শাহ আবদুল করিমের শিষ্যের ঘর ভষ্মিভুত, যন্ত্রপাতি পুড়ে ছাই
বাউল সম্রাট শাহ্ আব্দুল করিমের শিষ্য বাউল রণেশ ঠাকুরের সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার উজান ধলের বাড়ির বাউলগানের আসর ঘর দুর্বৃত্তদের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ঘরে থাকা তার ও তার নিজের শীষ্যদের বাদ্যযন্ত্র, গীতিগ্রন্থসহ প্রায় ৪০ বছরের সংগৃহীত বাউল গানের মূল্যবান উপকরণও ভষ্মীভূত হয়েছে। এ ঘটনায় মুষড়ে পড়েছেন শিল্পী।
এদিকে, সহজ সরল ও নির্বিরোধ জীবনের অধিকারী বাউল রণেশ ঠাকুরের গানের ঘর পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সংস্কৃতিকর্মীরা। তারা অবিলম্বে দুষ্কৃতিকারীদের খুজে বের করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। রোববার রাতে দুষ্কৃতিকারীরা আগুনে পুড়িয়ে দেয় রণেশ ঠাকুরের গানের ঘর।
বাউল রণেশ ঠাকুর ও তার পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের বাড়ি বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের বাড়ির পাশেই অবস্থিত। মৌলবাদীরা যখন গানের শুরুতে শাহ আবদুল করিমের বিরুদ্ধে ছিল তখন বাউল রণেশ ঠাকুরের পিতা হাওরাঞ্চলের বিখ্যাত কীর্তনীয়া ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব রবনী মোহন চক্রবর্তী তাকে নানাভাবে মানসিক সহযোগিতা দেন। রণেশ ঠাকুরের ভাই প্রয়াত রুহী ঠাকুর ছিলেন বাউল সম্রাটের প্রধান শিষ্য। তাদের দুই ভাইয়ের গুরু ছিলেন শাহ্ আব্দুল করিম। রণেশ ঠাকুর ও রুহী ঠাকুর শাহ আবদুল করিমকে গুরুভাই ডাকতেন। এই দুই পরিবারে এখনো আজন্মের বন্ধন বিদ্যমান। বর্তমানে জীবিতদের মধ্যে বাউল স¤্রাট শাহ আবদুল করিমের অন্যতম প্রধান শিষ্য তিনি।
জানা গেছে, বাউল সম্রাট শাহ্ আবদুল করিমের বাড়ির পাশের রণেশ ঠাকুরের বাড়িতে গানের ঘরে করোনার আগে প্রতিদিনই বাউল আসর বসতো। বাউলের বসতঘরের উল্টোদিকেই রণেশ ঠাকুরের গানের ঘর। রোববার রাত ১ টার পর রণেশ ঠাকুরের বড় ভাইয়ের স্ত্রী আগুন দেখে সকলকে চিৎকার করে ডাকতে থাকেন। অন্যরা ঘুম থেকে ওঠে দেখেন আসর ঘর পুড়ে যাচ্ছে।
এসময় বাউল সম্রাটের ছেলে বাউল শাহ নূরজালাল, ভাগ্নে বাউল শাহ আবদুল তোয়াহেদসহ তাদের আত্মীয়-স্বজনরা ছুটে যান। তারা আগুন নেভানোর চেষ্টা করলেও পুরো ঘর ছাই হয়ে যায়। এই ঘরে বাউল রণেশ ঠাকুরের বাদ্যযন্ত্র, গানের বইসহ বাউল গানের মূল্যবান উপকরণ ছিল। এই ঘরের পাশেই তার ভেড়াও থাকতো। তবে আগুনের তাপে ভেড়াগুলো বেরিয়ে আসে। ভেতরের জিনিষপত্র পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এ ঘটনার পর মুষড়ে পড়েছেন তিনি। মন খারাপ করে ভষ্মিভুত ঘরে বসে আছেন। তবে কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে জানেন না তিনি। আগুনে তার ঢোল, ছইট্টা, দোতরা, বেহালা, হারমুনিয়ামসহ নানা যন্ত্র পুড়ে গেছে। কয়েক যুগে এসব যন্ত্র সংগ্রহ করেছিলেন তিনি।
শাহ্ আব্দুল করিমের ছেলে বাউল শাহ নূর জালাল বলেন, রাত প্রায় দেড় টায় চিৎকার শুনে তিনি এগিয়ে গিয়ে দেখেন বাউল রণেশ ঠাকুরের আসর ঘরে দাউ দাউ করে আগুন জ¦লছে। রণেশ ঠাকুর কান্নাকাটি করছেন। আমাদের বাড়ির সবাই ছুটে গিয়েছিলাম। সকলের চেষ্টায় আগুন নেভালেও রণেশ ঠাকুরের প্রায় চল্লিশ বছরের সাধনার সকল যন্ত্রপাতি, গানের বই-পত্র পুড়ে ছাই হয়েছে। তিনি এ ঘটনার পরম ন খারাপ করে বসে আছেন।
এ ঘটনার খবর পেয়ে সোমবার বিকেলে দিরাই থানা পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। তারা বিষয়টি তদন্ত করছেন বলে জানিয়েছেন দিরাই থানার এসআই জহিরুল ইসলাম।
বাউল রণেশ ঠাকুরের গানেরঘর পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় ক্ষুব্দ হয়ে ওঠেছেন সুনামগঞ্জের সংস্কৃতিকর্মীরা। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ঘটনায় ক্ষোভ ও নিন্দা জানিয়ে দোষীদের খুজে বের করার আহ্বান জানিয়েছেন। দেশ বিদেশেরর বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত বাউল রশেণ ঠাকুরের ভক্তরাও প্রতিবাদ করেছেন।
সুনামগঞ্জ শিল্পকলা একাডেমির কার্যনির্বাহী সদস্য বিজন সেনরায় বলেন, বাউল রণেশ ঠাকুর সুনামগঞ্জ জেলার বিখ্যাত প্রকৃত একজন বাউল। তিনি বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের অন্যতম প্রধান শিষ্য। নিবিবাদী বাউল তিনি। যারা তার গানের ঘর ও মুল্যবান জিনিষপত্র পুড়িয়ে দিয়েছে তাদের বিচার চাই।
দিরাই থানার এসআই জহিরুল ইসলাম বলেন, আমি সরেজমিন গিয়ে দেখেছি বাউলের যন্ত্রপাতি সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তবে রণেশ ঠাকুরকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম তিনি কাউকে সন্দেহ করেন কি না। তিনি সন্তেহপ্রবণ কারো নাম বলতে পারেননি। তবে আমাদের ধারণা আশপাশের কেউ এই ঘটনাটি ঘটিয়েছে। আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব।
বাউল রণেশ ঠাকুরের প্রায় সহস্রাধিক বাউল গান রয়েছে। তিনি গান বাঁধেন এবং নিজে সুরও করেন। বিভিন্ন আসরে তার ভরাট গলায় ভক্তরা মজে থাকেন।