জাপানে প্রস্তুত পাঁচ মেট্রো ট্রেন, দেশে আসছে আগামী মাসেই
উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেলের (এমআরটি ৬) আগারগাঁও-মতিঝিল অংশের নির্মাণকাজে ধীরগতি থাকলেও উত্তরা-আগারগাঁও অংশের নির্মাণকাজ এগিয়ে চলছে দ্রুত গতিতে।
ভায়াডাক্টসহ এই অংশের ১১.৭৩ কিলোমিটারের প্রায় পুরোটাই এখন দৃশ্যমান। রেলপথ ও নয়টি স্টেশন নির্মাণসহ আনুষাঙ্গিক কাজে অগ্রগতি প্রায় ৭৬ শতাংশ।
এই পথে চলাচলের জন্য পাঁচটি ট্রেন তৈরির কাজও শেষ হয়েছে জাপানের কারখানায়। এমআরটি-৬ প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রতিটি ট্রেনে ছয়টি করে বগি আছে। জাপানে ট্রেনগুলোর ট্রায়াল রান সম্পন্ন হয়েছে। কোভিড সংক্রমণের কারণে ট্রেনগুলো দেশে আনা যাচ্ছে না।
কোভিডের কারণে বাংলাদেশের প্রকৌশলীরা জাপানে গিয়ে ট্রায়ালে উপস্থিত থেকে ট্রেনগুলো বুঝে নিতে পারছেন না। তারা আশাবাদী, পরিস্থিতির উন্নতি হলে আগামী মাসেই ট্রেনগুলো দেশে নিয়ে আসা হবে।
ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এএনএম সিদ্দিক বলেন, কোভিডের কারণে জাপানে বিদেশিদের প্রবেশ বন্ধ। আগামী ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা থাকবে।
ফেব্রুয়ারিতে নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে প্রকৌশলীরা জাপান সফর করে ট্রেনগুলো বুঝে নেবেন। জাপান সরকার যদি নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ বাড়ায়, তাহলে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় ট্রেনগুলো আনার উদ্যোগ নেয়া হবে।
উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রো রেলে ট্রেন লাগবে মোট ২৪টি। এর বাইরে আরো লাগবে একটি উদ্ধারকারী ট্রেন। এর মধ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোতে লাগবে ৮টি ট্রেন।
২০১৭ সালে সই করা ২৮৭০ কোটি টাকার চুক্তির আওতায় জাপানের জাপানের কাওয়াসাকি-মিতসুবিশি কনসোর্টিয়াম ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে এমআরটি-৬ এর জন্য এই ট্রেনগুলো নির্মাণ কাজ শুরু করে।
মেট্রো ট্রেনের একটি মক আপ গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে উত্তরা ডিপোর মেট্রো রেল এক্সহিবিশন এন্ড ইনফরমেশন সেন্টারে স্থাপন করা হয়। প্রথম পূর্ণাঙ্গ ট্রেনের নির্মাণ গত বছরের এপ্রিলে ও দ্বিতীয়টির নির্মাণ সেপ্টেম্বরে শেষ হয়েছে। ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্মাণ হয়েছে পাঁচটি ট্রেন।
চুক্তি অনুযায়ী, এই রুটের জন্য ২৪টি যাত্রীবাহী ও একটি উদ্ধারকারী ট্রেন আগামি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে সরবরাহ করতে হবে।
ট্রেনের ভেতর-বাহির
মেট্রো ট্রেনের বগিগুলোর বডিতে ব্যবহার করা হয়েছে পুন:ব্যবহারযোগ্য অ্যালুমিনিয়াম অ্যালয়। ট্রেনের কাঁচগুলো থাকবে বুলেটপ্রুফ।
ছয় বগির প্রতিটি ট্রেনের দুই প্রান্তের দুটি বগিতে থাকবে ট্রেলার কন্ট্রোল। ২২ থেকে ২৮ টন ওজনের বগিগুলোর প্রস্থ প্রায় ৩ মিটার, দৈর্ঘ্য ২০ মিটার। বগিগুলোতে লম্বালম্বি আসন পাতা থাকবে।
প্রতিটি ট্রেনে ১৬৯৬ যাত্রী পরিবহন করা যাবে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এ সব কোচের প্রতিটিতে ব্যবহার করা হবে দুটি করে এয়ার কন্ডিশনিং ইউনিট। বগিরগুলোর প্রতি প্রান্তে চারটি করে দরজা থাকবে। ট্রেনে প্রাধান্য থাকবে লাল ও সবুজ রংয়ের।
প্রতি ঘন্টায় সর্বোচ্চ ১০০ কিলোমিটার গতিতে চলবে এসব ট্রেন। সেকেন্ডের ব্যবধানে এগুলোর গতি ঘন্টায় ৩.৫ কিলোমিটার বাড়ানো যাবে। আর স্বাভাবিক অবস্থায় এসব ট্রেনের গতি সেকেন্ডে 3.5 কিলোমিটার হারে এবং জরুরি অবস্থায় সেকেন্ডে ৪.৫ কিলোমিটার হারে কমানো যাবে। ট্রেনে ব্যবহার করা হচ্ছে রিজেনারেটিক বৈদ্যুতিক ব্রেক।
রেডিও কমিউনিকশনের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় ট্রেন পরিচালনা
চালক ছাড়াই রেডিও কমিউনিকেশনের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় পদ্মতিতে ট্রেনগুলোর পরিচালনা করা হবে। এ জন্য ব্যবহার করা হবে এসআইএলফোর নামে রেট্রোফিট অটোমেটিক ট্রেন অপারেটিং সিস্টেম।
প্রকল্প কর্মকর্তারা জানান, এমআরটি-৬ সম্পূর্ণ চালু হলে ট্রেন পরিচালনায় ১৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন হবে। মতিঝিল আরএসএস থেকে ডিপিডিসি এবং উত্তরা আরএসএস থেকে ডেসকো বিদ্যুত সরবরাহ করবে।
বিদ্যুতের কোন সাব-স্টেশন বিকল হলে ট্রেন পরিচালনা অব্যাহত রাখতে ব্যবহার করা হবে রিং সার্কিট ট্রপোলজি প্রযুক্তি। এর পরেও সম্ভাব্য বৈদুতিক সমস্যা সমাধানে ট্রেনগুলোতে থাকবে ব্যাকআপ পাওয়ার সোর্স।
ট্রেন পরিচালনায় রেডিওভিত্তিক যোগাযোগের জন্য লং-টার্ম ইভ্যালুয়েশন (এলটিই) প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। সিগন্যালিং সিস্টেম পরিচালনা করতে জাপানের নিপ্পন সিগন্যাল কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে।
টেলি কমিউনিকেশন সিস্টেম পরিচালণা করবে নোকিয়া। মেট্রোর পুরো স্থাপনা জুড়ে থাকবে অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক। কোনো কারণে টেলিকমিউনিকেশন ব্যবস্থা বিকল হয়ে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে উদ্ধারকারী ট্রেনকে কাজে লাগানো হবে। পুরো ব্যবস্থা সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে মনিটর করা হবে।
৬ বগির প্রতিটি ট্রেনের একটি বগি সংরক্ষিত থাকবে নারীদের জন্য। বাকি বগিগুলোতেও নারীরা ভ্রমণ করতে পারবেন। গর্ভবতী নারী ও প্রবীণদের জন্য প্রতি বগিতে থাকবে সংরক্ষিত আসন। প্রতিবন্ধীদের জন্য বগির ফ্লোর এবং প্ল্যাটফর্মের মধ্যে উচ্চতার সমতা রাখা হবে।
দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য ট্রেনে থাকবে অডিও ইনফরমেশন সিস্টেম। আর শ্রবন প্রতিবন্ধীদের জন্য থাকবে ভিজ্যুয়াল ডিসপ্লে।
বাঁচবে সময়, কমবে কার্বন নি:সরণ
উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার রাস্তা মাত্র ৪০ মিনিটে পাড়ি দেবে মেট্রো রেল। এতে যাত্রীদের সময় বাঁচবে প্রায় দুই ঘন্টা। প্রতি ঘন্টায় যাত্রী পরিবহন করা যাবে ৬০ হাজার। পরিবেশবান্ধব মেট্রোরেল প্রতি বছর ১,৭৩,৩১২ টন কার্বনডাইঅক্সাইডের নি:সরণ কমাবে।
উত্তরা থেকে পল্লবী, মিরপুর ১০, ফার্মগেট, দোয়েল চত্ত্বর, প্রেসক্লাব হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত ২০.১০ কিলোমিটার মেট্রো রেল নির্মাণে প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয় ২০১২ সালে।
২০২৪ সালের মধ্যে কাজ শেষ করতে এ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ২১,৯৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাপানের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ঋণ হিসেবে দেবে ১৬,৫৯৫ কোটি টাকা। ডিসেম্বর পর্যন্ত বরাদ্দের ৫৫.১৯ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছে।
সম্প্রতি এমআরটি-৬ কমলাপুর পর্যন্ত সম্প্রসারণের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এতে এই প্রকল্পে দৈর্ঘ্য বাড়বে আরো ১.১৬ কিলোমিটার।
২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকা মহানগরী ও এর আশেপাশে ডিএমটিসিএলের অধীনে ছয়টি মেট্রোরেল নির্মাণ করতে চায় সরকার। সবগুলো লাইনের মোট দৈর্ঘ্য হবে ১২৮.৭৪ কিলোমিটার।
এর মধ্যে ৬৭.৫৭ কিলোমিটার হবে মাটির উপরে এবং ৬১.১৭ কিলোমিটার মাটির নীচে। মাটির উপরে হবে ৫১ ও নীচে ৫৩টি স্টেশন।
মোংলা হয়ে ট্রেনগুলো ঢাকায় আসবে নৌপথে
জাপান থেকে সমুদ্রপথে ট্রেনগুলো বাংলাদেশে আসবে মোংলা বন্দর হয়ে। মোংলা থেকে সেগুলো ঢাকায় আনা হবে নদীপথে। প্রকল্প কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিশাল ওজনের এ সব ট্রেন এক্সেল লোড সংক্রান্ত জটিলতায় সড়ক পথে ঢাকায় আনা সম্ভব নয়।
চুক্তি অনুযায়ী ট্রেনগুলো ঢাকা পর্যন্ত পৌছানোর দায়িত্ব নির্মাতা প্রতিষ্ঠান কাওয়াসাকি-মিতসুবিশি কনসোর্টিয়ামের। মেট্রো ট্রেন খালাস করতে ইতোমধ্যেই ঢাকার আশুলিয়ায় একটি অস্থায়ী জেটি নির্মাণ করা হয়েছে।