টয়লেট ম্যান: ভারতে নিরাপদ শৌচাগার ব্যবহারকে যিনি বাস্তবে পরিণত করেছেন
ভারতের বিখ্যাত সমাজকর্মী বিন্দেশ্বর পাঠক গত মঙ্গলবার (১৫ আগস্ট) ৮০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন। তবে দেশটিতে শৌচাগার নির্মাণ ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে যে 'বিপ্লব' তিনি এনেছেন, সেজন্য তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। খবর বিবিসির।
১৯৭০ এর দশকের শুরুর দিকে বিন্দেশ্বর তুলনামূলক সাশ্রয়ী টুইন-পিটের শৌচাগার ডিজাইন তৈরি করেন। পরবর্তীতে এই ডিজাইনের ওপর ভিত্তি করেই আজও ভারতের হাজার হাজার গ্রামে স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার তৈরি করা হচ্ছে। যার ফলে দেশটির লাখ লাখ মানুষ নিরাপদ স্যানিটেশন সুবিধা পাচ্ছেন।
একইসাথে বিন্দেশ্বরের প্রতিষ্ঠিত সুলভ ফাউন্ডেশন ভারতের শহরগুলোতে বহু শৌচাগার স্থাপন করেছে। এই শৌচাগারগুলো 'পে পার ইউজ' মডেলের ভিত্তিতে পরিচালনা করা হয়; যা খুবই নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত।
ফলে 'প্রস্রাবের জন্য এক রুপি আর মলত্যাগের জন্য দুই রুপি' এর ধারণাটি খুব দ্রুতই ভারতে ছড়িয়ে যায়। কেননা দেশটিতে শৌচাগার ব্যবহার না করে খোলা জায়গায় কিংবা গাছের পেছনে বসে মলত্যাগের ব্যাপারটিই বেশি প্রচলিত ছিল।
শুধু শৌচাগার নয়, বরং বিন্দেশ্বর ভারতে বিদ্যমান জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধেও কাজ করে গেছেন। বিশেষ করে অস্পৃশ্য মনে করা দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে তিনি কাজ করেছেন।
সমাজসেবক হিসেবে অসাধারণ সব কাজের জন্য বিন্দেশ্বর বহু দেশি ও বিদেশি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকলে গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে তাকে 'মিস্টার স্যানিটেশন' কিংবা 'দ্য টয়লেট ম্যান অফ ইন্ডিয়া' নামে অভিহিত করা হয়।
ওয়াশিংটন পোস্টের এক রিপোর্টে বিন্দেশ্বরকে 'ছোট বিপ্লবী' হিসেবে অভিহিত করা হয়। একইসাথে ২০১৫ সালের দ্য ইকোনোমিস্ট গ্লোবাল ডাইভারসিটি তালিকায় জায়গা করে নেন।
১৯৮৯ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, বিন্দেশ্বর রাজস্থানে সমাজের নিচু জাত হিসেবে গণ্য এমন সব পরিবার থেকে ১০০ মেয়েকে নিয়ে সেখানকার একটি মন্দিরে যান।
সাধারণত ঐ মন্দিরটিতে দলিত সম্প্রদায়ের লোকদের প্রবেশ করতে দেওয়া হতো না। বিন্দেশ্বর মেয়েদের নিয়ে সেখানে প্রবেশের পাশপাশি জনসম্মুখে একসাথে খাবারও খান।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিন্দেশ্বরের সুলভ ফাউন্ডেশন ভারত সরকারের সাথে মিলে 'ক্লিন ইন্ডিয়া' ক্যাম্পেইন পরিচালনা করছে। এই ক্যাম্পেইনের অন্যতম উদ্দেশ্য, খোলা স্থানে মলত্যাগ বন্ধ করা।
ব্যক্তিজীবনে বিন্দেশ্বর ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা মহাত্মা গান্ধী দ্বারা গভীরভাবে অনুপ্রাণিত ছিলেন। তিনি তার জীবনে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছেন মানুষের জন্য স্যানিটেশন সমস্যার সমাধান করার বিষয়টিকে। এমনকি নিজের সন্তানদের থেকেও এই কাজকে তিনি বেশি পছন্দ করতেন বলে নানা সাক্ষাৎকারে বলেছেন।
বিন্দেশ্বরের জন্ম মূলত ভারতীয় হিন্দু সমাজে উঁচু জাত হিসেবে পরিচিত ব্রাহ্মণ গোত্রে। সেই সুবাদে একদম শৈশব থেকেই তিনি জাতকে কেন্দ্র করে বৈষম্যের বিষয়টি নিয়ে ভাবতে থাকেন।
২০১৭ সালে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিন্দেশ্বর ঠিক তেমনি একটি ঘটনার উল্লেখ করেন। তিনি জানান, শৈশবে তাদের বাড়িতে এক নারী জিনিসপত্র দিয়ে যেতেন। সেক্ষেত্রে ঐ নারী যতবার আসতেন, তার দাদি ততবারই বাড়িটিকে 'পবিত্র' করার জন্য পানি ছিটিয়ে দিতেন।
ঐ ঘটনা সম্পর্কে বিন্দেশ্বর বলেন, "আমি শুধু ভাবতাম, এমনটা কেন করা হচ্ছে! তখন লোকেরা আমাকে বলতে, ঐ নারী অস্পৃশ্য ছিলেন এবং তিনি আসায় আমাদের বাড়ি অপবিত্র হয়ে যেত।"
একজন কৌতূহলী বালক হিসেবে বিন্দেশ্বর তাই ঐ নারীকে স্পর্শ করে পরখ করে দেখতেন যে, অপবিত্র হয়ে যাওয়ার মতো তার মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসে কি-না। একদিন তার দাদি এই ঘটনা ফেলেন এবং বাড়িতে শুরু হয় গোলমাল।
বিন্দেশ্বরের এই ঘটনার পর বাড়িতে একজন পুরোহিতকে ডাকা হয়। পুরোহিত জানান, বিন্দেশ্বর অপবিত্র হয়ে গিয়েছেন এবং তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে হবে।
তখন তার মা বাধা দিয়ে বলেন যে, বিন্দেশ্বর এখনো ছোট বাচ্চা। তাই তার জন্য অন্য কোনো সমাধান নিশ্চয়ই হয়তো রয়েছে।
তখন পুরোহিত বিন্দেশ্বরকে পবিত্র করতে শর্ত দেন যে, তাকে গোবর ও মূত্র খেতে হবে। অতঃপর পরিবারের পক্ষ থেকে জোর করে তাকে সেটিই করানো হয়।
ঘটনাটি বিন্দেশ্বরের মনে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, "আমি বরং ভাবতে থাকি একই সমাজে কেন ভিন্ন ভিন্ন লোকের জন্য ভিন্ন ভিন্ন নিয়ম জারি করে অনেকের সাথে অন্যায় করা হয়। আপনি একটি কুকুরকে স্পর্শ করতে পারেন, কিন্তু আপনার মতো অন্য একজন মানুষকে স্পর্শ করলে পারিবারিক ঝামেলার সৃষ্টি হয়।"
ভারতের সমাজে বিদ্যমান বৈষম্য সম্পর্কে গভীরভাবে সচেতন হয়ে বিন্দেশ্বর কলেজে সমাজবিজ্ঞান অধ্যয়নের সিধান্ত নেন। এরপর নিজের বিয়ের কিছুদিন পর ১৯৬৮ সালে প্রায় তিন মাস তিনি একটি দলিত কলোনিতে কাটান।
এতে করে বিন্দেশ্বরের ব্রাহ্মণ পরিবার ও গোত্রের পক্ষ থেকে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়। তখন তার শ্বশুর জানায়, তিনি নিজের মেয়েকে বিন্দেশ্বরের কাছে বিয়ে দিয়ে ভুল করেছেন। তিনি আর কোনোদিন তার মুখ দেখতে চান না।
সকলের এমন তীব্র প্রতিক্রিয়ায় বেশ কষ্ট পান বিন্দেশ্বর। তবে নিচু জাত হিসেবে গণ্য করা মানুষদের নিয়ে কাজ করার নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে কখনো অনুতাপ করেননি তিনি।
বরং বিন্দেশ্বর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, প্রয়োজনে স্ত্রীকে ছেড়ে দিবেন। তবুও নিজের সংকল্প থেকে দূরে সরে যাবেন না।
তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৯ সালে বিন্দেশ্বর গবেষণা করে টুইন পিটের শৌচাগার তৈরি করে। তার এই উদ্ভাবনের ফলে নিচু জাতের মানুষদের অনেকেই মলমূত্র পরিষ্কার করার জীবন থেকে সরে আসতে পারেন।
বিন্দেশ্বরের উদ্ভাবনটি জনপ্রিয় হওয়ার পরে বিহার সরকার তাকে ২০০ টি অনুরূপ শৌচাগার নির্মাণের কাজ দেন। এছাড়াও বহু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তার কাছে পরামর্শের জন্য আসতে থাকে। এতে করে ধীরে ধীরে তার পরিবারে দৃষ্টিভঙ্গিও বদলাতে থাকে।
এরপর থেকে সুলভ ফাউন্ডেশন ভারতজুড়ে প্রায় ১৫ লাখ শৌচাগার নির্মাণ করেছে; যেগুলো প্রায় ২ কোটিরও বেশি মানুষ ব্যবহার করছে। এছাড়াও বিন্দেশ্বরের ডিজাইন করা শৌচাগার বিশ্বের নানা প্রান্তে তৈরি করা হচ্ছে।
১৯৭৪ সাল থেকে সুলভ ফাউন্ডেশন ভারতজুড়ে বস্তি এলাকা থেকে শুরু করে নানা পাবলিক স্থানে প্রায় ৯০০ 'পে এন্ড ইউজ' শৌচাগার নির্মাণ করেছে। এতে করে বাস স্ট্যান্ড, মার্কেট ও রেলওয়ে স্টেশনের যাত্রীরা স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার ব্যবহারের আওতায় এসেছে।
বিশেষ করে ভারতীয় নারীদের জন্য 'পে এন্ড ইউজ' শৌচাগার বেশ উপকারে এসেছে। কেননা এর আগে নারীদের জনবহুল পাবলিক জায়গায় শৌচাগার ব্যবহারের মতো সুযোগ ছিল না বললেই চলে। তখন তাদের বেশ বিড়ম্বনায় পড়তে হতো।
বিবিসির সাথে এক সাক্ষাৎকারে বিন্দেশ্বর বলেন, "স্যানিটেশন আমার ধর্ম। আপনি যদি অন্য মানুষকে সাহায্য না করেন তবে আপনি এখনও ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে পারেননি।"