বিদেশে নারীর কর্মসংস্থান: থামছে না নিপীড়ন, বাড়ছে মৃত্যু ও পাচার
প্রবাসে কাজের হাতছানিতে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও দলে দলে বিদেশ যাচ্ছেন । একই সঙ্গে বাড়ছে নিপীড়ন, বিদেশে মৃত্যু এবং পাচারের মতো ঘটনাও।
সরকারি-বেসরকারি পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, গত কয়েক বছরে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন কিংবা প্রতারণার শিকার হয়ে শূন্য হাতে দেশে ফেরত আসতে বাধ্য হয়েছেন অনেক নারী।
নির্যাতনের মাত্রা এত বেশি যে, মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে দেশে ফিরছেন অনেকে। বিদেশে মৃত্যুর হার ক্রমান্বয়ে উর্ধ্বমুখী।
আবার নারীদের বিদেশে পাঠানোর নামে সিরিয়া কিংবা দুবাইতে বিক্রি করে দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। থেমে নেই ভারতে পাচারের ঘটনাও।
এ পর্যন্ত চাকুরী শেষ করে বা প্রতারণা ও নির্যাতনের শিকার হয়ে কতজন নারী শ্রমিক দেশে ফেরত এসেছে তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই। তবে বিভিন্ন দূতাবাস ও গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত গত চার বছরে সৌদি আরব থেকে ১৩ হাজারেরও বেশি নারী দেশে ফিরে এসেছেন।
আর বিমানবন্দর প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের তথ্য অনুযায়ী, করোনাকালীন সময়ে ফেরত আসা চার লাখ প্রবাসীর মধ্যে ৪৯ হাজার ৯২৪ জনই নারী।
গত ৮ জানুয়ারি সৌদি আরবের জেদ্দা থেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে দেশে ফিরেছেন আসিয়া (ছদ্দনাম) নামের নারী গৃহকর্মী। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমানটি অবতরণ করার পর থেকে বিমানবন্দরের ভিতর আসিয়া বেগমের উদ্দেশ্যহীন এবং নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চলাফেরার করার বিষয়টি এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ কর্তৃপক্ষের নজরে আসলে কর্তৃপক্ষ তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন থাকায় তার কাছ থেকে কোন সদুত্তর না পেয়ে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের সাথে যোগাযোগ করে এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়। এরপর সকাল সাড়ে ৭টায় বিমানবন্দর এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ আসিয়াকে হস্তান্তর করে ব্র্যাকের সেইফ হোমে।
ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচি বলছে, গত পাঁচ বছরে ৪৮৭ জন নারীর মরদেহ কফিনবন্দী হয়ে দেশে ফিরেছে। এর মধ্যে সৌদি আরবেই মারা গেছেন ২০০ জন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মৃত্যু সনদে উল্লেখ আছে আত্মহত্যা। এ ধরণের হত্যাকান্ডের ক্ষেত্রে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রথমবারের মতো দোষীদের দণ্ড দিয়েছে সৌদি ক্রিমিনাল কোর্ট।
২০১৭ সালের জুলাই মাসে সৌদি আরবে নির্যাতনে মারা যাওয়া আবিরুন বেগমের হত্যা মামলায় প্রধান আসামী সৌদি নাগরিক গৃহকর্ত্রী আয়েশা আল জিজানীকে কেসাস (জানের বদলে জান) এর রায় প্রদান করেছেন আদালত।
দেশে ফেরা নারীদের মরদেহের উপর অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, আত্মহত্যায় মৃত্যু হয়েছে ৮৬ জনের, ষ্ট্রোকে ১৬৭ জন, দুর্ঘটনায় নিহত ৭১ জন, স্বাভাবিক মৃত্যু ১১৫, খুন হয়েছেন ২ জন এবং অন্যান্য কারণে মারা গেছেন ৪৬ জন।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপারসন তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, "যেকোনো ধরনের নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনায় মামলা করার ক্ষেত্রে আমাদের দেশ পিছিয়ে আছে। এ কারণে ভিকটিম বিচার পায় না। তাই আবিরুনের ঘটনার মতো আমাদের সংশ্লিষ্ট দেশে মামলা করতে হবে। কারণ আদালত মোটামুটি স্বাধীনভাবেই কাজ করে"।
এছাড়া তিনি নারীকর্মীদের বিশেষ প্রশিক্ষণের উপর গুরুত্বারোপ করেন।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) এর তথ্যমতে, ১৯৯১ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৯ লাখ ২৪ হাজার ৪১৫ নারী কাজের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছেন। যেখানে শুধুমাত্র ২০১৯ সালে ১ লাখ ৪ হাজার ৭৮৬ নারী কাজের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছেন, সেখানে ২০২০ সালে করোনাকালীন সময়ে তা দাঁড়িয়েছে মাত্র ২১ হাজার ৯৩৪ জনে।
মূলত ২০১৫ সালে সৌদি আরবে নারী কর্মী পাঠানোর সমঝোতা স্বাক্ষর করার পর থেকেই বিপুল সংখ্যক নারী বিদেশে যাওয়া শুরু করেন। গত পাঁচ বছরে সৌদি আরবে গেছেন ৩ লাখ ৫৩ হাজার ৭৫৫ জন নারী, যা মোট নারী অভিবাসনের ৩৮.২৭%।
ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, "'নারী অভিবাসন নীতিমালা' যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। নারী অভিবাসনের ক্ষেত্রে প্রতিটি কর্মীকে পরিবারের সাথে যোগাযোগ জন্য সেদেশে পৌছার পূর্বে সেদেশের সিমকার্ড প্রদান করা প্রয়োজন"।
তিনি আরও বলেন, "নারী কর্মী প্রেরণকারী রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে যথাযথ মনিটরিং করাসহ অভিযুক্ত রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনা প্রয়োজন। মানব পাচার আইনের অধীনে দায়েরকৃত মামলাগুলো দ্রুত নিস্পত্তি করে পাচারকারীদের আইনের আওতায় আনতে হবে যাতে এমন অপরাধ আর কেউ না করে"।
বয়স বেশি দেখিয়ে বিদেশে পাঠানো হচ্ছে
বিদেশে নারী কর্মী পাঠানোর জন্য বয়স ২৫ নির্ধারণ করা হলেও ১৩-১৪ বছরের অনেক কিশোরীকেও বয়স বেশি দেখিয়ে সৌদি আরবে পাঠানো হচ্ছে। এর মধ্যে সম্প্রতি ১৩ বছরের এক কিশোরী নদীর লাশ পাওয়া যায় সৌদি আরবে। ডেথ সার্টিফিকেটে আত্মহত্যা বলা হলেও পরিবারের দাবি এটি হত্যা।
জন্ম সনদ অনুযায়ী, নদী আক্তারের বয়স ১৩। কুমিল্লায় বাড়ি হলেও রিক্রুটিং এজেন্সি ২৫ দেখিয়ে ময়মনসিংহ থেকে পাসপোর্ট করেন। সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাস বলছেন, গত ১৪ই আগষ্ট মদিনায় গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছেন নদী কিন্তু পরিবারের দাবি হত্যা করা হয়েছে নদীকে। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে সৌদি যাওয়ার পর থেকেই নিয়োগকর্তা কর্তৃক নির্মম নির্যাতনের শিকার হতে হয় নদীকে। এমনকি বেতনও দেওয়া হতো না নদীকে। এসব বিষয় নিয়ে একাধিকবার নদীর বাবা দুলাল মিয়া রিক্রুটিং এজেন্সি ঢাকা এক্সপোর্ট (আর এল-২৬৫) এর মালিক এ রহমান লালনের সাথে যোগাযোগ করেও কোন প্রতিকার পাননি।
অভিবাসনের সাথে বাড়ছে নারী পাচারের সংখ্যা
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ থেকে ২০২০ পর্যন্ত মানবপাচারের যতগুলো মামলা হয়েছে তাতে অন্তত এক হাজার ৭৯১ জন নারী মানব পাচারের শিকার।
মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বাংলাদেশ থেকে যত পাচারের ঘটনা ঘটে তার মধ্যে ২১ শতাংশই নারী। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, শুধুমাত্র ২০২০ সালে অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রমকালে উদ্ধারকৃত নারীর সংখ্যা ৩০৩ জন। পাচারের শিকার নারীদের মধ্যে গত ৮ ফেব্রুয়ারি সিরিয়া থেকে দেশে ফিরেছেন মানব পাচারের শিকার ৪ নারী। এদিকে দুবাইতে বিভিন্ন ডান্সক্লাবে কাজের কথা বলে নারী পাচারের ঘটনাও ঘটছে।