টান অনুভব করা বাংলাদেশিরা এখনো যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনে বাস করছেন
দেশটিতে চলমান যুদ্ধের এক বছর পরও ইউক্রেনের সাথে সম্পর্ক গভীর হওয়ায় কমপক্ষে ৩০ জন বাংলাদেশি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে এখনো বাস করছেন।
সেখানে নিরাপদ বোধ করার কারণে এবং ইউক্রেনের সাথে গভীরে প্রোথিত সম্পর্কের কারণেই তারা সেখানে থেকে গিয়েছেন বলে জানিয়েছেন পোল্যান্ডে থাকা বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা। ইউক্রেনে কোনো স্থায়ী দূতাবাস না থাকায় পোল্যান্ডের দূতাবাসটিই ইউক্রেনের বাংলাদেশিদের বিষয়টিও দেখাশোনা করে।
পোল্যান্ডে বাংলাদেশের অ্যাম্বাসেডর সুলতানা লায়লা হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে গত বুধবার ফোনের মাধ্যমে জানান, "এক বছর ধরে চলা যুদ্ধের পরও তারা [বাংলাদেশি] এখনো ইউক্রেনের বিভিন্ন প্রদেশে বাস করছেন, কারণ তাদের বেশিরভাগই দেশটির নাগরিক এবং সেখানে নিরাপদ বোধ করছেন। এ কারণেই তারা এখনো সেখান থেকে চলে আসেননি।"
ইউক্রেনের বাংলাদেশ কনস্যুলেটের অনারারি উপদেষ্টা মাহবুব আলম ছয় মাস আগেই দেশটি ছেড়েছেন। তবে ইউক্রেনে বাস করা বাংলাদেশিদের সাথে এখনো যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন। "থেকে যাওয়া বেশিরভাগ বাংলাদেশিরাই এখন রাজধানী কিয়েভে বাস করছেন, কারণ এটিই তুলনামূলকভাবে বেশি নিরাপদ। তবে তারা সেখানে প্রায়ই বিদ্যুৎ সংকটের মুখোমুখি হচ্ছেন। যার ফলে ইন্টারনেটসহ অন্যান্য সেবা পেতে সমস্যা হচ্ছে," বলে টিবিএসকে জানান মাহবুব।
"বিদ্যুৎ না থাকায় অথবা হঠাৎ করে এয়ার সাইরেন বেজে ওঠায় দোকানগুলো প্রায়ই বন্ধ থাকছে। ফলে তাদেরকে খাবারসহ অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সংগ্রহ করতে বেগ পেতে হচ্ছে," বলে যোগ করেন মাহবুব।
গত সপ্তাহে কিয়েভের কয়েকজন বাংলাদেশির সাথে কথা বলে তিনি জানতে পেরেছেন, "সবাই-ই কম বেশি ভয়ের মধ্যে রয়েছেন। আবাসিক এলাকাগুলোতে সবাই রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে পারেন। তবে শহরে খুব বেশি গাড়ি দেখা যায় না।"
ইউক্রেনের বাংলাদেশিদের সীমিত আয় সম্পর্কে উল্লেখ করে বলেন, "যদিও বেশ কয়েকজন চাকরিজীবি রয়েছে সেখানে, তবে বেশিরভাগই ব্যবসার সাথে জড়িত। কিয়েভের ওপেন মার্কেটে বেশ কিছু ছোট-বড় দোকান রয়েছে তাদের। তবে কোনো দোকানই তেমন ভালো ব্যবসা করতে পারছে না।"
কিয়েভের এক বড় শপিং মলে পণ্য সরবরাহ করতেন বাংলাদেশি হোসেইন মোহাম্মাদ শাখাওয়াত সেলিম। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তার ব্যবসা বন্ধ করে দিলেও তিনি ইউক্রেন ছেড়ে যাননি। তিনি জানান, "আমি এখন কিয়েভের আরেক প্রান্তে ছোট একটি ব্যবসা চালাচ্ছি। এটি রাজধানী হওয়ায় শহরটি বেশ নিরাপদ, এবং তাই আমরা নিরাপদে কাজ করতে পারছি।"
৫৫ বছর বয়সী হাসিনুল হক ইউক্রেনে ৩৪ বছর ধরে বাস করছেন। তিনি সেখানেই বিয়ে করে স্থায়ীভাবে থেকে গিয়েছেন। তিনি টিবিএসকে জানান, "যুদ্ধের পর আগের মতো ব্যবসা করতে না পারায় অনেকেই বাসা ভাড়াটুকুও দিতে পারছে না।"
গত দুই সপ্তাহ ধরে বিদ্যুতের অবস্থার উন্নতি হওয়ার সংবাদ জানিয়ে হাসিনুল বলেন, "গত অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত প্রতিদিনই বেশ কয়েকবার বিদ্যুৎ চলে যেত। প্রতিদিন পাঁচ ঘণ্টা লোড-শেডিং হতো।"
ইউক্রেনের অন্যান্য অঞ্চল থেকে আসা শরণার্থীরা কিয়েভে আশ্রয় নিয়েছেন। হাসিনুল জানান, "যেহেতু রাজধানী অন্যান্য শহরের তুলনায় বেশি সুরক্ষিত, তাই অন্যান্য শহর থেকে অনেকেই এখানে এসেছেন। কিন্তু মিসাইল আক্রমণের অবস্থা হলেই অ্যালার্ম বেজে ওঠে। তাই এখনো পুরোপুরি ভয় কাটেনি।"
একটি বেসরকারি হিসাব অনুযায়ী, যুদ্ধের আগে ইউক্রেনে দেড় হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি থাকতেন। সুলতানা লায়লা হোসেন জানান, "যুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথে আমরা সেখান থেকে বাংলাদেশিদেরকে সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু করি। তখন প্রায় ৮৫০ জন বাংলাদেশি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে এদিকে চলে আসে। আরও বেশ কয়েকজন এসেছে তারপর। আমার জানামতে, মাত্র ৮ জন বাংলাদেশি দেশে ফিরে গিয়েছে। বাকিরা সবাই অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে চলে গিয়েছেন।"
৬১ বছর বয়সী খালেদ হোসেন খান, যিনি রাজধানী কিয়েভে ব্যবসা করতেন, যুদ্ধ শুরুর ছয় মাস পর ইউক্রেন ছাড়েন। এখন তিনি তার পরিবারের সাথে সুইটজারল্যান্ডের লজানে বাস করছেন।
ঢাকায় বাস করা খালেদের বাবা আব্দুস সালাম খান জানান, "খালেদ আমার পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে বড়। ১৯৮৪ সালে ও উচ্চতর পড়াশোনার জন্য ইউক্রেনে যায় আর সেখানেই থেকে যায়। ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আমরা খালেদের পরিবারকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ি। তবে এখন তারা সুইজারল্যান্ডে থাকার চেষ্টা চালাচ্ছে।"
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের ফলে ইউরোপের পূর্বাঞ্চলে এক শরণার্থী সংকটের সূচনা হয়। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত কমপক্ষে ৭৫,৩৬,৪৩৩ জন ইউক্রেনীয় শরণার্থী অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে আশ্রয় নিয়েছেন। পোল্যান্ড এবং জার্মানি উভয়ই দশ লক্ষেরও বেশি শরণার্থীকে গ্রহণ করেছে, যা দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। এছাড়াও চেকিয়া প্রায় ৫ লক্ষ এবং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ, ফ্রান্স, তুরস্ক, ইতালি এবং স্পেন এক লক্ষ থেকে তিন লক্ষ ইউক্রেনীয় শরণার্থীদেরকে গ্রহণ করেছে।
হাঙ্গেরি, রোমানিয়া, স্লোভাকিয়া, মলদোভার মতো দেশগুলোতেও ছোট সংখ্যায় ইউক্রেনীয় শরণার্থীরা আশ্রয় নিয়েছে।