কোটিপতি ব্যবসায়ী থেকে ফুটপাতের দোকানি
জাহাজ, লঞ্চ, স্টিমারসহ নৌযানে সবসময় জমজমাট থাকে নোয়াখালীর চেয়ারম্যান ঘাট। নৌযানের তেল এবং গ্যাসের সিলিন্ডারের ব্যবসা ভালোই চলছিল চল্লিশ ছুঁইছুঁই মোঃ সাইফুল ইসলামের। পরিবার নিয়েও দিন যাচ্ছিল সুখে। হঠাৎ এক ঝড় এসে সব কেড়ে নিল তার। ২০২০ সালের ২২ জুন রাতে সাইফুলের ওই দোকানে গ্যাস সিলিন্ডার থেকে আগুন লেগে মারা যান তিন জন। নগদ টাকাসহ পুড়ে ছাই হয়ে যায় দুই কোটির টাকার মালামাল।
অগ্নিকাণ্ডের মাত্র মিনিট পাঁচেক আগে দোকানের বাইরে গিয়ে ভাগ্যক্রমে আগুন থেকে রক্ষা পান তিনি। তবে এ আগুন তাকে কোটিপতি থেকে একেবারে নিঃস্ব করেই ছাড়ে! শেষ পর্যন্ত সাইফুলের ঠাই হল চট্টগ্রাম শহরের স্টেশন রোড় এলাকার ফুটপাতে। রাস্তার ওপর ছোট টেবিল পেতে মোবাইলে অ্যাকসেসোরিজ (হেডফোন, চার্জার, পুরাতন মোবাইল) বিক্রিই এখন তার জীবিকা। তবুও ঘুরে দাঁড়ানোর প্রবল চেষ্টায় আছেন তিনি।
১৯৭৯ সালে সাইফুলের বাবা মোঃ রশিদ মিয়া নিজ বাড়ি কক্সবাজারের চকরিয়া থেকে নোয়াখালীর হাতিয়ায় ব্যসায়ের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেন। শুরুতে তিনি বাঁশের ব্যবসা করলেও ১৯৯৮ সালে হাতিয়াঘাটে নৌযানের তেল ও মুদিমালের দোকান দেন। ১৯৯৬ সালে পরিবার এনে হাতিয়ায় স্থায়ী বসতি গড়েন তিনি। স্ত্রী, ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের সংসার চলতো এই ব্যবসা থেকেই।
বড় ছেলে সাইফুল ২০০৩ সালে বাবার ব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্ত হন। ২০০৬ সালে বাবা রশিদের শরীরে বোন ক্যান্সার ধরা পড়ে। তখন পুরো পরিবারে দায়িত্ব এসে পড়ে সাইফুলের কাঁধে। ধীরে ধীরে ব্যবসায়ের পরিধি বাড়াতে থাকেন তিনি। ২০১৩ সালের থেকে ব্যবসায়ের প্রসার হয়। ২০১৮ সালে চেয়ারম্যান ঘাটে বড় পরিসরে আরও একটি দোকান দিয়ে নৌযানের তেল ও সিলিন্ডার গ্যাসের ব্যবসা শুরু করেন সাইফুল। সঙ্গে কয়েকজন অংশীদারও ছিলেন। পুরো চেয়ারম্যান ঘাটের তেলের বড় ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিতি পান সাইফুল ও তারা অংশীদাররা। কিন্তু এমন ভালো সময় বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ২০২০ সালের ২২ জুন রাতে গ্যাসের সিলিন্ডার থেকে আগুন লাগে সাইফুলের দোকানে। দুই দোকানের সব টাকাসহ পুড়ে যায় প্রায় দুই কোটি টাকার সম্পদ। তবে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তিনি।
এরপর ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। অগ্নিকাণ্ডের পরে হাতিয়া ঘাটের দোকানটি রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় দুইবার লুট হয়। পরে সব ছেড়ে দীর্ঘ দিন চাকরির চেষ্টা করেন ডিগ্রি পাশ সাইফুল। কিন্তু চল্লিশ বছর বয়সের কারণে চাকরির দুয়ার থেকেও ফিরতে হয় তাকে। পরে সব ছেড়ে চট্টগ্রামে জীবিকার সন্ধানে চলে আসেন তিনি। তবে স্কুল পড়ুয়া দুই মেয়েকে নিয়ে এখনো হাতিয়ায় থাকেন সাইফুলের স্ত্রী।
শুক্রবার সকালে নগরীর স্টেশন রোড এলাকায় সাইফুলের ছোট দোকানে গিয়ে কথা বলেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের প্রতিবেদক। মাত্র ১২দিন আগে এখানে ব্যবসা শুরু করেন তিনি। দিনে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় তার। এ দিয়েই চলছে জীবন। ছোট ভাই নিজের স্ত্রীর বিয়ের গহনা বন্ধক রেখে ২৫ হাজার টাকা তুলে দেন সাইফুলের হাতে। তা দিয়েই নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন তিনি।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে সাইফুল বলেন, "নদী ভাঙন আমাদের কখনও স্থির থাকতে দেয়নি। ২০০৪ সালের দিকে হাতিয়ার ননাচিড়ায় প্রথম বার আমাদের ভিটে গিলে ফেলে নদী। এরপর আরও দুই ধাপে ২০০৯ সালে ভূইয়ারহাট এবং ২০১৬ সালে সোলেমান মার্কেটে গড়া ভিটেও গিলে খায় সর্বনাশা মেঘনা। তবুও বারবার ঘুড়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি। শুধু ভিটে নয়, হাতিয়াঘাটের দোকানও বহু বার ছোট ছোট করে ভেঙেছে নদী। দোকান অনেক দূরে সরাতে হয়েছে। এমনও সপ্তাহ গেছে, দুই বার দোকান সরিয়েছি। যুদ্ধ করেই জীবন চলছে।"
১৯৮০ সালে কক্সবাজারের চকরিয়ায় জন্ম সাইফুলের। ১৯৯৭ সালে হাতিয়ার সুবচর মফিজিয়া স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করে ভর্তি হন চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ডিপ্লোমা সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। সেখান থেকে পড়শোনা শেষ না করেই হাতিয়া কলেজে ভর্তি হয়ে এইচএসসি সম্পন্ন করেন তিনি। এরপর উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি সম্পন্ন করেন সাইফুল। নিজের আত্মবিশ্বাসের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, "আমি সবসময় ব্যবসা করেছি। ব্যবসা আমাকে টানে। এই ছোট ব্যবসা দিয়ে আবার নতুন ভাবে শুরু করছি। ভালো কোনো সুযোগ পেলে আবারও ঘুড়ে দাঁড়াতে পারবো।"