কর্ণফুলী গ্যাসের প্রিপেইড মিটার স্থাপন: মেয়াদের অর্ধেক সময় শেষ হলেও শুরু হয়নি প্রকল্পকাজ
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) প্রিপেইড মিটার স্থাপন প্রকল্পের মেয়াদের অর্ধেক সময় শেষ হলেও এখনো কাজ শুরু করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হাতে নেওয়া প্রকল্পটির দেড় বছর সময় পার হলেও এখনো নিয়োগ করা হয়নি ঠিকাদার। ফলে নির্ধারিত সময় ২০২৩ সালের জুন মাসের মধ্যে গ্যাস সরবরাহকারী সংস্থাটির এক লাখ আবাসিক সংযোগে প্রিপেইড মিটার স্থাপন নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। তবে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের ক্ষেত্রে পুনঃদরপত্র আহ্বান করতে গিয়ে দীর্ঘসূত্রিতার সৃষ্টি হয়েছে।
'আবাসিক গ্রাহকদের জন্য প্রিপেইড মিটার স্থাপন প্রকল্প' শিরোনামে ২০২১ এর ফেব্রুয়ারিতে এক লাখ মিটার স্থাপনের জন্য প্রকল্প হাতে নেয় কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল)। ২৪১ কোটি ৬১ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয় ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত। সংস্থাটির নিজস্ব অর্থায়নের প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য প্রাকৃতিক গ্যাসের অপচয় রোধ, সাশ্রয়ী ব্যবহার নিশ্চিত ও গ্যাসের ব্যবহার হ্রাস করা।
কন্ট্যাক্টলেস স্মার্ট কার্ডভিত্তিক উন্নত প্রযুক্তির প্রিপেইড গ্যাস মিটার ব্যাটারিচালিত। নিয়ন্ত্রক বাল্বের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু বা বন্ধ করতে পারে মিটারটি। ব্যবহার অনুযায়ীই মূল্য প্রদান করতে হবে। নির্দিষ্ট মাত্রার ভূমিকম্প হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে। মিটারে রিচার্জকৃত ক্রেডিট শেষ হয়ে গেলেও তাৎক্ষণিকভাবে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হবে না। স্বয়ংক্রিয়ভাবে জরুরি ব্যালেন্স দেওয়া হবে। ব্যবহার করা গ্যাস ও মিটার সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য মিটারের এলসিডি ডিসপ্লেতে প্রদর্শিত হবে।
২০২১ সালের ১৮ মে প্রকল্পটি প্রশাসনিক অনুমোদন পায়। এরপর পরামর্শক সংস্থা নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়। ওইসময় দরপত্র করা হলেও শর্ত পূরণ না করায় ওই বছরের অক্টোবর মাসে পরামর্শক সংস্থা নিয়োগের জন্য পুনঃদরপত্র আহ্বান করা হয়। সব প্রক্রিয়া শেষে চলতি বছরের মে মাসে ডিটিসিএল নামে একটি সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করা হয়। পরামর্শক সংস্থাটি নতুন প্রকল্পের রিচার্জ সিস্টেম, সফটওয়্যার ম্যানেজমেন্টসহ আইটি বিষয়ক কাজের সমন্বয় করবে এবং মিটার ইন্সটলেশনের কারিগরি দিক নিয়ে পরামর্শ দেবে। এছাড়া ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান যথাযথ প্রক্রিয়ায় কাজ করছে কিনা, তা দেখভাল করবে। প্রকল্প হাতে নেওয়ার দেড় বছর পর গত ১৪ আগস্ট ঠিকাদার নিয়োগে পত্রিকায় দরপত্র আহ্বান করা হয়।
আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর দরপত্র জমার সময় শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
প্রকল্পসংশ্লিষ্ট পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "প্রকল্পটির কাজে ধীরগতি আসে মূলত পরামর্শক নিয়োগ দিতে গিয়ে। এরপর দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। তবে অংশগ্রহণকারী ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলো দরপত্র প্রক্রিয়ায় সময় বাড়ানোর অনুরোধ জানিয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তারা জোগাড় করতে পারেনি। এজন্য সময় বাড়ানো হতে পারে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী বছরের শুরুর দিকে মিটার স্থাপন প্রক্রিয়া শুরু হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে না। সময় বাড়ানো লাগতে পারে।"
তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মিটার স্থাপন প্রকল্প সম্পন্নের বিষয়ে আশাবাদী কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ মাজেদ। তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আশা করছি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হবে। এ লক্ষ্যে কাজ চলছে।"
কর্ণফুলী গ্যাসের মোট ৬ লাখ আবাসিক গ্রাহক রয়েছে। এর মধ্যে জাইকার অর্থায়নে ২০১৫ সালে হাতে নেওয়া ২৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পের অধীনে ৬০ হাজার সংযোগে প্রিপেইড মিটার স্থাপন করা হয়; প্রকল্পটির কাজ শেষ করা হয় ২০১৯ সালে।
এদিকে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে অনলাইনে প্রিপেইড মিটারের জন্য গ্রাহকদের আবেদন গ্রহণ করছে সংস্থাটি। তবে অনলাইনে আগ্রহ কম। গত সাত মাসেও এক লাখ আবেদনের কোটা পূরণ হয়নি। এ পর্যন্ত ৭৫ হাজার আবেদন জমা পড়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তা বলেন, "প্রি-পেইড মিটার কিছু গ্রাহকের জন্য সুবিধা বা কিছু গ্রাহকের জন্য অসুবিধা। যারা কম গ্যাস ব্যবহার করে তারা এখান থেকে সুবিধা পাবে। এছাড়া প্রতিটি চুলার জন্য রাইজার থেকে রান্নাঘর পর্যন্ত জিআই লাইন গ্রাহককে নিজ খরচে স্থাপন করতে হবে। জিআই লাইনে লিকেজ হলে কেজিডিসিএলের অনুমোদিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দিয়ে মেরামত করতে হবে। রান্নাঘরে পর্যাপ্ত ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। এসব কারণে অনেকে আগ্রহী হচ্ছে না।"
পেট্রোবাংলার তথ্যমতে, দেশের ছয়টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানির মাধ্যমে পেট্রোবাংলা গ্যাস সরবরাহ কার্যক্রম পরিচালনা করে। এসব প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে মোট ৪৩ লাখ গ্রাহক রয়েছে। এরমধ্যে মাত্র ৩ লাখ ৭৯ হাজার গ্রাহককে প্রি-পেইড মিটার কার্যক্রমের আওতায় আনা গেছে। এরমধ্যে তিতাস গ্যাস ৩ লাখ ১৯ হাজার ৬৬৫ এবং চট্টগ্রামে কর্ণফুলী গ্যাস কোম্পানি ৬০ হাজার মিটার স্থাপন করতে পেরেছে। ২০১৯ সালে এক পরিপত্রের মাধ্যমে সবাইকে প্রিপেইড মিটার স্থাপনের নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।
২০০৫ সালে রাজধানীর বনানীতে প্রথমবারের মতো গ্যাসের মিটার স্থাপন বসায় তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (টিজিটিডিসিএল)। ২০২৫ সালের মধ্যে সকল গ্রাহককে মিটারের আওতায় আনার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিল সরকার। কিন্তু গ্যাসের মিটারযুগে প্রবেশের ১৭ বছর পার হলেও ১০ শতাংশ গ্রাহককেও মিটারের আওতায় আনতে পারেনি পেট্রোবাংলার নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী গ্যাসের এক লাখ মিটার স্থাপন প্রকল্প ছাড়াও জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন এ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম লিমিটেড ৫০ হাজার মিটার স্থাপনের প্রকল্প হাতে নিয়েছে।
বিইআরসির তথ্যমতে, ২০১৯ সালে দাম বাড়ানোর সময় মিটারহীন গ্রাহকের ক্ষেত্রে দুই চুলায় গ্যাসের মাসিক গড় ব্যবহার ৭৭ ঘনমিটার ধরেছিল প্রতিষ্ঠানটি। মিটার স্থাপনের মাধ্যমে গ্যাসের অপচয় রোধ, ব্যবহার হ্রাস করে তা ৬০ ঘনমিটারে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।