কর্ণফুলী গ্যাস কর্মচারীদের জন্য ১৮ লাখ টাকা বোনাস, টাকা কোম্পানির না…
২০২১-২২ অর্থবছরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ১৮ লাখ টাকা করে মুনাফা বোনাস দিয়েছে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডে (কেজিডিসিএল)। অথচ এ টাকা দেওয়ার কথা ছিল পেট্রোবাংলাকে।
এই অর্থ আয় করা হয় বহুজাতিক কোম্পানি- কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড (কাফকো)'র কাছ থেকে; গ্যাস কোম্পানিটি কাফকো'র কাছে রাষ্ট্রায়ত্ত সার কোম্পানিগুলোর জন্য বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে উচ্চ দামে গ্যাস বিক্রি করে।
একজন বিশেষজ্ঞের মতে, অতিরিক্ত এই অর্থ পেট্রোবাংলাকে না দিয়ে বিইআরসির আদেশ লঙ্ঘন করে নিজদের কাছেই রাখে কর্ণফুলী গ্যাস।
জ্বালানি বিভাগের সূত্রগুলো টিবিএসকে জানায়, সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানায় ভর্তুকি মূল্যে গ্যাস সরবরাহ করে। কিন্তু, কাফকো একটি বহুজাতিক কোম্পানি, যা বাংলাদেশ, জাপান, ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ডের সরকার ও বেসরকারি খাতের যৌথ উদ্যোগ ও সমর্থনে গঠিত। ফলে কোম্পানিটিকে উচ্চ দরেই গ্যাস কিনতে হয়।
২০২২ সালের জুন পর্যন্ত কাফকোর থেকে এভাবে আয় করা দুই হাজার ৮৩৪ কোটি টাকা পেট্রোবাংলাকে দেয়নি কর্ণফুলী গ্যাস কোম্পানি।
বিইআরসির নির্দেশনা অনুসারে, বিতরণ চার্জ বাদে, গ্যাস বিক্রির সকল আয় পেট্রোবাংলাকে দিতে হবে। কিন্তু, ২০১০ সালে কেজিডিসিএল গঠনের পর থেকেই তা করা হচ্ছে না।
কাফকোর থেকে অতিরিক্ত আয়ের অর্থ বোনাস হিসেবে দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে কর্ণফুলী গ্যাস- এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মো. রফিকুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন যে, কোম্পানির পরিচালক বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মুনাফা বন্টন করা হয়েছে, বোর্ডের চেয়ারম্যান হলেন জ্বালানি সচিব।
'আপনারা জানেন, একটি কোম্পানি তার পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত দ্বারা চালিত হয়, যা একটি স্বায়ত্তশাসিত কর্তৃপক্ষ। তাই আমরা বোর্ডের সিদ্ধান্তের বাইরে কাজ করতে পারি না। যদি রেগুলেটরি কমিশনের কোনো আদেশ থাকে, তবে আমাদের অবশ্যই বোর্ডকে তা জানাতে হবে'- বলেন তিনি।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অবশ্য একে 'লুন্ঠনপরায়ণ মুনাফা বোনাস' বলেই মন্তব্য করেছেন।
'গ্যাস বিক্রির অতিরিক্ত আয়কে মুনাফা হিসেবে দেখিয়ে গ্যাস বিতরণ বিধিমালা ও বিইআরসি'র আদেশের সম্পূর্ণ লঙ্ঘন করা হয়েছে'- যোগ করেন তিনি।
স্থানীয়ভাবে উৎপাদন কমতে থাকায়, সকল খাতে গ্যাস সরবরাহ করে – দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি)'র মতো দামি জ্বালানি আমদানি করছে পেট্রোবাংলা।
প্রতি ঘনমিটার এলএনজি ৪৬.৮৫ টাকায় কেনে পেট্রোবাংলা, অন্যদিকে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর থেকে একই পরিমাণের ওয়েটেড মূল্য পায় ২১.২৭ টাকা।
এতে করে, বিপুল আর্থিক ঘাটতির শিকার হয় পেট্রোবাংলা। ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত একমাত্র জ্বালানি আমদানিকারকটি– আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণে রাখতে এলএনজি আমদানি হ্রাস করে।
২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত কাফকোর কাছে প্রতিইউনিট গ্যাস বিক্রিতে ৯.২৯ টাকা অতিরিক্ত আয় করে কর্ণফুলী গ্যাস কোম্পানি। এসময় বিইআরসি নির্ধারিত দর প্রতি ঘনমিটারে ২.৭১ টাকা হলেও, কাফকোর কাছে তা বিক্রি করা হয়েছে ১২ টাকায়।
২০১৯ সালের ৩০ জুন বিইআরসি সার শিল্পের জন্য গ্যাসের দাম বাড়িয়ে ৪.৪৫ টাকা নির্ধারণের পর, এবং ২০২২ সালের জুনে খুচরা পর্যায়ে গ্যাসের দাম আরও একবার বৃদ্ধির আগপর্যন্ত – কাফকোর কাছে প্রতি ঘনমিটার গ্যাস বিক্রির মাধ্যমে অতিরিক্ত ৭.৫৫ টাকা আয় করেছে কর্ণফুলী গ্যাস।
কর্ণফুলী গ্যাস কোম্পানি গঠনের আগে – নোয়াখালি, কুমিল্লা ও চাঁদপুরে গ্যাস বিতরণকারী আরেকটি কোম্পানি বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (বিজিডিসিএল) এর গ্রাহক ছিল কাফকো।
পেট্রোবাংলার একটি নথিতে বলা হয়েছে, বাখরাবাদ গ্যাস কাফকো'র থেকে পাওয়া অতিরিক্ত অর্থ পেট্রোবাংলার কাছেই জমা দিত।
কিন্তু, ২০১০ সালে কার্যক্রম শুরুর পর থেকেই কাফকোর থেকে অর্জিত অতিরিক্ত আয় জমা দেওয়া বন্ধ করে কর্ণফুলী গ্যাস। এরপর ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ কোম্পানিটিকে তাদের অতিরিক্ত এ আয়ের ৫০ শতাংশ পেট্রোবাংলার কাছে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয়, বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ যা বিইআরসি'র আদেশের লঙ্ঘন বলেই মতপ্রকাশ করেছিলেন।
এই প্রেক্ষাপটে, ২০১০ সাল থেকে কাফকোর কাছে কী পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে, তার মূল্য এবং কত টাকা পাওয়া গেছে – তা বিস্তারিত প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানাতে কর্ণফুলী গ্যাসকে ডজন ডজন চিঠি দিয়েছে পেট্রোবাংলা।
কিন্তু, তারপরও বিতরণকারী কোম্পানিটি এই প্রতিবেদন তো দেয়ইনি, সঙ্গে নিয়মিতভাবে অর্থ জমাও দেয়নি।
বিইআরসির চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল টিবিএসকে বলেন, কাফকোর সাথে কর্ণফুলী গ্যাসের আলাদা কোনো চুক্তি আছে কিনা- সেটা তিনি জানেন না। 'কিন্তু, কমিশনের নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে উচ্চ দরে কাফকোর কাছে গ্যাস বিক্রি করা হয়েছে, এ ধরনের কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে'।
কর্ণফুলী গ্যাসের বোর্ড চেয়ারম্যান এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব ড. মোঃ খায়েরুজ্জামান মজুমদার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে এ পদে নিযুক্ত হওয়ায় তিনি এবিষয়ে জানেন না।
'না জেনে এবিষয়ে কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না' বলেন তিনি।
একই উত্তর দিয়েছেন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার। তিনিও চলতি মাসের শুরুতে স্বপদে নিযুক্ত হন।
গতবছর কর্ণফুলী গ্যাস যখন মুনাফা বোনাস দেয়, পেট্রোবাংলায় সেসময়ে চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বর্তমানে পানিসম্পদ সচিব নাজমুল আহসান। মন্তব্য চেয়ে তাকে একটি টেক্সট ম্যাসেজ পাঠানো হলেও, তিনি তার উত্তর দেননি।