লাল দালান: এ সময়ের এক শিক্ষাভবনের গল্প
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সাথে জড়িয়ে থাকে সেখানকার শিক্ষার্থীদের শত স্মৃতি, আবেগ আর অনুভূতি। শিক্ষাজীবন শেষ হওয়ার অনেক বছর পরও ক্যাম্পাস বিল্ডিংয়ের দেয়ালে দেয়ালে প্রাক্তনেরা খুঁজে পায় তাদের সোনালি অতীত। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিতি তৈরির সাথে এর ভবনের নকশা বা বিল্ডিং ডিজাইনও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাড্ডার সাতারকুলে অবস্থিত ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ডিআইইউ)-র প্রশাসনিক ভবনের স্বতন্ত্র ডিজাইন এই বিশ্ববিদ্যালয়কে পরিচয় করিয়ে দেয় নতুন করে।
ডিআইইউ-এর স্থায়ী ক্যাম্পাসের লাল ভবনটি বানানো হয়েছিল শিক্ষক আর শিক্ষার্থীদের মিলনমেলার কেন্দ্র হিসেবে। এক বিল্ডিং-এর মধ্যে ক্লাসরুম, প্রশাসনিক কাজের রুম, লাইব্রেরি সবকিছু রাখার চিন্তা ছিল। কম বাজেট আর অল্প জায়গায় পরিকল্পনামতো ভবনটি বানানোর জন্য ডিআইইউ এর ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান শামীম হায়দার পাটোয়ারী শরণাপন্ন হয়েছিলেন তার বাল্যবন্ধু ও প্রতিষ্ঠিত স্থপতি নবী নেওয়াজ খান শমিনের। স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান 'আর্কি গ্রাউন্ড' এর সহপ্রতিষ্ঠাতা নবী নেওয়াজ বন্ধুর চাহিদাকে মাথায় রেখেই ডিজাইন করেছিলেন ভবনটি। স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে সাথে ছিলেন আদনান তানভীর নেওয়াজ।
তিনতলা একটা লাল দালান, তার দেয়ালজুড়ে বড় কাচের জানালায় বইছে আলো বাতাসের স্বপ্নীল খেলা। পুরো ভবনের ভেতর আর বাইরে একই লাল স্তর। অমসৃণ দেয়ালে রঙের পরিবর্তে সুড়কির প্রলেপ। ফ্লোরেও সাধারণ টাইলসের বদলে ইটের মোজাইক দেওয়া। ভবন জুড়ে আছে দেশীয় নানন্দিক স্থাপত্যের ছাপ। স্থপতি নবী নেওয়াজের মতে দেশীয় উপকরণ ব্যবহার করে শিল্পকুশলতার ছাপ রেখে ভবনটির পরিপূর্ণ রূপ দেওয়া ছিল তার লক্ষ্য।
"ঢাকার উপকণ্ঠে সাতারকুল এরিয়াতে কাজ করতে হয়েছিল আমাকে। প্রায় ১ বিঘা জমির উপর একটা কর্নার প্লটে ১৮০০ বর্গফুট জায়গা ছিল বিল্ডিংটির জন্য নির্ধারিত। একে তো শহরতলীর মতো একটা জায়গা, তার উপর ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। আশেপাশে খুব বেশি স্থাপনা না থাকায় প্রবল বাতাস থাকে সবসময়। সেই এলাকায় বেশ কিছু বিল্ডিং এই বাতাসের তোড়েই ভেঙ্গে গেছে। তাই এমন জায়গায় নির্মাণ করতে গিয়ে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়েছিল আমাদের," বলছিলেন স্থপতি নবী নেওয়াজ খান।
ভূমিকম্পের ঝুঁকি এড়িয়ে মজবুত ভিত্তি স্থাপন করতে ভবনটিতে ব্যবহার করা হয়েছে স্টিলের স্ট্রাকচার। প্রবল বাতাসের ধাক্কায় কাঁচের জানালা টিকিয়ে রাখা মুশকিল ছিল। তাই জানলায় কাঁচের বাইরে ইংরেজি অক্ষর 'এল' (L) আকৃতির দেড় ইঞ্চি সাইজের ধাতব পাতের স্তর বসানো হয়েছে। এই ধাতব কাঠামোগুলো উত্তাল বাতাসের ঝাপটা থেকে সুরক্ষা দিয়ে ভবনকে ঝুঁকিমুক্ত রাখতে সাহায্য করেছে। শিক্ষার্থীদের বিনোদনের জায়গা হিসেবে ভবনের ছাদের নকশা করা হয়েছিল।
নবী নেওয়াজের ভাষ্যে, "আমাদের সংস্কৃতিতে প্রশাসনিক বিল্ডিং মানেই লাল দালান। আবহমান বাংলার সাথে মিশে আছে এই লাল রঙ। তাই ক্লায়েন্টের প্রধান ইচ্ছা ছিল লাল রঙের হতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিশিয়াল বিল্ডিংটি। কম খরচে বিল্ডিং জুড়ে লাল রঙের ছোঁয়া আনতে আমরা ব্যবহার করেছিলাম হাতে ভাঙ্গা সুড়কি।"
সীমিত বাজেটের জন্য প্রতিটা পদক্ষেপ অনেক চিন্তাভাবনা করে নিতে হয়েছে আর্কি গ্রাউন্ডের নির্মাতাদের। নির্মাণ এলাকায় পড়ে থাকা ইট, সুড়কি ব্যবহার করেছিলেন তারা ভবনটিতে। এতে অনেকটাই কমেছিল নির্মাণ ব্যয়। দেয়ালে প্রলেপের জন্য তিন সাইজের সুড়কি ব্যবহার করেছেন নবী নেওয়াজ খান। 'পেবেল ওয়াশ' পদ্ধতি ব্যবহার করে আস্তরণ দিয়েছেন দেয়ালে। দেশী উপকরণ ব্যবহারের পাশাপাশি তা যেন পরিবেশবান্ধব হয় সেদিকটা খেয়াল রেখেছেন বরাবর।
"পশ্চিমের রোদ, উত্তরের আলো, দক্ষিণের বাতাস সব যেন সহজেই প্রবেশ করতে পারে বিল্ডিং-এর ভেতর সেই ব্যবস্থা করেছিলাম আমরা। এতে ইলেক্ট্রিসিটি ব্যবহারের খরচ কমে যায় অনেকটাই। দেয়ালে সুড়কির প্রলেপ দিয়ে রঙের কাজ সারায় এর রক্ষণাবেক্ষণ খরচ কমে যায়। পাশাপাশি একটা স্থায়ী মনুমেন্টাল কোয়ালিটিও যোগ হয় এতে," জানান স্থপতি।
পুরো প্রজেক্টে 'ক্র্যাফটম্যানশিপ" এর দক্ষতা বজায় রাখা ছিল নিজের সাথেই নবী নেওয়াজের প্রধান চ্যালেঞ্জ। ডিজাইন থেকে শুরু করে উপকরণে ভিন্নতা, কম বাজেটে সর্বোচ্চ সৃজনশীলতা আনা-সবটাই সম্ভব হয় এই শিল্পকুশলতার প্রয়োগে। স্থানীয় শ্রমিকেরা এধরনের কাজে অভ্যস্ত ছিলেন না। সার্বক্ষণিক তাদের তদারক করতে হয়েছে নিজে উপস্থিত থেকে। একটু অমনোযোগী হলেই কাজে মনমতো ফল পেতেন না। নির্মাণ এলাকায় যাতায়াতের সুবিধা না থাকলেও রোজ সময়মতো সেখানে উপস্থিত থাকতেন তিনি।
স্মৃতিচারণ করে বলেন, "একদিন সাইটে গিয়ে দেখি একটা ভারী বাউন্ডারি উপড়ে পড়ে আছে। আগেরদিন ঝড় হয়েছিল এখানে। বাতাসের ধাক্কাতে এই ভারী দেয়ালও উপড়ে গেছে। সেদিন খুব ভয় পেয়েছিলাম। আমাদের এই স্থাপনা টিকবে তো! তবে এই ঝুঁকি মোকাবেলায় আমরা বেশ সফলই হয়েছি।"
নবী নেওয়াজ খান ও তার দল ২০১৫ সালের পুরো সময় কাজ করেছেন ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির এই ভবনের ডিজাইন থেকে শুরু করে নির্মাণ শেষ করতে।বাজেট কম থাকায় সিলিং এর ইলেকট্রিকাল লাইটিং, আসবাবপত্র আর ইন্টেরিয়র ডিজাইনের মতো বেশ কিছু দিকের বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। খরচ কমাতে পুরোনো আসবাবপত্রই ব্যবহার করা হয়েছে নতুন ভবনে।
২০১৬ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এই ভবনটিতে চলেছে ক্যাম্পাসের যাবতীয় কাজ। পরবর্তীতে নতুন ভবন নির্মাণের পর এটিকে শুধু প্রশাসনিক ভবন হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
"ম্যাটেরিয়াল নিয়ে আমার এধরনের এক্সপেরিমেন্ট প্রথমবার ছিল। পরবর্তীতে এই পদ্ধতি আরো অনেক বিল্ডিং এ এপ্লাই করেছি। আমার প্রথমদিকের একটা কাজ ছিল ডিআইইউ-এর এই বিল্ডিংটা। তাই সাদামাটা হলেও কাজটা সবসময় স্পেশাল হয়ে থকবে আমার কাছে," বলেন নবী নেওয়াজ খান শমিন।
তিন বন্ধুর যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত 'আর্কি গ্রাউন্ড'-এ ১৪ বছরের স্থাপত্যশৈলীর কর্মজীবনে নবী নেওয়াজ পার করেছেন অনেক চড়াই-উতরাই। বাংলাদেশে ও দেশের বাইরে নানা সময়ে পেয়েছেন অনেক পুরস্কার। তার কর্মজীবনের অন্যতম পছন্দের কাজ ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রশাসনিক ভবনের ডিজাইন নিয়ে এখনও অনেকের কাছেই প্রশংসাবাণী শোনেন এই স্থপতি।