মহাশূন্যের খাওয়া-দাওয়া: পুষ্টি বড়ি থেকে সালাদ
প্রথমবার যখন মহাশূন্যে মানুষ পাঠানো হয়, তখন কক্ষপথে খাবার কী করে খাবে সে ব্যাপারে বিজ্ঞানীদের কোনো ধারণাই ছিল না।
বিজ্ঞানীদের মনে তখন ঘুরপাক খাচ্ছিল অজস্র প্রশ্ন। ওজনবিহীন বিমানে থাকা অবস্থায় মানুষ কি খাবার গিলে খেতে পারবে? মাধ্যাকর্ষণ ছাড়া কি হজম প্রক্রিয়া কাজ করে?
তবে বিজ্ঞানীদের এসব ভয় ও আশঙ্কা দূর করেন রাশান নভোচারী ইউরি গ্যাগারিন, ১৯৬১ সালে। সে বছর তিনি সফল্ভাবে মহাশূন্যে গিয়ে গরুর মাংস ও কলিজার কাই চিবিয়ে খান এবং সেই খাবার হজমও করেন।
ওই বছরই নভোচারী গেরমান তিতভ পৃথিবীর কক্ষপথে চক্কর কাটার সময় বিস্কুট চিবিয়ে খান। এর কয়েক মাস পর মার্কিন নভোচারী জন গ্লেন একটি অ্যালুমিনিয়ামের টিউব থেকে ৮০ ক্যালরি আপেলের সস চুষে খান।
তবে গ্যাগারিন, গ্লেন, তিতভরা আজ বেঁচে থাকলে এখনকার নভোচারীদের সৌভাগ্য দেখে রীতিমতো হিংসায় জ্বলেপুড়ে যেতেন। সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে নভোচারীরা মহাশূন্যে জন্মানো কাঁচামরিচ সহযোগে সুস্বাদু টাকো দিয়ে রাতের খাওয়া সেরেছেন।
মহাশূন্যের আদর্শ খাবার হয় পুষ্টিকর এবং পরিমাণে কম। শূন্য অভিকর্ষজ ত্বরণে বেঁচে থাকার জন্য মানবদেহের প্রচুর ক্যালরি প্রয়োজন হয়। এমন অবস্থায় প্রতিদিন অন্তত ২ হাজার ৫০০ ক্যালরি শক্তি লাগে।
প্রথম দিকে মহাশূন্যে এমন খাবার দেওয়া হতো যা গিলতে সহজ, বানাতে কষ্ট হয় কম এবং দীর্ঘদিন অক্ষত অবস্থায় টিকে থাকে।
নভোচারীদের বেশি খিদে পায়। তাদের যত খাবারই দেওয়া হোক না কেন, কোনো পরিমাণই যথেষ্ট হবে না।
প্রথম দিকে মহাশূন্যে যে খাবার দেওয়া হতো, তা ভোজনরসিকদের পছন্দের ছিল না। সে সময় নভোচারীরা অন্তরীক্ষে উড়াল দিতেন টুথপেস্টের মতো খাবার টিউবে ভর্তি করে। তাদের সঙ্গে দেওয়া হতো পুষ্টিকর খাবারে কাই। এসব খাবারের স্বাদ বলতে কিছুই ছিল না। হজমও হতো না সহজে।
জেমিনি প্রোগ্রামের আওতায় পানিশূন্য খাবার দেওয়া হতে থাকে নভোচারীদের সঙ্গে। সেই খাবারের তালিকায় থাকত ফল, সালাদ, মাংস, স্যুপ ও মিষ্টান্ন। খাবার শুকিয়ে ফেললে ওজন অনেক কমে যেত। এগুলোকে ফের পানিপূর্ণ করা যেত, কিন্তু সেটি ছিল বড্ড 'ধীর প্রক্রিয়া'।
অ্যাপোলো প্রোগ্রামের নভোযানে ক্রু-মেম্বাররা বিকিরত ময়দা দিয়ে তৈরি রুটির স্যান্ডউইচ খেয়েছিলেন। এছাড়াও তাদের ফয়েলের প্যাকেজে করে থার্মোস্ট্যাবিলাইজড খাবার দেওয়া হয়েছিল। এর কল্যাণে ওসব খাবারের স্বাভাবিক আর্দ্রতা বজায় ছিল।
১৯৭০-এর দশকে স্কাইল্যাব স্পেস স্টেশন নিয়ে আসা রান্না করা ও হিমায়িত খাবার। সব খাবার সিল করা অ্যালুমিনিয়ামের ক্যানে আলাদা করে প্যাকেজ করে দেওয়া হয়েছিল।
দুর্ভাগ্যবশত, ওই প্যাকেজিং তেমন কাজে দেয়নি। লম্বা সফরে প্যাকেজিং বড় সমস্যা হয়ে যায়। প্লাস্টিক, ফয়েল ও অন্যান্য মোড়ক খাবার ১৮ মাসের বেশি তাজা রাখতে পারে না।
এই মোড়কের কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার দারুণ একটা উপায় হলো মহাকাশযানেই খাবার ফলানো। আইএসএসে চড়া নভোচারীরা ওতে সফল্ভাবে লেটুস, মূলা ও পাতাকপি ফলিয়েছেন।
কাঁচামরিচের পরীক্ষাটিতে সফল হতে দুই বছর লেগেছে। একদিন হয়তো মহাশূন্য আরও বেশি খাবারের প্রয়োজন হতে পারে নভোচারীদের।
অন্তরীক্ষে মুরগি, মাছ, শামুক, নিউটস, সামুদ্রিক আর্চিন লার্ভা ও রেশমপোকা বড় করা যায় কি না সেই সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছেন বিজ্ঞানীরা।
মার্কিন নভোচারীরা এখনও প্যাকেজ করা, হিমায়িত শুকনো খাবারের ওপর নির্ভরশীল। বিজ্ঞানীরা আরও স্বাস্থ্যকর ও সুস্বাদু খাবার মহাকাশে পাঠানোর উপায় খোঁজার চেষ্টা করছেন। আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতেই সাফল্য ধরা দেবে তাদের হাতে।