বগুড়ার ৬৪ চরে সাড়ে ৮০০ কোটি টাকার ফসল, স্বপ্ন দেখাচ্ছে সোনালী আঁশ
কৃষি দপ্তরের মতে নদীতে বন্যা 'বড়' হলে চরে আবাদ ভালো হয়। বড় বন্যায় জমিতে পলি পড়ায় শক্তি বাড়ে। কৃষি বিভাগের এই কথার সামঞ্জস্যতাও পাওয়া গেছে। এবার বগুড়ার সারিয়াকান্দি ও ধুনট উপজেলায় যমুনা নদীর বুকে ৬৪ চরে অন্তত সাড়ে ৮০০ কোটি টাকার ফসল উৎপাদন হয়েছে। সম্ভাবনার এই দুয়ার আরও সমৃদ্ধ করতে সোনালী আঁশ পাট মাঠে হাসি ছড়াচ্ছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, চলতি বছর সারিয়াকান্দি উপজেলায় ৩ হাজার ৭০৫ হেক্টর জমিতে ২০ হাজার ৫৪২ মেট্রিক টন মরিচ চাষ করা হয়েছে।
উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২০ হাজার ৫৪২ মেট্রিক টন। অর্থাৎ ৫ লাখ ১৫ হাজার ১৪৯ দশমিক ৪৫ মণ। একই সময়ে ধুনট উপজেলায় মরিচ চাষ করা হয়েছে ১৫ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন হয়েছে ৯০০ মনের বেশি। এবার গড়ে বগুড়ায় শুকনো মরিচ বিক্রি হয়েছে ৬ হাজার টাকা মণ। এ হিসেবে জেলায় এবার ৩০৯ কোটি ৮ লাখ ৯৬ হাজার ৭০০ টাকার মরিচ উৎপাদিত হয়েছে।
সারিয়াকান্দিতে ৮৪০ হেক্টরে ১ হাজার ৮ টন আর ধুনটে ২৪ টন মসুর ডাল। অর্থাৎ মোট ৪৫ হাজার ৬০০ মণ মসুর ডাল উৎপাদিত হয়েছে। গড়ে ৩ হাজার মণ হলে এর বাজারমূল্য দাঁড়ায় ১৩ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।
এক হাজার ১০৫ টন খেসারি উৎপাদনে ৮৫০ হেক্টর লেগেছে সারিয়াকান্দিতে। ধুনটে ২০ হেক্টরে উৎপাদন হয়েছে ২৪ টন। দুই উপজেলায় উৎপাদন হয়েছে মোট ২৮ হাজার ৩০০ মণ। কৃষি দপ্তর ও কৃষকরা বলছেন, বগুড়ার দুই উপজেলায় উৎপাদিত খেসারি ডালের বাজার দাম ৭ কোটি ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকার উপরে। প্রতি মণ ২৫০০ টাকায় এবার খেসারি ডাল বিক্রি হয়েছে।
চরের জমি উর্বরতার শক্তি দেখিয়েছে ধান উৎপাদনের ক্ষেত্রে। সারিয়াকান্দিতে ১১ হাজার ৬৭০ হেক্টর আর ধুনটে ১১০ হেক্টরে বোরো ধান হয়েছে। এখানে ধান থেকে চাল উৎপাদন হয়েছে ৭ লাখ ৭৫ হাজার ৬২৫ মণের উপরে। বাজারমূল্য গড়ে ২ হাজার ৪০০০ টাকা মণ ধরে দুই উপজেলায় ১৬৮ কোটি ১৫ লাখ টাকার চাল উৎপাদন হয়েছে।
চরে পেঁয়াজ উৎপাদনেও চাষিরা ভালো সাফল্য দেখিয়েছেন। সারিয়াকান্দিতে ১ হাজার ৭৫০ হেক্টর জমিতে ২২ হাজার ১৬৬ টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে। অর্থাৎ ৩ লাখ ৪ হাজার ১৫০ মণ পেঁয়াজ হয়েছে। গড়ে ১ হাজার ২০০ টাকা প্রতি মণ হিসাবে ৩৬ কোটি ৪৯ লাখ ৮০ হাজার টাকার পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়েছে।
অন্য ফসলের তুলনায় চরে চীনাবাদামের অর্জনও কম নয়। এবার সারিয়াকান্দিতে ৬১০ হেক্টরে ৯১৫ টন আর ধুনটে ৬০ হেক্টরে ১০৮ টন চিনাবাদাম হয়েছে। মণের হিসাবের এর পরিমাণ ১৩ লাখ ২ হাজার ৭০০। প্রতি মণ ২ হাজার টাকায় বিক্রি হয়ে ২৬০ কোটি ৫৪ লাখ টাকা আয় হয়েছে।
সারিয়াকান্দিতে ৭২০ হেক্টরে ১০ হাজার ৯৮০ টন মিষ্টি আলু উৎপাদিত হয়েছে। কৃষি দপ্তর এর বাজারমূল্য ৩০ কোটি ৪২ লাখ টাকার ধরেছে। এছাড়া সারিয়াকান্দিতে ৮৫০ হেক্টরে ১ হাজার ১০৫ টন খেসারি, ৩০ হেক্টরে ৩২ টন তিল, ৫০ হেক্টরে ৫২ টন খেরাছী (চিনা), ৫ হেক্টরে ৭৫ টন কেসুর আলু, এবং ৭০৫ হেক্টরে ৬ হাজার ৩৮২ টন শাকসবজি উৎপন্ন হয়েছে। ধুনটে ৯০ হেক্টর জমিতে ১ লাখ ৩৬ হাজার টাকার ভুট্টা উৎপাদন হয়েছে। ৩০ হেক্টর জমিতে আখ চাষে ৫২ লাখ ৫৮ হাজার ৪০০ টাকা আয় করেছেন কৃষকরা। উপজেলায় একমাত্র ভান্ডারবাড়ি এই চরে ৫ হেক্টর জমিতে ৭ দশমিক ৫ টন ছোলা উৎপাদন হয়েছে।
সারিয়াকান্দিতে আমন মৌসুমে ৩ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে স্থানীয় জাতের গাইনজা ধান প্রায় ৫ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন এবং স্থানীয় কালো জাতের বোরো ধান ৬৫০ হেক্টর জমিতে ৯৭৫ মেট্রিক টন উৎপন্ন হয়।
এই উৎপাদনের সাথে এবার নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে পাটচাষের ক্ষেত্রে। জেলায় ১২ হাজার ১৪০ হেক্টর জমিতে পাটচাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। দাম ভালো পাওয়ায় হাসি ফুটেছে কৃষকের মুখেও। তবে সব দিক বিবেচনায় এবার চরের মানুষের কৃষি নির্ভরতার ব্যাপক সাফল্য দেখা গেছে। এবার চাষাবাদে অধিকাংশ কৃষকই লাভবান হয়েছেন।
সারিয়াকান্দির দক্ষিণ শংকরপুর, পূর্ব ধারাবর্ষা, পশ্চিম ধারাবর্ষা, কেষ্টিয়ারচর, কোমরপুর, চানবাড়ী, মাঝবাড়ি, কালাইহাটা, পৌতিবাড়ী, চর মাঝিরা, হাতিয়া বাড়ি, কালিয়ান, আগ বোহাইল, নিজ বোহাইল, আওলাকান্দি, ভাংগারছেও উত্তর বেণীপুর, দক্ষিণ বেণীপুর, মিঠনেরপাড়া, কাজলা, বাওইটোনা, কুড়িপাড়া, পাকেরদহ, উত্তর টেংরাকুড়া, দক্ষিণ টেংরাকুড়া, পাকুড়িয়া, ময়ূরেরচর, ট্যাকামাগুড়া, চর ঘাগুয়া, জামথল, বেড়াপাঁচবাড়ীয়া ফাজিলপুর, বহুলাডাঙ্গা, চালুয়াবাড়ী, আওচারপাড়া, সুজালিরপাড়া, শিমুলতাইড়, তেলিগাড়ী, কাকালীহাতা, হরিরামপুর, ভাংগরগাছা, ধারাবরির্ষা, বিরামেরপাঁচগাছি, হাটবাড়ী, দলিকা, মানিকদাইড়, কর্ণিবাড়ী, শনপচা, মুলবাড়ী, নান্দিনাচর, ডাকাতমারা, তালতলা, মিলনপুর, শালুখা, চর বাটিয়া, গজারিয়া, দারনা, হাটশেরপুর, ধনারপাড়া, শিমুলবাড়ী, চকরতিনাথ, করমজাপাড়া, নয়াপাড়া, কর্ণিবাড়ী, ধরবন্ধ, দিঘাপাড়া, ক্ষেপির পাড়াসহ ৬৩টি চরে ফসল ভালো উৎপাদন হয়। আর ধুনট উপজেলায় মাত্র ভান্ডারবাড়ির সাড়ে ৩০০ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়।
সারিয়াকান্দি উপজেলার কাজলা ইউনিয়নের জামথল এলাকার চাষি মোকলেছুর রহমান আড়াই বিঘা জমিতে এবার মরিচ চাষ করেছিলেন। তিনি দেড় বিঘা জমি থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা আয় করেছেন। অন্য এক বিঘা থেকে ৮০ হাজার টাকা বিক্রি করেছেন। ওই জমিতে এবার পাট চাষ করেছেন। সেখানেও লাভবান হবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন মোকলেছুর রহমান।
বর্তমানে প্রতি মণ পাট দুই হাজার টাকা আর শুকনো মরিচ সাড়ে ৬ হাজার টাকা মণ বিক্রি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সারিয়াকান্দি বাজারের ব্যবসায়ী আব্দুর রশিদ। বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ধান ১ হাজার ২০০, খেসারি কলাই ১ হাজার ৪০০, মসুর ডাল ২ হাজার ৫০০, চিনাবাদাম ২ হাজার ২০০ আর পেঁয়াজ ১ হাজার ৩০০ টাকা মণ বিক্রি হচ্ছে।
সারিয়াকান্দির কাজলা ইউনিয়নের বাঘোপাড়া চরের চাষী বাদশা মিয়া এবার ২ বিঘা জমিতে দেশি জাতের মরিচ চাষ করেছিলেন। এক বিঘায় ২৫ হাজার টাকা খরচ করে ৭০ হাজার টাকার মরিচ বিক্রি করেছেন। অন্য দুই বিঘায় খেসারী চাষে ১০ হাজার টাকা খরচ করে ৩০ হাজার টাকা বিক্রি করেন। বাদশা বলেন, এবার বড় বন্যা আর ফসলের দাম থাকায় সবকিছু চাষ করে লাভবান হয়েছেন কৃষকেরা।
তবে একটু ভিন্ন কথা শোনালেন সারিয়াকান্দির চালুয়াবাড়ি ইউনিয়নের বিরামের পাঁচগাছি চরের বাসিন্দা রিপন সরকার। তিনি ৭ বিঘা জমিতে হাইব্রিড জাতের মরিচ চাষ করে লোকসানে পড়েছেন। বীজের চারা না গজানোয় ২০ বিঘা জমিতে পেঁয়াজ চাষে লাখ দুয়েক টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে জানান রিপন। কিন্তু পাটে এবার ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন এই কৃষক। বলেন, "এবার ১৩ বিঘা জমিতে পাট চাষ করা হয়েছে। আশা করছি ভালো ফলন হবে। দামও বেশি। এতে পেঁয়াজ ও মরিচ চাষের লোকসান পুষিয়ে যাবে"।
উপজেলার কর্ণিবাড়ী ইউনিয়নের ইন্দুরমারা চরের রিপন মিয়া বলেন, "এবারের ফসল দেখে সবাই খুশি। দামও ভালো। এতে অভাব ঘুচে যাবে অনেকের"।
সারিয়াকান্দি উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল হালিম জানান, সাধারণত বড় বন্যার পর চরের মাটিতে পলি পড়ে। এতে মাটির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি পায়। এ কারণে সারিয়াকান্দির চরে এবার ব্যাপক পরিমাণ ফসল উৎপাদন হয়েছে। এবার সারিয়াকান্দির ৬৩ চরে এক হাজার কোটি টাকার ফসল উৎপাদন হয়েছে। পাটচাষে কৃষক আরও প্রায় ১০০ কোটি কোটি আয় করবে।
ধুনট উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা মুহাম্মদ মুশিদুল ইসলাম বলেন, "ধুনট উপজেলায় একমাত্র ভান্ডারবাড়ি চরে কৃষি আবাদ হয়। একসময় এখানে সাড়ে ৫০০ হেক্টরে আবাদ হতো। কিন্তু এই চর নদী ভাঙনের কবলে পড়ে ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে। এবার এতে সাড়ে ৩০০ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে। নদী ভাঙন এলাকার মানুষেরা বন্যার কয়েক মাস কষ্টে থাকেন। কিন্তু পানি নেমে গেলে নানা ধরনের ফসল চাষে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠেন"।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. দুলাল হোসেন বলেন, "গত বছর পাটের খুব ভালো দাম পেয়েছেন কৃষকেরা। এই কারণে অন্য ফসলের মতো পাটচাষের দিকেও চাষিরা বেশি ঝুঁকেছেন। বিশেষ করে চরের চাষিরা পাটচাষে এগিয়ে রয়েছেন"।