সীমান্তবর্তী সাত জেলায় লকডাউন দিতে দেরি হলে সংকট বাড়বে বলে শঙ্কা বিশেষজ্ঞদের
সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ছে। সংক্রমণের চেইন ভাঙ্গতে ঝুঁকিপূর্ণ সাত জেলায় লকডাউনের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। জেলাওয়ারী বা গুচ্ছ লকডাউন দিতে দেরি হলে ভাইরাসের ভারতীয় ধরনগুলো সাড়াদেশে ছড়িয়ে পড়লে, তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে বলেও আশঙ্কা তাদের।
এই সাত জেলা হলো; নওগাঁ, নাটোর, সাতক্ষীরা, যশোর, রাজশাহী, কুষ্টিয়া এবং খুলনা।
এদিকে সোমবারও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এসব জেলায় লকডাউন জারির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়নি, তবে এর সচিব বলেছেন, এসব জেলার স্থানীয় প্রশাসনকে পরিস্থিতি অনুসারে জনগণের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করার নিজস্ব নিয়মকানুন জারির ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
মে মাস জুড়ে সংক্রমণ সংখ্যা বাড়ায় বাড়িপ্রতি লকডাউন আরোপ করা শুরু করেছে নোয়াখালী জেলা প্রশাসন। জেলার সিভিল সার্জন একথা জানান।
সরকার গঠিত গণস্বাস্থ্য উপদেষ্টা গ্রুপের সদস্য এবং বায়োমেডিক্যাল বিজ্ঞানী অধ্যাপক লিয়াকত আলী- দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমাদের দেশে সারাদেশে লকডাউন কখনো ফলপ্রসূ হয়নি, তাই সারাদেশকে অচল না করে শুধু হটস্পটগুলোতে গুচ্ছ-ভিত্তিতে লকডাউন দিতে হবে। সীমান্তবর্তী আট জেলাকে যদি সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায়, তাহলে সংক্রমণ সারাদেশে ছড়াবে না। গুচ্ছ লকডাউন পালন করা সহজ, এক্ষেত্রে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে বেশি মনোযোগ দেয়া যায়।"
অধ্যাপক লিয়াকত আলী বলেন, লকডাউন দিয়ে জেলাগুলোতে টেস্টের পরিধি বাড়াতে হবে, বিশেষ করে অ্যান্টিজেন টেস্ট বেশি করতে হবে। লকডাউনে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে, যাতে সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে। তাহলেই লকডাউনের সুফল পাওয়া যাবে। লকডাউনে চাপাইনবাবগঞ্চের পজেটিভিটি রেট ৬২% থেকে ৩৪% নেমে এসেছে।
তিনি আরও বলেন, সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে লকডাউন দিলে দ্রুত দিতে হবে। দেরি করলে লাভ হবে না। চাপাইনবাবগঞ্জে ভারতীয় ধরনের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়েছে। লকডাউন দিতে দেরি করলে ওই ধরনটি সাড়াদেশে ছড়িয়ে পড়ে আবার সংক্রমণ বাড়বে।
সীমান্তবর্তী সাত জেলায় লকডাউনের কঠোর বিধিনিষেধ জারি করতে দেরি হলে সঙ্কট বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
সোমবার মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে।
"মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এটা পর্যালাচনা করছে। আম চাষীদের অবস্থা বিবেচনা করে হয়ত দেরি করছে। আমরা চাই দ্রুত লকডাউন দেওয়া হোক প্রস্তাবিত জেলাগুলোয়।"
মন্ত্রী বলেন, লকডাউনের সিদ্ধান্ত কেবিনেট ডিভিশন নেয়। কিন্তু আমাদের পরামর্শ হচ্ছে, যেসব জেলায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী, সেখানে লকডাউন দিয়ে দেওয়া। কারণ এটা যেন সারাদেশে ছড়িয়ে না পরে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ জেলাগুলোতে 'লকডাউন' দিতে দেরি করলে ঝুঁকি থেকেই যাবে। তবে এখন যেহেতু রাজশাহীসহ দেশের উত্তরাঞ্চলে আম ও লিচুর মৌসুম চলছে, সে কারণে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
"সেখানে তিন চার হাজার কোটি টাকার ফল বেচাকেনা হয়। কঠোর লকডাউন দিলে চাষিরা সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ দিকটাও তারা (মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ) মাথায় রেখে কাজ করছেন।"
তবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, সাত জেলায় লকডাউনের সুপারিশ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব ও জনস্বাস্থ্য বিষয়ক কমিটি যে চিঠি দিয়েছে, তা তারা এখনও সেটি 'হাতে পাননি'। তবে স্থানীয় পর্যায়ে আগেই নির্দেশনা দেওয়া আছে, যাতে তাদের সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা না হয়।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেছেন, পুরো জেলা অবরুদ্ধ করে, জেলার নির্দিষ্ট কিছু এলাকা- ভিত্তিক 'পরিস্থিতি বুঝে' সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
অবশ্য ঝুঁকিপূর্ণ মনে করলে স্থানীয় প্রশাসনও লকডাউনের ঘোষণা দিতে পারে, সেরকম নির্দেশনা আগেই দিয়ে রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
লকডাউন দিলে জেলাগুলোর অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে লকডাউন দিতে দেরি হচ্ছে।
তবে অধ্যাপক লিয়াকত আলী বলেন, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব। আম বা লিচু যেসব পরিবহনে পাঠানো হয় সেগুলো স্যানিটাইজ করে নিলে এবং মানুষের মুভমেন্ট কমালেও পরিবহন সম্ভব এবং সংক্রমণও নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। প্রয়োজনে পণ্য পরিবহনের সাথে যারা জড়িত তাদের কোভিড টেস্ট করাতে হবে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় গত ২৪ মে থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে লকডাউনের বিধিনিষেধ জারি করে জেলা প্রশাসন। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সেখানে চলমান লকডাউন আরও এক সপ্তাহ বাড়িয়ে আগামী ৭ জুন পর্যন্ত করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল হাফিজ আজ আশ্বস্ত করে বলেছেন, "এই লইকডাউন মৌসুমি আমের ব্যবসা প্রভাবিত করবে না।"
ঈদের আগে থেকে লকডাউনের কারণে ঢাকার পজেটিভিটি রেট কমলেও চাপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর, সাতক্ষীরা, যশোর, কুষ্টিয়া ও খুলনায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ছে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ওই জেলাগুলোতে সাতদিনের লকডাউনের সুপারিশ করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্য ও মহামারি বিষয়ক কমিটি।
কমিটির সদস্য ডা. আবু জামিল ফয়সাল বিষয়টি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে নিশ্চিত করে বলেছেন, আমরা জেলাওয়ারি লকডাউনের সুপারিশ করেছি। লকডাউন না দিলে সংক্রমণের চক্র ভাঙ্গা যাবে না। ম্যান টু ম্যান ট্রান্সমিশন বাড়লে সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
তিনি আরও বলেন, লকডাউনের পাশাপাশি সংক্রমণ মোকাবেলায় জনগণকে সম্পৃক্ত করারও সুপারিশ করেছি আমরা। এছাড়া, প্রান্তিক মানুষকে সব ধরনের সহায়তা দিতে হবে। না হলে লকডাউন কার্যকর হবে না।