কক্সবাজারে রয়েছে পাঁচটি পাঁচ তারকা হোটেল, একটি চার তারকা হোটেল এবং চারটি তিন তারকা হোটেল। শহরটিতে সবমিলিয়ে মোট ৩০ টি রেজিস্ট্রেশনকৃত হোটেল ও রেস্টুরেন্ট রয়েছে।
তবে কক্সবাজার ডেভেলপমেন্ট অথোরিটির সহকারী নগর পরিকল্পনাবিদ তায়ফুর রহমান বলেন, "তবে বাস্তবে, জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্রটিতে ৩০০ টির চেয়েও বেশি হোটেল রয়েছে। এর মধ্যে অল্প কিছু সংখ্যক হোটেলের নিজস্ব এসটিপি রয়েছে।"
অন্যদিকে সারাদেশে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের মোট ৩২ টি মোটেল রয়েছে। আর ট্যুরিজম রিসোর্ট ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট খবির উদ্দিন আহমেদের তথ্যমতে, দেশজুড়ে প্রায় ২০০ টি রিসোর্ট রয়েছে; যেগুলোতে ৬ হাজার রুম রয়েছে। যদিও এসব রিসোর্টগুলোর মধ্যে মাত্র ৭৬ থেকে ৮০ টি রিসোর্ট মন্ত্রণালয়ের অধীনে রেজিস্ট্রেশনকৃত।
এ বিশাল সংখ্যক হোটেল ও রিসোর্টগুলোর অল্প ব্যবহৃত সাবানের বার ও শাওয়ার জেলগুলো রিসাইকেলিং এর জন্য আর কোম্পানিগুলোতে ফেরত পাঠানো হচ্ছে না। এমনকি ঠিক কতগুলো হোটেলে এসটিপি রয়েছে; সেটারও সঠিক কোনো হিসেব নেই।
একটি রিসোর্ট গড়ে প্রায় ১০ থেকে ১০০ বিঘা জমির ওপর তৈরি করা হয়। সেগুলোতে এসটিপি রয়েছে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে খবির উদ্দিন বলেন, "না। রিসোর্টগুলোতে এসটিপি নেই। এগুলোর সুয়ারেজ সিস্টেম মাটির নিচ দিয়ে তৈরি করা।"
অন্যদিকে কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক ইন্সপেক্টর মাহবুবুল ইসলাম বলেন, "তিন, চার ও পাঁচ তারকা হোটেল ও রিসোর্টগুলো অবশ্যই বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অধীনে রেজিস্ট্রেশন হওয়া উচিত। আর এক ও দুই তারকা হোটেল ও রিসোর্টগুলো জেলা প্রশাসকের অধীনে রেজিস্ট্রেশনের আওতায় আনা উচিত।"
তবে রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে হোটেলগুলোকে অবশ্যই পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে হবে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে এসটিপি স্থাপন।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, কক্সবাজারের ৩০০ টি হোটেলের মধ্যে মাত্র ছয়টি হোটেলের পরিবেশগত ছাড়পত্র ও এসটিপি রয়েছে। এগুলো হচ্ছে হোটেল সিগাল, ওশেন প্যারাডাইজ, লং বিচ, সিমন বিচ রিসোর্ট, কক্স টুডে এবং সি ওয়ার্ল্ড ।
তবে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের পক্ষ থেকে এটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি যে এই হোটেলগুলো প্রকৃতপক্ষেই এসটিপি গাইডলাইন অনুসরণ করছে কি-না।
অন্যদিকে কক্সবাজারের হোটেল ও গেস্ট হাউজগুলো কেন এসটিপি স্থাপন করছে না সে বিষয়ে কক্সবাজার হোটেল-মোটেল-গেস্ট হাউজ ওনারস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম সিকদারের কাছে জানতে চাওয়া হয়। তবে তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
ধারণা করা হচ্ছে যে, ব্যবহৃত এই সাবানগুলো বাঁকখালি নদীর পাশে অবস্থিত ভাগাড়ে ফেলা হয়। শেষমেশ এগুলো হয় মাটিতে মিশে যায় নতুবা বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে সাগরের পানিতে মিশে যায়।
পরিবেশগত ঝুঁকি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. প্রদীপ কুমার বক্সি বলেন, "সাবান একটি মৌলিক উপাদান। মানে এটি যদি প্রাণীর পেটে যায়, তবে এটি সেখানকার এসিডের মাত্রা কমিয়ে দিতে পারে। এতে করে হজম প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। এছাড়াও, সাবানের ভেতরে হাইড্রোকার্বনের দীর্ঘ চেইন থাকায় এটি কম বায়োডিগ্রেডেবল। যার ফলে সাবানগুলো আরও বেশি সময় পরিবেশে থাকে।"
তাই যখন বিপুল পরিমাণ সাবান ও একই ধরণের ক্যামিকেল যখন পানিতে মিশে যায়; তখন জলজ প্রাণীগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
অন্যদিকে ওয়াশিংটনের ইকোলজি ডিপার্টমেন্টের তথ্যমতে, ডিটারজেন্টে থাকা ফসফেট মিঠা পানিতে শৈবালের সৃষ্টি করতে পারে। এতে করে পানিতে থাকা অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়। যা মাছসহ জলজ উদ্ভিদের জন্য ক্ষতিকারক।
অন্যদিকে পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাওয়ার ফলে পানির নিচে থাকা পলিমাটির রাসায়নিক গঠনে পরিবর্তন আনতে পারে। এতে করে পানি বিষাক্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে যা জলজ প্রাণীর জন্য ক্ষতিকারক।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে প্রতিনিয়ত কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন ও কুয়াকাটার পানিতে কী পরিমাণ সাবান দ্রবীভূত হচ্ছে? এমন প্রশ্নের জবাবে নদী অধিকার মঞ্চের সদস্য সচিব শমশের আলী বলেন, "দুর্ভাগ্যবশত আমাদের পরিবেশ অধিদপ্তর বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত নয়। তাই এ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য কিংবা গবেষণাপত্র নেই।"
জাতিসংঘের এনভারনমেন্ট প্রোগ্রামের অনুমান মতে, প্রতি বছর শুধু পর্যটকদের মাধ্যমেই প্রায় ১.৩ বিলিয়ন টন বর্জ্য তৈরি হয়। এটি বৈশ্বিক মোট বর্জ্যের ৪ থেকে ৮ ভাগ।
তবে এক্ষেত্রে ব্যবহৃত সাবান রিসাইকেল করার মতো বিষয়টিকে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান গুরুত্ব দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এমনি একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান 'ক্লিন দ্য ওয়ার্ল্ড'। প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বব্যাপী প্রায় ১৪ লাখ হোটেল রুম থেকে ব্যবহৃত সাবান সংগ্রহ করছে।
পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৭৩ মিলিয়ন সাবানের বার রিসাইকেল করে ঘানা, ফিলিপাইন এমনকি বাংলাদেশের মানুষের মাঝেও বিতরণ করেছেন। কেননা এসব দেশের মানুষের মৌলিক অনেক সুবিধা থেকেই বঞ্চিত হচ্ছে।