পরিত্যক্ত স্থান এখন শিশুবান্ধব গণপরিসর
ঢাকার মিরপুর-১০ এর জল্লাদখানা বধ্যভূমির বিপরীত পাশের পরিত্যক্ত স্থানে একসময় অবৈধ পার্কিং, মাদকাসক্তদের আড্ডাসহ বর্জ্য ফেলার স্থান ছিল। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে গত বছরের ডিসেম্বরে নগরবাসীর সুস্বাস্থ্যের জন্য গণপরিসরের গুরুত্ব বিবেচনা করে স্থানটিকে শিশুবান্ধব গণপরিসরে পরিণত করা হয়।
মাত্র ৫৫ লাখ টাকা খরচে এ গণপরিসরটিতে শিশুদের বিনোদনের জন্য বিভিন্ন ধরণের খেলার উপকরণ, ব্যায়াম ও হাঁটার সুব্যবস্থা, একটি উন্মুক্ত মঞ্চ, বসার স্থান, পাবলিক টয়লেটসহ বিভিন্ন সুবিধার ব্যবস্থা করে। এখন আর স্থানটিতে মাদকসেবিদের আড্ডা কিংবা অবৈধ পার্কিং দেখা যায় না। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এখানে শিশু-কিশোরসহ নানা বয়সী মানুষ আসেন খেলাধুলা, ব্যয়াম কিংবা সময় কাটাতে।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের নেতৃত্বে এলাকাবাসীর সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এবং ইউএন হ্যাবিটেট, নগর গবেষণা কেন্দ্র (সিইউএস), ভূমিজ, বার্জার বাংলাদেশ লিমিটেড, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ সহযোগিতায় পাবলিক-প্রাইভেট অংশীদারিত্বের মাধ্যমে উত্তর সিটির ৩ নম্বর ওয়ার্ডের এ স্থানকে সকলের জন্য নিরাপদ, প্রবেশযোগ্য এবং সবুজ গণপরিসরে রূপদান করা হয়।
গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর জল্লাদখানা বধ্যভূমি সংলগ্ন স্থানে 'শিশুবান্ধব গণপরিসর' এর উদ্বোধন করেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম।
সম্প্রতি স্থানটিতে সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, সকাল থেকেই এখানে শিশুরা এসে খেলাধুলা করছে। বিশেষ করে আশেপাশের নিম্ন আয়ের বাসিন্দাদের এ স্থানটিই একমাত্র বিনোদন কেন্দ্র। এছাড়া সকালে ও সন্ধ্যায় বিভিন্ন বয়সী মানুষ হাঁটতে আসেন। বসে সময় কাটানোর জন্য তৈরী করা স্থানগুলো বিকাল হলেই পরিপূর্ণ হয়ে যায় স্থানীয় মানুষে।
পাশের দেওয়ালে আঁকা আছে মুক্তিযুদ্ধ ও শিশু বিষয়ক নানা আর্ট। শিশুদের খেলার স্থানে স্থাপন করা হয়েছে দোলনা, স্লিপার। পূর্বপাশে তৈরী করা হয়েছে একটি পাবলিক টয়লেট, যেখানে পুরুষ ও নারীদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তবে সিটি কর্পোরেশন অনুমতি না দেওয়ায় চালু হয়নি পাবলিক টয়লেটটি।
বিকালে এখানে খেলাধুলা করতে আসা পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সায়মা হক টিবিএসকে বলেন, 'আগে আশেপাশে খেলার জায়গা ছিল না কিন্তু এখন বিকাল হলেই এখানে খেলতে আসি। সময় পেলেই বন্ধুদের সাথে এখানে আসি।'
স্থানীয় বাসিন্দা মো. রাজু বলেন, 'রাস্তার ওপারেই আমার দোকান কিন্তু স্থানটি সাজানোর আগে সন্ধ্যার পরে দোকান বন্ধ করে দিতে হতো এখানে আসা মাদকসেবীদের জন্য। এ এলাকা পুরোটা ভূতুড়ে অবস্থা হয়ে থাকতো। এখন আর সেই ভয় নাই। সারাদিনই মানুষের আনাগোনা থাকে।'
আকাশ আহমেদ এসেছেন ভাতিজা সজিবুল ইসলামকে নিয়ে। তিনি বলেন, 'মাঝেমাঝে বাসার শিশুদের নিয়ে এখানে আসি। ওরা খেলাধুলা করে এবং আমরাও বসে একটু অবসর সময় কাটাই। আগে খেলার মতো জায়গা ছিল না।'
দুই বছরের মেয়েকে খেলতে নিয়ে আসা মৌসুমি বেগম বলেন, 'এ স্থানটি ব্যতীত খেলার মতো জায়গা নেই আশেপাশে। টাকা খরচ করে দূরের মাঠ কিংবা পার্কে নিয়ে যাওয়ার সক্ষমতাও নেই আমাদের। শিশুদের নিয়ে এখানে আসলে ওরা একটু ছোটাছুটি করতে পারে।'
তবে স্থানটি সিটি কর্পোরেশন দেখভাল করার কথা থাকলেও নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয় না। এছাড়া তদারকির অভাবে খেলনাগুলোও নষ্ট হতে বসেছে।
এদিকে প্রায় দুই মাস আগে পাবলিক টয়লেটের কাজ শেষ হলেও তা চালু হয়নি। নারী ও শিশুদের নিয়ে কাজ করা ভূমিজ পরিচালনা করবে পাবলিক টয়লেটটি কিন্তু সিটি কর্পোরেশন থেকে তারা এখনও অনুমতি পায়নি।
ভূমিজ এর প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও ফারহানা রশীদ টিবিএসকে বলেন, 'স্থানটি গণপরিসরে পরিণত হওয়ায় সারাদিনই শিশুরা খেলাধুলাসহ সব বয়সী মানুষ ক্লান্তিহীন সময় কাটাতে পারেন। এ স্থানটি তৈরী করতে খুব বেশি খরচ কিংবা কষ্টও হয়নি। শুধ দরকার ছিল সিটি কর্পোরেশন এবং স্থানীয়দের সাথে একটি সমন্বয়।'
তিনি বলেন, 'আমরা গণপরিসরটি করার আগে এ স্থানে সার্ভে করেছি এবং স্থানীয়দের সাথে কথা বলেছি ও তাদের মতামত নিয়েছি। এ স্থানটিতে স্থানীয় বাসিন্দারা কী কী চায় এবং তারা সেটিকে কিভাবে ব্যবহার করবে তার উপর ভিত্তি করে স্থানটি সাজানো হয়েছে। সবমিলে ৫০ থেকে ৫৫ লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে। ইউএন হ্যাবিটেটের উদ্দেশ্যই হচ্ছে কম খরচে স্থানটি সুন্দর করা এবং সর্বোচ্চ সুবিধা দেওয়া।'
তিনি বলেন, 'পাবলিক টয়লেটের কাজ শেষ হয়েছে প্রায় ২ মাস আগে কিন্তু সিটি কর্পোরেশন থেকে আমরা এখনও অনুমতি না পাওয়ায় কার্যক্রম শুরু করতে পারিনি। সিটি কর্পোরেশনের প্রক্রিয়া শেষ হলেই আমরা পাবলিক টয়লেট উন্মুক্ত করতে পারবো।'
স্থানটি নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার বিষয়ে তিনি বলেন, 'স্থানটি নিয়মিত পরিষ্কারকরা হয় না। যখন সিটি কর্পোরেশন কিংবা কাউন্সিলর কোনো প্রোগ্রাম করে তখন কেবল পরিষ্কার করা হয়। এখন স্থানটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের। আমরা এখন ভলান্টিয়ারের দায়িত্ব পালন করছি এবং সিটি কর্পোরেশনকে জানিয়েছি স্থানটির অপরিচ্ছন্নতার বিষয়ে।'
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মাকসুদ হাসেম টিবিএসকে বলেন, 'আমরা এ স্থানটিসহ মিরপুর সেকশন-১৩ এর ৭নং ওয়ার্ডে আরও একটি গণপরিসর তৈরী করেছি। এছাড়া আরও দুটির কাজ চলমান। সিটি কর্পোরেশনের পরিত্যক্ত কিংবা অব্যবহৃত জায়গা পেলে আমরা স্বল্প খরচেই শিশুসহ সকল বয়সীদের জন্য উন্মুক্ত স্থান করতে চাই।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা স্থানগুলো স্থানীয় কাউন্সিলর ও স্থানীয় বাসিন্দাদের মাধ্যমে রক্ষণাবেক্ষণ করছি। এর পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও কাজ করছে। যে সমস্যাগুলো আছে সেগুলো সমাধানের চেষ্টা করছি।'