না ছিল রেডিও, না টেলিগ্রাফ: ১০০ বছর আগেও সৌদি আরবে যেভাবে ঈদের ঘোষণা দেওয়া হতো
সৌদি আরব বিশ্বের বৃহত্তম তেল অর্থনীতি। জ্বালানি সম্পদের প্রাচুর্যে আজ দেশটি জুড়ে প্রযুক্তির ছড়াছড়ি। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে আজ সহজেই জানানো যায় ঈদের দিনক্ষণ। টেলিভিশন, রেডিওসহ ডিজিটাল মাধ্যমে আজ শুধু সৌদি আরবে নয়, বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি মুসলমান পায় সিয়াম সাধনার মাস শেষে খুশির ঈদের বার্তা।
কিন্তু, ১০০ বছর আগে বিষয়টি এত সহজ ছিল না। মরুরাজ্য সৌদিতে তখন ঈদের চাঁদ দেখার চূড়ান্ত ঘোষণাটি দিতেন মক্কার গ্র্যান্ড বা সর্বোচ্চ মুফতি। টেলিগ্রাফের লাইন তখনও দেখেনি ইসলাম ধর্মের জন্মভূমির বাসিন্দারা। একমাত্র উপায় ছিল উট সওয়ার বার্তা বাহকের দল। তারাই মক্কা থেকে সর্বোচ্চ মুফতির ঈদ ঘোষণা নিয়ে ছুটতো দিকে দিকে। যাত্রাপথে যেসব গ্রাম পড়তো সেখানে যত বেশি সম্ভব পরিবারকে শুভ সংবাদটি জানিয়ে আবার বাহন নিয়ে ছুটতো রুদ্ধশ্বাসে।
এই ব্যবস্থার কারণে প্রায়ই দেখা যেত, একেক গ্রাম একেক দিনে ঈদ উদযাপন করছে। বিস্মৃত সে দিনগুলোর কথা এভাবেই জানিয়েছে সৌদি গণমাধ্যম আল আরাবিয়ায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন।
জ্যোতির্বিদ খালিদ আল-জাক গণমাধ্যমটিকে বলেন, "অতীতে প্রতিটি গ্রামে নিজস্ব সময়ে পালিত হতো ঈদ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঈদ পালনে এক গ্রামের সাথে অন্যটির ৪ দিনের বেশি পার্থক্য দেখা যেত।"
তিনি আরেকটু ব্যাখ্যা করে বলেন, "কখনো কখনো ঈদ আসতো গ্রীষ্মকালে, তখন মরুভূমির উত্তপ্ত বালুকারাশি পাড়ি দেওয়া উটসওয়ার বার্তাবাহকের জন্য আরও কষ্টের হয়ে উঠতো।"
"রেডিও আসার পর দিনের ব্যবধান কমে যায়। অবশ্য তখন রেডিও ছিল খুব কম মানুষের কাছে। বেতারে ঈদ ঘোষণা শুধু প্রধান প্রধান জনপদে পৌঁছানো যেত। সেখান থেকে তা আবার আগের মতো করে দূরতম গ্রাম ও বসতিতে পৌঁছে দিত উট সওয়ারীরা।"
"শাওয়ালের বাঁকা চাঁদ দেখা নিয়ে বিপত্তি ছিল চিরকাল। তবে দুর্গম অঞ্চলে ভরসা ছিলেন মুতাওয়া (ধর্মীয় নেতারা)। তারাই রমজানের দিনের হিসাব রাখতেন এবং অনেক সময় সে অনুসারেও ঈদ ঘোষণা করতেন"- যোগ করেন জাক।
আজকাল ঈদের বাঁকা চাঁদ দেখতে মানুষ টেলিস্কোপ ব্যবহার করছে, সুদূর অতীতে এমন যন্ত্র সহজলভ্য না থাকায় দূরের আকাশ দেখাও যেত না।
পুরো বিশ্বের ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা, ঈদের চাঁদ দেখা যাওয়ার আগপর্যন্ত রমজানের রোজা পালন করেন। আর চাঁদ দেখা দিলেই বোঝা যায় রমজান শেষ হয়েছে, শুরু হয়েছে নতুন চন্দ্র মাস- শাওয়াল। এই শাওয়ালের প্রথম দিনই মুসলমানরা পবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপন করেন। চাঁদ দেখার পার্থক্যের কারণে বিশ্বের একেক দেশে নিজস্ব আঙ্গিকে ঈদ পালনের সংস্কৃতিও গড়ে ওঠে।
জাক আরও জানান, সৌদি আরবে প্রথম রেডিও ব্যবহারের অনুমতি ঈদের সংবাদ প্রচারের জন্যই দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে এটি কর্তৃপক্ষের কাছে গণযোগাযোগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে ওঠে।
সাহাবী সৌদি এরাবিয়ান হেরিটেজ সংস্থার গবেষক সুলাইমান আল-ফায়েজের বরাতে আল আলাবিয়া জানায়, এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে ঈদ পালনের পার্থক্য নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত আছে সৌদি লোককথায়। এমনই একটি গল্প আছে টেলিগ্রাফ যখন প্রথম আসে সেই সময়ের একটি মজার ঘটনা নিয়ে।
গল্পটি সৌদির কাশিম অঞ্চলের। আল-ফায়েজ বলেন, ওই সময় ঈদের নির্দিষ্ট দিনতারিখ জানতে কাছের নিকটবর্তী মফস্বলে নিজেদের দূত পাঠায় একটি গ্রামের বাসিন্দারা। দূত সেখানে এসে দেখলেন মানুষ ঈদ উদযাপন করছে। তিনিও তাদের সাথে আনন্দ-উচ্ছ্বাসে যোগ দেন, ভুলে যান নিজের গ্রামে খবরটি পৌঁছে দেওয়ার তাগিদ।
অবশেষে সেই দূত পরের দিন নিজের গ্রামে ফিরে আসেন এবং দেখেন মানুষ তখনও রোজা পালন করছে। সবাইকে সব কথা খুলে বলার পর, সেবছর দূত মহাশয়কে ঈদের প্রথম দিন দুই দুইবার পালন করতে হয়।
- সূত্র: আল আরাবিয়া অবলম্বনে