কোভিডের কারণে নিয়মিত চিকিৎসা পাননি দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্তরা, বেড়েছে মৃত্যুর ঝুঁকি
কোভিড মহামারির কারণে গত দুই বছরে লম্বা সময় ধরে রোগে ভোগা মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। সেইসঙ্গে রোগের স্ক্রিনিং, চিকিৎসা ও ফলোআপ বন্ধ থাকার কারণে তাদের ভোগান্তি আরও তীব্র হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডাক্তাররা।
ভাইরাসটি এখন দুর্বল হয়ে আসায় হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস ও দীর্ঘমেয়াদী ফুসফুস-সংক্রান্ত রোগের সম্ভাবনা কমানোর জন্য কর্তৃপক্ষকে নন-কমিউনিকেবল ডিজিজের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন গণস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। সেইসঙ্গে প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপ ও ক্লিনিক্যাল কেয়ারের প্রতি মনোযোগ বৃদ্ধির ওপর জোর দিয়েছেন তারা। বর্তমান পরিস্থিতি এসব রোগীদের রোগের মাত্রা বৃদ্ধি করেছে।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের এপিডেমিওলজি অ্যান্ড রিসার্চ বিভাগের প্রধান, অধ্যাপক ড. সোহেল রেজা চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, করোনাকালে ঘরবন্দি থাকায় মানুষের হাঁটাচলা কম হয়েছে। স্ক্রিনিং ও ফলোআপ না হওয়ায় হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিস, হার্টের রোগ বেড়ে গেছে। এছাড়া যাদের কোভিড হয়েছে, তাদের অনেকেই নতুন করে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, হাইপারটেনশনে আক্রান্ত হচ্ছেন। তাই নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ বার্ডেন (এনসিডি) আরও বেড়েছে।
চিকিৎসকরা বলেছেন, নিয়মিত মেডিকেল চেক-আপ, চিকিৎসার নিয়ম মেনে চলা এবং স্বাস্থ্যকর জীবনধারা নন-কমিউনিকেবল রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখার মূল কৌশল। কোভিডকালে এনসিডি আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রচারণামূলক, প্রতিরোধমূলক ও ক্লিনিক্যাল যত্ন পাচ্ছেন না বলে জানা গেছে। আর এই পরিস্থিতি দীর্ঘদিন ধরে ভোগা রোগের অবস্থাকে আরও খারাপের দিকে নিয়ে গেছে।
'ওল্ডার অ্যাডাল্টস উইথ নন-কমিউনিকেবল ক্রনিক কন্ডিশনস অ্যান্ড দেয়্যার হেলথ কেয়ার অ্যাকসেস অ্যামিড কোভিড-১৯ প্যান্ডেমিক ইন বাংলাদেশ: ফাইন্ডিংস ফ্রম আ ক্রস-সেকশনাল স্টাডি' শীর্ষক একটি গবেষণায় বলা হয়েছে যে, মহামারিকালে ২৩ শতাংশ অংশগ্রহণকারী ওষুধ পেতে অসুবিধার সম্মুখীন হওয়ার কথা জানিয়েছেন। এছাড়াও s২৭ শতাংশ অংশগ্রহণকারী চিকিৎসাসেবা পেতে অসুবিধায় পড়েছেন। একাধিক রোগে ভোগা ব্যক্তিরা এই অসুবিধায় পড়েছেন বেশি।
বিভিন্ন এনসিডিতে ভুগছেন এমন ১ হাজার ৩২ জন বাংলাদেশির ওপর ২০২১ সালে গবেষণাটি করা হয়। গবেষণায় অংশ নেওয়া প্রত্যেকের বয়স ৬০ বছর বা তার বেশি ছিল।
সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হসপিটালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ইউরোলজিস্ট অধ্যাপক ড. মো. কামরুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে কিডনি রোগীদের নিয়মিত ফলোআপে থাকতে হয়। কিন্তু কোভিড মহামারিতে সংক্রমণের ভয়ে রোগীরা নিয়মিত ফলোআপ করাননি।
তিনি বলেন, 'এখন আমরা অনেক রোগী পাচ্ছি যাদের ওষুধে রোগ নিয়ন্ত্রণে থাকতো, কিন্তু এখন ডায়ালাইসিস করতে হচ্ছে বা ট্রান্সপ্ল্যান্টের কথা ভাবতে হচ্ছে।'
কোভিডে নন-কমিউনিকেবল ডিজিজে মৃত্যু বাড়ার শঙ্কা
অধ্যাপক ড. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, বিভিন্ন দেশের গবেষণায় দেখা গেছে কোভিডের সময় এনসিডিতে মৃত্যু অনেক বেড়ে গেছে। বাংলাদেশে এখনও গবেষণা না হলেও ধারণা করা হচ্ছে যে, দেশে এনসিডিতে মৃত্যু বেড়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট মৃত্যুর ৬৭ শতাংশের জন্য এনসিডি দায়ী বলে অনুমান করা হয়।
স্যাম্পল ভাইটাল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম (এসভিআরএস) ২০২০-এর ওপর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর একটি প্রতিবেদন বলছে যে, ২০২০ সালে আগের বছরের তুলনায় হার্ট অ্যাটাক ও ক্যান্সারে মৃত্যু যথাক্রমে ২৩ শতাংশ ৮৮ শতাংশ বেড়েছে।
ইনিশিয়েটিভ ফর নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ, হেলথ সিস্টেমস অ্যান্ড পপুলেশন স্টাডিজ ডিভিশন, আইসিডিডিআর,বি-র প্রধান ড. আলিয়া নাহিদ টিবিএসকে বলেন, 'দেশে আগে থেকেই নন কমিউনিকেবল ডিজিজ একটি রিস্ক ফ্যাক্টর, কোভিডে ঝুঁকি আরও বেড়েছে। দেশে ৪০ বছরের বেশি বয়সী ও বয়স্ক যারা কোভিডে মারা গেছেন, তারা সবাই হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ক্যান্সারসহ বিভিন্ন ধরনের নন কমিউনিকেবল ডিজিজে আক্রান্ত ছিলেন।'
কোভিডে দেশে এনসিডি রোগী ও মৃত্যু বেড়েছে কি না জানার জন্য গবেষণা করা প্রয়োজন বলে জানান মন্তব্য করেন তিনি।
এনসিডি প্রতিরোধে অবিলম্বে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
ড. নাহিদ আরও বলেন, তরুণ জনগোষ্ঠীকে এনসিডি সম্পর্কে করতে হবে। এছাড়াও এনসিডি রোগীরা যাতে চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে তাৎক্ষনিক সেবা পান, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। এনসিডি নিয়ন্ত্রণে কমিউনিটি মবিলাইজেশন অপরিহার্য বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ড. রেজা চৌধুরী বলেন, সরকারের এখন এনসিডি প্রোগ্রামের আওতায় পাবলিক সেক্টরে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিস স্ক্রিনিং ও নিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দেওয়া উচিত। এটি করা গেলে অকালমৃত্যু কমবে এবং চিকিৎসা খরচও কমে যাবে। খাদ্যাভ্যাস ও স্বাস্থ্যকর জীবনধারা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে প্রচার-প্রচারণা আরও জোরদার করতে হবে।
লাইন ডিরেক্টর, নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল, ডিরেক্টোরেট জেনারেল অভ হেলথ সার্ভিসেস, ড. মোহাম্মদ রোবেদ আমিন টিবিএসকে বলেন, 'কোভিড কমে যাওয়ায় এনসিডিকে এখন গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। আমাদের আগের সব কর্মসূচি, যেগুলো কোভিডের কারণে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, এখন সেগুলোকে আরও জোরদার করা হচ্ছে। উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের ট্রেনিং দেওয়া রয়েছে, তারা কাজ করছে। মানুষকে সচেতন করতে বিভিন্ন দিবসকেন্দ্রিক প্রচার-প্রচারণা চালানো হচ্ছে।'