এখনও কাজের সন্ধানে নিম্ন আয়ের মানুষ
লকডাউন শিথিল করে সবকিছু খুলে দেয়া হলেও দিনমজুর ও নিম্ন আয়ের মানুষের অবস্থার তেমন পরিবর্তন হয় নি। তারা এখনও কাজের সন্ধানে ঘুরছেন। বিগত কয়েকদিনে তাদের আয়- রোজগারে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যায় নি।
১৬ হাজার টাকায় নিজের ভ্যান বিক্রি করে আবার সেই ভ্যানই ২১ হাজার টাকায় কিস্তিতে কিনেছেন মো. শাহজাহান। টিবিএসকে শাহজাহান বলেন, "ঘরে টাকা নেই, পরিবারের ৫ সদস্যের খাবার জোগাতে গত মাসে ভ্যানটি বিক্রি করে দেই। ৩ হাজার টাকা করে ৭ মাসের কিস্তিতে ভ্যানটির টাকা পরিশোধ করতে হবে"।
শাহজাহান বলেন, "লকডাউন ছেড়ে দিয়েছে কিন্তু কাজ তো পাচ্ছি না। সিমেন্ট, রং, ফার্নিচারসহ স্যানিটারি মালামাল এখনও তেমন বিক্রি হয় না তাই ভাড়াও পাচ্ছি না"।
রাজধানীর বিভিন্ন শ্রমবাজারে দিনমজুরেরা কাজের জন্য এখনও ভিড় করছেন প্রতিদিন। দুই-একজন কিছু কাজ পেলেও সেটা যথেষ্ট নয় বলে জানান তারা।
গত শনিবার মগবাজার মোড়ে ভোর থেকে কাজের সন্ধানে প্রায় ১০০ জন দিনমজুর বসে ছিলেন। সাইফুল ইসলাম রং দেয়ার কাজ করেন। তিনি বলেন, "লকডাউন খুললেও এখনও একদিনও কাজ পাই নি। এখন বেলা ১১টা বেজে গেছে। আজও (শনিবার) মনে হয় কাজ পাবো না"।
মো. মৌজালি দিনমজুরের কাজ করেন। তিনি বলেন, "কন্ট্রাক্টররাই তো এখনও কাজ শুরু করেনি। ছেলেটাও দিনমজুর, তারও কাজ নেই। প্রতিমাসে ৫ হাজার টাকা ঘরভাড়া; সেটা ৩ মাস দিতে পারি নি। কাজ নেই তাই দোকান থেকে বাকিতে চাল, ডাল এনে পরিবারে ৪ জন সদস্য কোনমতে বেঁচে আছি"।
করোনার মধ্যে সরকারি বা বেসরকারি কোন সহায়তা পান নি বলেও জানান মো. মৌজালি।
ট্রাকের হেলপার মো. রুবেল বলেন, "গতকাল কাজ পেয়েছিলাম। এক ট্রাক মাটি ফেলেছি সেখানে ৩০০ টাকা পেয়েছি। আজ আবারও কাজের সন্ধানে বের হয়েছি"।
এদিকে লকডাউনের সময় রিক্সাচালকদের যে আয় হতো তার চেয়েও এখন কমে গেছে। মগবাজার, বাংলামোটর, কল্যাণপুরসহ রাজধানীর বেশ কয়েকটি মোড়ে রিক্সাচালকদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
ভোলার লালমোহন উপজেলা থেকে এক মাস যাবত কাজের সন্ধানে ঢাকায় এসেছেন মো. আলামিন। তিনি বলেন, "গ্রামে অটোরিক্সা চালাতাম। কিন্তু লকডাউনে গাড়ি না চালাতে পেরে ৫০ হাজার টাকা দেনা হয়েছে। তাই ঢাকায় এসেছি। লকডাউনের ঢাকায় রিক্সা চালিয়ে ভালই আয় হতো, প্রতিদিন ৭০০ টাকা থাকতো। এখন ৪০০ টাকা আয় হয়"।
এদিকে কল্যাণপুর বস্তিতে গিয়ে দেখা যায়, যারা বাসায় কাজ করতো তারা এখনও কাজে যেতে পারছেন না। বিভিন্ন বাসায় রান্না ও কাপড় ধোয়ার কাজ করতো এমন ২০ জন নারীর সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, তারা যে বাসায় কাজ করতেন সেই বাসার মালিক জানিয়ে দিয়েছে করোনা টিকা নিতে। আর করোনার সংক্রমণ কমে আসলে তারা কাজে আসতে বলবেন।
জান্নাত মিরপুর-১ নম্বরের একটি বাসায় রান্নার কাজ করতো। ৬ মাস আগে তাকে কাজ থেকে বাদ দিয়ে দেয়। বলা হয়েছিল, করোনার প্রকোপ কমলে কাজে নেয়া হবে, কিন্তু এখনও তাকে কাজে ডাকা হয় নি।
জান্নাত বলেন, "গতকাল গিয়েছি কাজ করতে কিন্তু ঘরে ঢুকতে দেয় নি। বলেছে, করোনা টিকা নিতে, এরপর কবে আসতে হবে সেটা জানাবে"। জান্নাতের স্বামী ভ্যান চালায়। জান্নাত বলেন, "ডাল ভাত খেয়ে বেঁচে আছি। এই করোনায় সরকারের কোন সহায়তা আমরা পাই নি"।
হালিমা বলেন, "মালিকেরা করোনাকে ভয় করে। তারা মনে করে আমরা করোনা ভাইরাস তাদের বাসায় ঢুকাবো"।
কল্যাণপুর নতুন বাজার রাস্তার ধারে চুরি, ক্লিপ, লিপস্টিক, আয়না সহ মেয়েদের সাজগোজের জিনিস বিক্রি করেন রুমা। রুমার স্বামী রিক্সা চালায়। রুমা বলেন, "লকডাউনে তো বিক্রি বন্ধ ছিল। আজ ৩ হাজার টাকার মাল কিনে আনলাম। দুপুর পর্যন্ত এক টাকাও বিক্রি হয় নি"।
রুমার আশা আর লকডাউন দেয়া না হলে এ মাল বিক্রি হয়ে যাবে।
রুমা বলেন, "আসলে মানুষের হাতে টাকা না থাকলে কে কিনবে এগুলো! মনে শান্তি থাকলে তো সাজগোজ করবে। তবুও আশা করি লকডাউন আর দিবে না সরকার। মানুষেরও আয় বাড়বে, বেঁচাকেনাও ভাল হবে"।
সিএনজি চালক আব্দুল বারেক বলেন, "লকডাউনে সিএনজি নিয়ে বের হওয়া যায় নি। এখন বের হচ্ছি। প্রতিদিন ৮০০ টাকা মালিককে দিতে হয়। তার ওপর গ্যাস ভরার খরচ আছে- এসব বাদ দিয়ে প্রতিদিন ৫০০ টাকার মতো আয় হয়। এ টাকা দিয়ে ৪ জন পরিবারের সদস্য নিয়ে কোন মতে খেয়ে-পরে বেঁচে আছি"।
আরেকজন সিএনজি চালক আলাউদ্দিন বলেন, "এখন লোকে বাসেই যাচ্ছে বেশি। আগে যিনি অফিসে সিএনজিতে করে যেতেন, এখন দেখা যায় টাকার অভাবে তিনি একটু হেঁটে বাসে চড়ে যায়। যারা পরিবার নিয়ে বের হন অথবা জরুরি কোন কাজ আছে তারা সিএনজিতে উঠছেন"।
প্রতিদিন ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা আয় হয় জানিয়ে আলাউদ্দিন বলেন, "করোনার আগে প্রতিদিন এক হাজার টাকা আয় হতো"।