খোঁড়াখুঁড়ি-যানজট, সারাবছরই সীমাহীন দুর্ভোগ রোকেয়া সরণিতে
গত কয়েক বছর ধরে চলছে রাজধানীর রোকেয়া সরণির একটি অংশের খননকাজ। কখনো ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষের (ওয়াসা) কাজ আবার কখনো ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের কাজ- এই সড়কে সারা বছরই চলে খোঁড়াখুঁড়ি।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মিরপুরে অবস্থিত বেগম রোকেয়া সরণির কাজীপাড়া মেট্রোরেল স্টেশন এলাকায় ড্রেনের কাজে আদালতের স্থিতিবস্থা তুলে নেওয়ার পরে এক মাসেও শেষ হয়নি কাজ। খোঁড়াখুঁড়ির কারণে প্রায় সাত মাস ধরে এ রাস্তার একপাশ দিয়েই চলাচল করছে গাড়ি। ফলে এ রাস্তা দিয়ে চলাচলকারীদের পোহাতে হচ্ছে সীমাহীন দুর্ভোগ।
এর মধ্যেই গত এক সপ্তাহ ধরে শেওড়াপাড়ার রাস্তার পূর্ব পাশ বন্ধ করে দিয়ে চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। এতে আরও বেড়েছে যানজট, রয়েছে দূর্ঘটনার ঝুঁকিও।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন বলছে, আদালতের স্থিতিবস্থার বিষয়টি জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে মিমাংসা হওয়ার পরেই রাস্তার কাজ শেষ করতে বলা হয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। আর কয়েকদিনের মধ্যে কাজীপাড়া অংশের কাজ শেষ করে খুলে দেওয়া হবে।
নতুন করে খোঁড়া রাস্তার কাজ শেষ হতে দুই মাসের মতো সময় লাগবে বলে জানায় তারা। আগামী ডিসেম্বরে মেট্রোরেল উদ্বোধনের আগে রাস্তা ঠিক করতে কিছুটা নিয়মের বাইরে যেয়ে রাস্তা খোঁড়া হচ্ছে বলে জানায় উত্তর সিটি।
জানা যায়, ঢাকা ওয়াসার একটি প্রকল্পের আওতায় রোকেয়া সরণিতে পয়ঃনিষ্কাশন নালা নির্মাণে ঠিকাদার নিয়োগ করেছিল ঢাকা ওয়াসা। ২০২০ এর ডিসেম্বরে পয়ঃনিষ্কাশনের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনকে বুঝিয়ে দেওয়ার পর ওয়াসার আওতায় চলমান ওই প্রকল্প বাতিল হয়ে যায়।
সড়কে নালার বাকি কাজ করতে ডিএনসিসির নিয়োগ করা নতুন ঠিকাদার কাজ শুরু করে। পাইপ বসাতে খোঁড়া হয় রাস্তা। এমন সময় আদালতের আশ্রয় নেন ঢাকা ওয়াসার আওতায় কার্যাদেশ পাওয়া ঠিকাদারেরা।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন বলছে, ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ওই পয়োনালার কাজ শেষ না করেই উন্নয়ন কাজ বন্ধ করে ঢাকা ওয়াসা। ওই অবস্থাতেই তাদের কাছে কাজ হস্তান্তর করা হয়। পরবর্তী সময়ে সিটি করপোরেশন নিজেদের অর্থায়নে কাজ শুরু করলে ওয়াসার আওতায় কার্যাদেশপ্রাপ্ত ঠিকাদার এ নিয়ে মামলা করেন। আদালত পরে সেখানে স্থগিতাদেশ দেন। এতে ওই নালার উন্নয়নকাজ বন্ধ হয়ে যায়।
কাজীপাড়া অংশের কাজ আদালতের স্থগিতাদেশ তুলে দেওয়ার পরে মাত্র চার দিনে সম্পন্ন করে খুলে দেওয়া সম্ভব বলে জানিয়েছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম।
ঠিকাদারকে দায়ী করছে সিটি করপোরেশন
কাজীপাড়ার অংশের মাত্র ৯০ মিটারের কাজে স্থগিতাদেশ দেওয়ার পর প্রায় ছয় মাস ধরে বন্ধ থাকে উন্নয়নকাজ। এরপর গত ১০ জুন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম নিজেই কাজীপাড়ার ঐ রাস্তা নিয়ে জটিলতা সমাধানে সরেজমিন পরিদর্শন করেন।
সেসময় তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, জনগণের ভোগান্তি দূর করতে প্রয়োজনে তিনি নিজে আদালতে যাবেন।
মেয়র বলেন, "এখানে কাজের সব প্রস্তুতি নেওয়া আছে। ইতোমধ্যে পাইপ ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি চলে এসেছে। অর্থও বরাদ্দ দেওয়া আছে। আদালতের স্থগিতাদেশ উঠে গেলে মাত্র চার দিনে এ কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব।"
তার ঘোষণার পরপরই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের সাথে মেয়র আলোচনা করেন এবং এরই প্রেক্ষিতে স্থগিতাদেশ তুলে নিতে আদালতে আবেদন করেন। আবেদনের প্রেক্ষিতে জুলাই এর প্রথম সপ্তাহে আদালত এ স্থগিতাদেশ তুলে নেয়। কিন্তু এর পরে প্রায় এক মাস চলে গেলেও রাস্তার কাজ শেষ করতে পারেনি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান।
মেয়র এ সমস্যা সমাধানের ঘোষণা দেওয়ার পর দুই মাসেও জনগুরুত্বপূর্ণ এ রাস্তাটির সমস্যা কমেনি বরং বেড়েছে। অপরদিকে বর্ষাকালে রাস্তাটির শেওড়াপাড়া অংশ বন্ধ করে খোঁড়া হচ্ছে। তাহলে এ রাস্তা দিয়ে চলাচলকারীরা ভোগান্তি থেকে কবে মুক্তি পাবে? এ প্রশ্ন এখন সবার মনেই।
এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের অঞ্চল-৪ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শহিদুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "পুরো কাজটি একবারেই শেষ করতে চাচ্ছি। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় নিয়েছে। আশা করি এরমধ্যে কাজ শেষ হবে।"
বর্ষার মধ্যে নতুন করে আবার রাস্তা খোঁড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, "মেট্রোরেল যেহেতু ডিসেম্বরে উদ্বোধন হবে তাই এ রাস্তার কাজ একবারেই শেষ করে ফেলতে হচ্ছে। এজন্য কিছুটা ভোগান্তি হচ্ছে ঐ এলাকার লোকজনের।"
সুয়ারেজের কাজ শেষে রাস্তার কাজ সম্পন্ন হতে দুই মাসের মতো সময় লাগবে বলে জানান তিনি। এর বাহিরে যে কাজ আছে সেগুলো ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে বলে উল্লেখ করেন শহিদুল।
মামলা এবং নতুন করে খোঁড়ার বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মকবুল হোসাইন টিবিএসকে বলেন, "আমাদের আইন বিভাগের মাধ্যমে বিষয়টি সমাধান হয়েছে ঈদের আগেই। মেয়র নিজেই ঠিকাদারদের ডেকে বিষয়টি সমাধান করেছেন। তখনই জনি এন্টারপ্রাইজকে দ্রুত কাজ শেষ করতে বলে দেওয়া হয়।"
তিনি আরো বলেন, "উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় একেবারে গুরুত্বপূর্ণ কোনো প্রকল্পের কাজ ব্যতীত বর্ষাকালে রাস্তা খোঁড়ার অনুমতি দেওয়া হয় না। ঐ এলাকায় যেহেতু মেট্রোরেলের স্টেশন রয়েছে তাই কাজ শেষ করতে কিছু কিছু স্থানে খোঁড়ার অনুমতি দিয়েছে উত্তর সিটি। তবে কাজগুলো দ্রুত শেষ করতে বলা হয়েছে।"
কাজীপাড়া বাসস্ট্যান্ডের ১০০ মিটার উত্তর দিক থেকে আগারগাঁওয়ের তালতলা পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার পয়ঃনিষ্কাশন নালার নির্মাণকাজের জন্য ১৬ কোটি টাকা বাজেটে জনি এন্টারপ্রাইজ নামের একটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হয়। তাদের কাজের মেয়াদ ছিল গত জুন মাস পর্যন্ত। এখন সেটিকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে বলে জানায় উত্তর সিটি কর্পোরেশন।
এরই কাজের অংশ হিসেবে নতুন করে শেওড়াপাড়া এলাকার রাস্তা খোঁড়া হচ্ছে বলে জানায় উত্তর সিটি। তবে ডিসেম্বরের মধ্যেও কাজ শেষ হবে কিনা তা নিয়েও রয়েছে সন্দেহ।
রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কাজ তত্বাবধান করছিলেন সাইড কন্ট্রাক্টর সুজন। তাকে কাজের বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি কোনো কথা না বলে বিষয়টিকে এড়িয়ে যেতে চান।
নারকীয় অভিজ্ঞতা
মঙ্গলবার সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, মিরপুরের বেগম রোকেয়া সরণির কাজীপাড়া থেকে শেওড়াপাড়ার পর্যন্ত রাস্তার বেহাল দশার কারণে এ অংশের দুই পাশে সকাল ও বিকেলে লেগে যায় দীর্ঘ যানজট। এ অংশ পার হতে এক থেকে দেড় ঘণ্টাও লেগে যায় অনেকসময়।
কাজীপাড়া মেট্রোরেল স্টেশনের নিচের রাস্তার পশ্চিম পাশের কাজ বন্ধ আছে জানুয়ারি থেকে। ফেলে রাখা হয়েছে নালা নির্মাণের ছয় ফুট আকারের বড় বড় ডায়া পাইপ, ইট, খোয়া, বালুসহ বিভিন্ন নির্মাণ সামগ্রী।
এছাড়া, কাজীপাড়া থেকে শেওড়াপাড়ার রাস্তার পূর্ব পাশের অন্তত ৮টি স্থানে রাস্তার অর্ধেকটা জুড়ে খুঁড়ে রাখা হয়েছে। এ স্থানগুলো একেবারেই উন্মুক্ত অবস্থায় রয়েছে।
কোথাও কোথাও চারিদিকে মাটি, বালু রাখা থাকলেও কয়েকটি দেখা যায় একেবারেই প্রতিবন্ধকতাবিহীন। ফলে যেকোনো সময় ঘটতে পারে দুর্ঘটনা। শেওড়াপাড়া বাস স্টপেজের পূর্ব পাশের রাস্তা বন্ধ করে মাটি খুঁড়ে বসানো হয়েছে বড় বড় ডায়া পাইপ। এগুলোর মুখে চলছে স্লাব তৈরীর কাজ। এক মাস আগেও এই রাস্তা খোঁড়া হয়েছিল বলে জানান স্থানীয়রা।
এ রাস্তা দিয়ে নিয়মিত চলাচলকারী মিরপুর-১১ এর বাসিন্দা সাহেরা বেগম টিবিএসকে বলেন, "এ রাস্তায় সারা বছরই খোঁড়াখুঁড়ি চলে। পুরো রাস্তা ভালোভাবে আসলেও এখানে যানজটে কেটে যায় এক থেকে দেড় ঘণ্টা। এছাড়া মেট্রোরেলের কাজের কারণে অনেক সময় রাতে পুরো রাস্তাই বন্ধ করে দেওয়া হয়।"
এ রাস্তায় চলাচলকারী বিহঙ্গ পরিবহনের ড্রাইভার শিমুল টিবিএসকে বলেন, "মিরপুর ১০ থেকে আগারগাঁও এ রাস্তায় গত এক বছর ধরে খোঁড়াখুঁড়ি চলছেই। রাস্তা উঁচু-নিচু থাকার কারণে বাসের ইঞ্জিনও দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। গত কয়েকমাস ধরে শেওড়াপাড়া থেকে কাজীপাড়া অংশে ভোগান্তির শেষ নেই। একটু বৃষ্টি হলেই রাস্তায় জমে যায় পানি। যানজট লেগে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।"
এদিকে এই এলাকার রাস্তার দুই পাশের দোকান ও শো-রুমগুলোর ব্যবসায়ও নেমেছে ধস। কিছু কিছু দোকান বাধ্য হয়ে বন্ধ করেও রাখতে হচ্ছে।
শেওড়াপাড়া এলাকার খাল ইলেকট্রনিক্সের জাবেদ হোসেন টিবিএসকে বলেন, "দোকানে বেচাকেনা নেই বললেই চলে। এ এলাকার ব্যবসা বলা যায় শেষ হয়ে গেছে। আগের থেকে বিক্রি অর্ধেকেরও নিচে নেমে এসেছে। রাস্তা কাঁটা, ভাঙ্গা থাকলে ক্রেতারা আসতে চায় না দোকানে।"