খুলনায় করোনা হাসপাতালে তিল ধারণের ঠাঁই নেই
খুলনায় সরকারি করোনা হাসপাতালে রোগীতে ঠাসাঠাসি অবস্থা। কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই নেই। ফলে চিকিৎসা পেতে রোগীদের নিয়ে স্বজনদের ছুটতে হচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালে। কিন্তু সেখানেও মিলছে না প্রয়োজনীয় বেড। তার ওপর রয়েছে অক্সিজেন সংকট। সব মিলিয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে রোগী ও তাদের স্বজনদের।
এদিকে, খুলনা মেডিক্যাল কলেজের (খুমেক) আরটি পিসিআর ল্যাব 'দূষিত' হওয়ায় বন্ধ রয়েছে করোনার নমুনা পরীক্ষা। চালু হওয়ার ১৫ মাসের মাথায় প্রথমবারের মতো আজ (বৃহস্পতিবার) থেকে তিনদিনের জন্য বন্ধ থাকবে এই ল্যাব।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খুলনায় করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য সরকারিভাবে দুটি হাসপাতালে করোনা ইউনিট স্থাপন করা হয়েছে। এর একটি খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল পরিচালিত '১৩০ শয্যার ডেডিকেটেড করোনা হাসপাতাল' এবং অপরটি জেনারেল হাসপাতাল পরিচালিত '৭০ শয্যার করোনা ইউনিট'। দুটি মিলিয়ে মোট শয্যা সংখ্যা ২০০টি। এরমধ্যে ডেডিকেটেড করোনা হাসপাতালে ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) রয়েছে মাত্র ২০টি।
অপরদিকে, জেনারেল হাসপাতালে কোনো আইসিইউ নেই। এখানের সব কয়টি শয্যাই সাধারণ। তারপরও গড়ে প্রতিদিন দুটি হাসপাতালে রোগী ভর্তি থাকছেন আড়াই শতাধিক। ফলে সরকারি হাসপাতালে করোনা রোগীদের তিল ধারণের ঠাঁই মিলছে না। এ কারণে বাধ্য হয়ে রোগীদের ছুটতে হচ্ছে বেসরকারি গাজী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। কিস্তু ১০০ বেডের সব পূর্ণ থাকায় সেখানেও রোগী ভর্তি করা সম্ভব অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এর ওপর রয়েছে অক্সিজেন সংকট। ফলে করোনা রোগীদের চিকিৎসা নিয়ে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছে রোগী ও তাদের স্বজনরা।
যশোরের অভয়নগর উপজেলার বাসিন্দা ওয়াসিম ইসলাম ক'দিন ধরে জ্বরে ভুগছিলেন। গত ২৫ জুন করোনা পরীক্ষার জন্য খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নমুনা দেন তিনি। গত সোমবার তার করোনা শনাক্ত হয়। ওয়াসিমের স্বজনরা তাকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য খুলনা জেনারেল হাসপাতালের করোনা ইউনিটে পৌঁছান। কিন্তু শয্যা খালি না থাকায় চিকিৎসকরা তাকে ফিরিয়ে দেন। তার মতো বিভিন্ন উপজেলা থেকে করোনা রোগীরা চিকিৎসা নিতে এসেও বেড খালি না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন।
ওয়াসিম ইসলামের শ্বশুর মনিরুল ইসলাম জানান, তার জামাতাকে অভয়নগরের কোনো হাসপাতালে ভর্তি করাতে না পেরে খুলনায় নিয়ে এসেছেন। রোগীর অক্সিজেন লেবেল ৮৩-৮৫-এর মধ্যে উঠা-নামা করছিল। দ্রুত তার চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। প্রথমে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে করোনা ইউনিটে শয্যা সংখ্যার চেয়ে রোগী বেশি থাকায় তাকে ভর্তি করেনি। তাই জেনারেল হাসপাতালে আনা হয়। 'কিন্তু এখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসকরা জানান, করোনা ইউনিটে সিট খালি নেই। আমি ফ্লোরে ব্যবস্থা করার কথা বললেও তারা দেননি। এখন জামাতাকে নিয়ে ছুটছে হচ্ছে বেসরকারি গাজী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।'
জাহিদুল ইসলাম নামে অপর এক রোগীর স্বজন বলেন, খুলনা ডেডিকেটেড করোনা হাসপাতালে মাত্র ১৩০টি শয্যা। সেখানে শয্যা সংখ্যার চেয়ে অতিরিক্ত রোগীর ভর্তি রয়েছে। অনেককেই ফ্লোরে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু জেনারেল হাসপাতালে শয্যার অতিরিক্ত কোনো রোগী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ভর্তি করছে না।
এদিকে, খুলনা মেডিক্যাল কলেজের (খুমেক) আরটি পিসিআর ল্যাব 'দূষিত' হওয়ায় বন্ধ রয়েছে করোনার নমুনা পরীক্ষা। চালু হওয়ার ১৫ মাসের মাথায় প্রথমবারের মতো গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে তিনদিনের জন্য বন্ধ থাকবে এই ল্যাব। তবে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও খুলনা জেনারেল হাসপাতালের করোনা ইউনিটে থাকা রোগীদের মধ্যে যাদের নমুনা পরীক্ষার প্রয়োজন হবে, তাদের নমুনা সংগ্রহ করে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) পিসিআর ল্যাবে পরীক্ষা করা হবে।
বুধবার নমুনা পরীক্ষা করতে গিয়ে বিষয়টি ধরা পড়ার পর কর্তৃপক্ষ বৃহস্পতিবার থেকে ল্যাবটির কার্যক্রম বন্ধ করে দূষণমুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের করোনা প্রতিরোধ ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনাবিষয়ক কমিটির সভাপতি এবং খুলনা মেডিকেল কলেজের উপাধ্যক্ষ ডা. মো. মেহেদী নেওয়াজ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, 'ল্যাবটি বন্ধ থাকলেও আগে থেকে মজুত থাকা প্রায় দুই হাজার নমুনা ঢাকায় পাঠিয়ে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হবে। বৃহস্পতিবার থেকে যেসব নমুনা সংগ্রহ করা হবে, সেগুলোও এ ল্যাবে এই তিনদিনে পরীক্ষার সুযোগ থাকবে না। তবে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও জেনারেল হাসপাতালের করোনা ইউনিটে অবস্থান করা রোগীদের মধ্যে যাদের পরীক্ষার প্রয়োজন পড়বে, তাদের নমুনা সংগ্রহ করে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) পিসিআর ল্যাব থেকে পরীক্ষা করা হবে।'
আগামী শনিবার অথবা রোববার ল্যাবটি পুনরায় চালু হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
তবে খুমেকের পিসিআর ল্যাব বন্ধ থাকলেও খুলনাসহ জেলার অন্যান্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এন্টিজেন পরীক্ষা যথারীতি চালু থাকবে বলে জানান খুলনার সিভিল সার্জন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ।
অপরদিকে, অক্সিজেন সিলিন্ডার কে আগে নেবে- তা নিয়ে রোগীর স্বজনদের মধ্যে রীতিমতো কাড়াকাড়ি অবস্থা চলছে। সময়মতো অক্সিজেন না পেয়ে রোগী মৃত্যুর অভিযোগও রয়েছে। আর যারা বাসাবাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন, তাদের স্বজনরা ভিড় করছেন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানে।
চিকিৎসকরা বলছেন, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে করোনা পরিস্থিতি যেভাবে ভয়াবহ আকার ধারণ করছে, তাতে অক্সিজেন যেন সোনার হরিণ হয়ে উঠেছে।
ডেডিকেটেড করোনা হাসপাতালে করোনা চিকিৎসারত রিনা খাতুন শ্বাসকষ্ট নিয়ে অক্সিজেন সিলিন্ডারের অপেক্ষায় রয়েছেন দীর্ঘক্ষণ। তার স্বজনরা উৎকণ্ঠায়, কখন অক্সিজেন পাওয়া যাবে।
চিকিৎসারত অপর রোগী মমতাজ বেগমের ব্যবহৃত সিলিন্ডারের অক্সিজেন শেষ হয়ে গেছে। খালি সিলিন্ডার নিয়ে হাসপাতাল গেটে ছেলের অপেক্ষা, নতুন সিলিন্ডারের জন্য।
খুলনার সবচেয়ে বড় ডেডিকেটেড করোনা হাসপাতালে ১৩০ শয্যার বিপরীতে প্রতিদিন রোগী ভর্তি থাকছেন ১৮০ থেকে ১৯০জন । সেখানে মাত্র ৭৭টি শয্যায় দেওয়া যাচ্ছে কেন্দ্রীয় অক্সিজেনের ব্যবস্থা। বাকি রোগীদের পাশাপাশি অতিরিক্ত রোগীদের নির্ভর করতে হচ্ছে সিলিন্ডার অক্সিজেনের জন্য।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ৫০০ সিলিন্ডারের কথা বললেও প্রকৃত অবস্থা বলছে ভিন্ন কথা। জীবন বাঁচানো অক্সিজেন সিলিন্ডার হাসপাতালে এলেই রোগীর স্বজনরা হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন।
জেনারেল হাসপাতালের ৭০ শয্যার করোনা ইউনিটে মাঝে মধ্যে পরিপূর্ণ হয়ে যাওয়ায় সেখানের চিত্রও একই।
খুলনার অক্সিজেন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান স্পেকট্রা কোম্পানির ডিপো ম্যানেজার সজীব রায়হান বলেন, 'খুলনায় বর্তমানে করোনা রোগীদের জন্য অক্সিজেন সিলিন্ডারের চাহিদা প্রায় ৭০০টি। সেখানে সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে মাত্র ৪১০টি।'
তিনি জানান, একটি ছোট সিলিন্ডারে ১ হাজার ৩৬০ লিটার ও বড় সিলিন্ডারে ৬ হাজার ৮০০ লিটার অক্সিজেনের ধারণ ক্ষমতা আছে।
খুলনা মেডিক্যাল কলেজের উপাধ্যক্ষ এবং করোনা প্রতিরোধ ও সমন্বয় কমিটির সদস্য ডা. মেহেদী নেওয়াজ বলেন, 'করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে সংকট আরও বাড়বে।'
খুলনা করোনা হাসপাতালের ফোকালপার্সন ডা. সুহাস রঞ্জন হালদার বলেন, 'হাসপাতালে রোগীর চাপ বেড়েছে, তাই শয্যা বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল। ৩০টি শয্যা বেড়ে এখন ১৩০ শয্যাবিশিষ্ট ডেডিকেটেড করোনা হাসপাতালে পরিণত হয়েছে। তবে এখানে আইসিইউ বেডের সংখ্যা মাত্র ২০টি।'
তিনি জানান, বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা পর্যন্ত ১৩০ বেডের হাসপাতালে ১৯৮ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। এছাড়া ২০টি আইসিইউ বেডও রোগীতে পরিপূর্ণ। একটি বেড খালি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন রোগী সেখানে নেওয়া হয়। 'অনেক সমস্যার মধ্যেও আমরা রোগীদের সর্বোচ্চ চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করছি,' বলেন তিনি।
সিভিল সার্জন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ জানান, খুলনা ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে কোভিড রোগীদের জন্য ৭০টি সাধারণ বেড রয়েছে। এখানে কোনো আইসিইউ নেই।
তিনি বলেন, 'আমরা প্রাথমিক ও মাঝারি পর্যায়ের রোগীদের ভর্তি করে থাকি। কোনো রোগীর খারাপ অবস্থা হলেই সঙ্গে সঙ্গে তাকে খুলনা করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে পাঠিয়ে দিই। '
বেসরকারি গাজী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সত্ত্বাধিকারী ডা. গাজী মিজানুর রহমান বলেন, 'এ হাসপাতালে ৯টি আইসিইউসহ ১০০টি জেনারেল বেড রয়েছে। বৃহস্পতিবার এ হাসপাতালে আইসিইউর ৯টি বেডসহ ৯৩জন রোগী ভর্তি ছিলেন।'
'আমাদের হাসপাতালের প্রধান সমস্যা, অক্সিজেন সংকট। আমাদের যারা অক্সিজেন সাপ্লাই দেয়, তারা সময়মতো তা দিতে পারছে না। কখনো দুপুর ২টার মধ্যে অক্সিজেন দেওয়ার কথা থাকলেও দিচ্ছে দুপুর ৩টার পর। এতে রোগীদের চিকিৎসা দিতে চিকিৎসকরা যেমন সমস্যায় পড়ছেন, সময়মতো অক্সিজেন না পেয়ে রোগীরাও ভোগান্তিতে পড়ছেন,' বলেন তিনি।