ব্ল্যাকসোয়ান: কে-পপ গার্ল গ্রুপ, যে দলের কেউ কোরিয়ান না
শাড়ি থেকে অনুপ্রাণিত পোশাক-আশাক পরে আর গহনায় সেজে চার তরুণীকে মন্দির ও পুরনো স্থাপনার পাশে নেচেগেয়ে আনন্দ করতে দেখা যায়। একসময় আকাশের দিকে ছড়িয়ে দেওয়া হয় নানা রঙের গুঁড়ো (গুলাল), যার আভা এসে পড়ে তরুণীদের মুখেও।
না, এটি কোনো বলিউড মুভির দৃশ্য নয়, বরং কোরিয়ান গার্ল গ্রুপ ব্ল্যাকসোয়ানের সর্বশেষ মিউজিক ভিডিও। এই মুহূর্তে দক্ষিণ কোরিয়ায় এটিই নারীদের একমাত্র ব্যান্ড দল, যে দলের কেউ কোরিয়ান না। খবর বিবিসির।
এর আগে, ২০১৭ সালে এক্সপি এডিশন নামে ছেলেদের একটি ব্যান্ডও কোরিয়াতে আত্মপ্রকাশ করেছিল যার সবাই ছিলেন আমেরিকান; তবে এখন ব্যান্ডটি আর সক্রিয় নেই।
কোরীয় ব্যান্ডগুলোতে এমন বিদেশি সদস্যের উপস্থিতি নতুন কিছু নয়; এরা সাধারণত এশিয়ারই অন্যান্য দেশের নাগরিক হয়ে থাকে। যেমন দক্ষিণ কোরিয়ায় মেয়েদের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যান্ড 'ব্ল্যাকপিংকের' একজন সদস্য থাই।
কিন্তু এখানে ব্যতিক্রম ব্ল্য়াকসোয়ান। ভারতীয় সদস্য স্রিয়া ছাড়া এ ব্যান্ডে আর কোনো এশীয় সদস্য নেই। বাকিদের মধ্যে ফাতৌয়ের বেড়ে ওঠা সেনেগাল-বেলজিয়ামে, গ্যাবি হলেন ব্রাজিলিয়ান জার্মান এবং এনভি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছেন।
কোরীয় ব্যান্ড হয়েও কোরিয়ার কোনো সদস্য না থাকায় ব্ল্যাকসোয়ানের ভক্তদের রয়েছে এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
একজন মন্তব্য করেছে, "তারা কোরিয়ান বিনোদন কোম্পানির সাথে সংশ্লিষ্ট, এখানেই তাদের শুরু (ডেব্যু) এবং কোরিয়ান ভাষাতেই তারা গায়।"
তবে অনেকেই করেছেন নেতিবাচক মন্তব্য। একজনের কথায়, "কোরিয়ান বিহীন অবস্থায় তারা কেবলই একটা পপ গ্রুপ।"
তবে ব্যান্ডের সদস্যরা এসব মন্তব্যে একদম বিচলিত নন। তারা নিজেদের 'কে-পপ' গ্রুপ হিসেবেই গণ্য করেন।
এদিকে বিদেশি নাগরিকেরাও যেন কে-পপের ওপর প্রশিক্ষণ নিতে পারে, সেজন্য দেশটির সরকার একটি দুই বছর মেয়াদী 'কে-কালচার ট্রেনিং ভিসা' চালুর পরিকল্পনা করছে। তবে এটি নিয়ে কিছুটা মতবিভেদ দেখা গেছে।
ব্ল্যাকসোয়ানের আগে ২০১১ সালে রানিয়া নামে আরেকটি ব্যান্ডের সূচনা হয়- যেখানে ছয়জন কোরিয়ান এবং একজন থাই সদস্য ছিলেন। কিন্তু গত কয়েক বছরে এর সদস্যদের প্রচুর পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
২০২০ সালে মিউজিক কোম্পানি, ডিআর মিউজিক রানিয়াকে ব্ল্যাকসোয়ান ব্যান্ডে রূপ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ব্যান্ডটির অরিজিনাল লাইনআপ থেকে কেবল ফাতৌ-ই আছে এখন।
ডিআর মিউজিকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফিলিপ ওয়াইজে ইউন বলে, "অনেকের কাছেই এটা অন্যরকম ঠেকতে পারে এবং কোরিয়ান সদস্য না থাকায় অনেকে গ্রুপটিকে অপছন্দও করতে পারে। তবে আমরা কে-পপ মার্কেটের বিস্তৃতি বাড়াতে এটিকে একটি সুযোগ হিসেবে দেখছি।"
সুযোগের সাথেই আসে চ্যালেঞ্জও!
ভাষা এক্ষেত্রে সর্বপ্রথম প্রতিবন্ধক। কে-পপ আইডলরা কোরীয় ভাষাতেই কথা বলবে, পারফরম করবে- সে আশাই করা হয়। কোরীয় মুখ্য ভাষার আবার একাধিক ধরন আছে যা শ্রোতার বয়স, সামাজিক অবস্থা, পারস্পারিক সম্পর্ক এবং উপলক্ষের সাথে পরিবর্তন হয়। 'অনারিফিকস' এই ভাষার অন্যতম মূল বৈশিষ্ট্য।
গ্যাবি যেমন বললেন, "ব্যক্তির নাম বা 'তুমি' সম্বোধন আপনি কোরিয়ান ভাষায় করতে পারবেন না। অথচ পর্তুগিজ এবং ইংরেজি বাক্যে এটি একটি বহুল প্রচলিত ব্যাপার। এটি বুঝতে আমার তাই সময় লেগেছে।"
এখনও সদস্যদের কেউ কেউ কোরিয়ান ভাষা নিয়ে সমস্যায় পড়েন।
তবে সবচেয়ে কঠিন হলো নাচের অনুশীলন। গীতিনাট্য এবং অভিনয় নিয়ে পড়াশোনা করা এনভির ভাষ্যে, "এটা অনেক হতাশাজনক।"
গ্যাবি এর আগে ব্রাজিলে একটি নাচের দলের সাথে যুক্ত ছিলেন, ভেবেছিলেন নাচ অতটাও কঠিন কিছু হবে না।
কিন্তু কোরিয়াতে আসার পর তার অনুধাবন- "আমি দেখছি নাচের কিছুই পারি না!"
প্রশিক্ষণের সময় অংশগ্রহণকারীরা ডর্মে একসাথে থাকে এবং তাদের বাইরে যাওয়া বা কাউকে ডেট করা নিষিদ্ধ। তাদের ওজন কমিয়ে 'নিখুঁত' চেহারার অধিকারী হতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এবং জানানো হয়, তাদের নিয়ে কোনো ধরনের গুজব বা কেলেঙ্কারির অনুমোদন দেওয়া হবে না- কারণ কোরিয়ার সাধারণ জনগণ সেলেব্রিটিদের সম্পর্কে খুবই উচ্চ ধারণা পোষণ করে।
কে-পপ গ্রুপগুলোতে প্রায় আট বছর কোরিওগ্রাফার হিসেবে কাজ করা ফ্রিল্যান্স কাস্টিং ডিরেক্টর ইন জি-উওং জানান, তিনি এর আগে বহু বিদেশি প্রশিক্ষণার্থীদের পালিয়ে ক্লাবে যাওয়ার কথা শুনেছেন। খবর পাওয়া মাত্রই কোম্পানির পক্ষ থেকে তখন তাদের পরিচালকদের 'জরুরী মোতায়েন' করা হয়।
মি. ইউন স্বীকার করেছেন যে, আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণার্থীদের সাথে কাজ করা কিছুটা চ্যালেঞ্জিং।
"তারা প্রায়ই আমাদের নিয়ম নিয়ে প্রশ্ন তোলে এবং ভীষণ স্পষ্টভাষী।"
তাছাড়া কঠোর প্রশিক্ষণ এবং মাত্রাতিরিক্ত প্রতিযোগিতা কে-পপ ইন্ডাস্ট্রিকে মানসিক স্বাস্থ্য সংকটেও ফেলছে।
এপ্রিলে বয় ব্যান্ড অ্যাস্ট্রোর সদস্য, মুনবিনের আকস্মিক মৃত্যুতে ভক্তরা হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। সিউলের গ্যাংনাম এলাকায় নিজের ফ্ল্যাটে তাকে চেতনাহীন পড়ে থাকতে দেখা যায়। এর আগে ২০১৯ সালে মাত্র এক মাসের ব্যবধানে কে-পপ তারকা সালি এবং তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু গোহারা মারা যান; ধারণা করা হয়, দু'জনেই আত্মহত্যা করেছিলেন।
"মানসিক চাপ মোকাবিলা করাই আমার জন্য সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং ছিল", স্বীকার করে নেন ফাতৌ, যিনি অল্পবয়স থেকেই বিষণ্ণতার লক্ষণে ভুগছেন।
তিনি ইতিমধ্যে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হয়েছেন এবং ফেব্রুয়ারি থেকে চিকিৎসাও নিচ্ছেন। এবারই প্রথম তিনি চিকিৎসা সহায়তা নিচ্ছেন এবং তার এজেন্সিই সে ব্যয় বহন করছে।
তবু ফাতৌ একবাক্যে বলেন, কে-পপই তাকে সবচেয়ে বেশি খুশি করে তোলে।
যদিও পরিস্থিতিতে বদল আসছে। অনেক এন্টারটেইনমেন্ট কোম্পানি প্রশিক্ষণার্থী এবং তারকাদের আগের চেয়ে বেশি 'পার্সোনাল টাইম' উপভোগের সুযোগ করে দিচ্ছে। অনেক নিয়মও শিথিল করা হচ্ছে।
ব্ল্যাকসোয়ানের সদস্যরা মনে করেন, তারা কে-পপের ভবিষ্যতকে প্রতিনিধিত্ব করছেন।
গ্যাবির ভাষায়, "কে-পপ বিশ্বব্যাপী আরও বিস্তৃত হবে, যাতে করে আরও অনেক বৈশ্বিক দল প্রশিক্ষিত হয় এবং বিশ্ববাজারে তাদের সংগীতের সূচনা করতে পারে।"
স্রিয়া আরও সহজ করে বলেন, "সবাই এটি করতে সক্ষম…কারণ ত্বকের রঙ কোনোকিছুর নির্ধারক হতে পারে না।"