একমাস পেরিয়ে গেলেও শুরু হয়নি হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ
সুনামগঞ্জের হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ গত ১৫ ডিসেম্বর শুরুর কথা থাকলেও ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত এর অর্ধেক কাজই শুরু হয়নি। সময়সীমার একমাস পরও কাজ শুরু না হওয়ায় নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতে অকাল বন্যায় ফসল তলিয়ে যাওয়ারও আশঙ্কা করছেন হাওরপাড়ের কৃষক।
যদিও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, সঠিক সময়েই বাঁধের কাজ শেষ করা হবে। হাওরে পানি দেরিতে নামার কারণে বাঁধের কাজ শুরু হতেও দেরি হচ্ছে বলে দাবি তাদের। আর কৃষকদের শঙ্কা, শেষ সময়ে তাড়াহুড়ো করে কাজ শেষ করতে গিয়ে দায়সারাভাবে বাঁধ নির্মাণ করা হবে। যা পানির তোড়ে ভেসে যাবে। যেভাবে ভেসে গিয়েছিল ২০১৭ সালে।
২০১৭ সালে সঠিক সময়ে হাওরের ফসল রক্ষাবাঁধ নির্মিত না হওয়া ও বাঁধ নির্মাণে অনিয়মের কারণে অকাল বন্যায় তলিয়ে যায় বিস্তীর্ণ বোরো ফসল। সরকারি হিসাবে ওই বছর ফসলরক্ষা বাঁধ ভেঙে দুই লাখ ২৩ হাজার ৮২ হেক্টর জমির বোরো ফসল তলিয়ে যায়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় এক লাখ ৬১ হাজার হেক্টর জমির ফসল। যদিও কৃষকদের হিসাবে এ ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় দ্বিগুণ।
ওই দুর্যোগের পর বাঁধ নির্মাণের নীতিমালায় পরিবর্তন আনে পানি উন্নয়ন বোর্ড। ঠিকাদারি প্রথা বাতিল করে স্থানীয় কৃষকদের অন্তর্র্ভূক্ত করে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠন করে এর মাধ্যমে বাঁধ নির্মাণের নীতিমালা করা হয়। নীতিমালা অনুযায়ী প্রতি উপজেলায় পিআইসির সভাপতি থাকবেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং জেলার জন্য জেলা প্রশাসক।
এবার সুনামগঞ্জে প্রায় ৭০০টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠন করার কথা। তবে এখন পর্যন্ত গঠন করা প্রায় ৬০০ পিআইসি। আর ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ৪০০টি পিআইসি তাদের কাজ শুরু করতে পারেনি।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, হাওরবেষ্টিত এ জেলা দেশের বোরো ধানের বৃহতাংশের জোগানদাতা। সুনামগঞ্জ জেলাটি সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর অববাহিকায় অবস্থিত। প্রতিবছর মার্চের দিকে অতিবৃষ্টির কারণে হিমালয় থেকে পাহাড়ি ঢল নামে। যা সুরমা ও কুশিয়ারা হয়ে নামতে থাকতে ভাটির দিকে। এতে অপেক্ষাকৃত নিচু অঞ্চল হওয়ায় হাওর এলাকায় দেখা দেয় অকাল বন্যা। ওই অগ্রীম বন্যার হাত থেকে হাওরের বোরো ফসল রক্ষায় ষাটের দশকে হারগুলোতে নির্মাণ করা হয় ফসল রক্ষা বেড়িবাঁধ। ওই বেড়িবাঁধগুলো নদীর পানি হাওরে ঢুকতে দেয় না। ফলে রক্ষা পায় বোরো ফসল। বর্ষা মৌসুমে অতিবৃষ্টি আর বন্যার কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হয় বেড়িবাঁধগুলো। ফলে প্রতিবছরই ফসল রক্ষায় বর্ষা মৌসুম আসার আগে বাঁধগুলো সংস্কার ও পুণঃনির্মাণ করতে হয়।
তবে প্রতিবছরই বাঁধ নির্মাণে বিলম্ব আর অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। এবারও একই অভিযোগ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।
সুনামগঞ্জের বৃহৎ দু’টি হাওর মাটিয়ান হাওর ও শনির হাওর। এই দুই হাওরে ৪০টি পিআইসির মাধ্যমে বাঁধের কাজ করার কথা। তবে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত মাত্র ৫টি পিআইসি কাজ শুরু করেছে। বাকীগুলো এখনও কাজই শুরু করেনি।
শনির হাওর এলাকার কৃষক সাত্তার আহমদ বলেন, এখন পর্যন্ত বাঁধের কাজ শুরু হয়নি। সবগুলো পিআইসি-ই এখন পর্যন্ত গঠন করা যায়নি। এভাবে শুরুতেই গড়িমসি করলে পরে আমাদের ফসল নিয়ে বিপদে পড়তে হবে।
তাহিরপুর উপজেলার কৃষক সমিরণ দাস বলেন, বাঁধের কাজ এখনও শুরু হয়নি। শেষ সময়ে দেখা যাবে তাড়াহুড়ো করে দায়সারাভাবে বাঁধের কাজ শেষ করা হবে। এতে অল্প বৃষ্টিতেই বাঁধ ভেঙে ফসল তলিয়ে যাবে।
সুনামগঞ্জের নাগরিক সংগঠন ‘হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলন’-এর সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন বলেন, হাওরের পানি না নামার কারণে বাঁধের কাজ শুরুতে বিলম্বের কথা বলছেন পাউবো কর্মকর্তারা। তবে পানি দ্রুত নামার জন্য কোনো উদ্যোগ তারা নেননি। এভাবে বসে থাকলে তো কোনো সমাধান হবে না। কারণ ফেব্রুয়ারি থেকে এ এলাকায় বৃষ্টি শুরু হয়। আর মার্চে দেখা দেয় অকাল বন্যা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, জেলার ১১ উপজেলার ছোট-বড় ৪২টি হাওরে এ বছর প্রাথমিকভাবে ৮৫৬ কিলোমিটার বাঁধ মেরামত, সংস্কার ও নির্মাণ করা হবে। এগুলো নির্মাণ করতে ৭০৪টি পিআইসি গঠন করার কথা। জেলায় বাঁধ নির্মাণে প্রাথমিকভাবে মন্ত্রণালয় ৬৭ কোটি ৪৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বাঁধের কাজ শেষ হওয়ার কথা।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সুনামগঞ্জ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী সবিবুর রহমান বলেন, ‘‘নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় অনেক হাওরের পানি দেরিতে নেমেছে। কিছু হাওরে এখনও পানি রয়ে গেছে। ফলে বাঁধের কাজ শুরু করতে দেরি হয়েছে। তবে এখন বেশিরভাগ বাঁধের কাজ শুরু হয়ে গেছে। বাকিগুলোও দু’একদিনের মধ্যে শুরু হয়ে যাবে।’’
তিনি বলেন, ‘‘গত বছরও জানুয়ারিতে কাজ শুরু হয়েছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়েই কাজ শেষ হয়েছে। এবারোও সঠিক সময়ে কাজ শেষ করা সম্ভব হবে।’’
পানি উন্নয়ন বোর্ডের এই কর্মকর্তা বলেন, সুরমা নদীর নাব্যতা সঙ্কট দূর করতে কয়েকটি জায়গায় নদী খনন করা হয়েছে। আরও কয়েকটি পয়েন্টে খননের পরিকল্পনা রয়েছে।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক আবদুল আহাদ বলেন, কোনো অবহেলা ছাড়া বাঁধের কাজ যেন নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হয় এ ব্যাপারে কঠোর নজরদারি রাখা হয়েছে।