শখের প্রদর্শনী থেকে বড় ফ্যাশন ব্র্যান্ড ‘শৈল্পিক’
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় পাঁচ বন্ধু মিলে নিজেদের নকশা করা কিছু পোষাক নিয়ে প্রদর্শনীর আয়োজন করেন এইচ এম ইলিয়াছ। ২০০১ সালে সপ্তাহব্যাপী চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমিতে আয়োজিত প্রদর্শনীতে মোট পোষাকের ৫০ শতাংশ বিক্রি হয় ৮৫ হাজার টাকায়।
পরিশ্রম অনুযায়ী তেমন লাভ না হওয়ায় প্রথমেই এই উদ্যোগ থেকে সরে যান ইলিয়াছের চার বন্ধু। তবে হাল ছাড়েননি ইলিয়াছ। তিলে তিলে গড়া পিতার আইসক্রিম ফ্যাক্টরির ব্যবসার সংগ্রাম তাকে এই পেশা আঁকড়ে থাকার সাহস যুগিয়েছে।
স্ত্রীর অনুপ্রেরণায় ইলিয়াছ ২০০২ ও ২০০৩ সালে চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমিতে আবারো আয়োজন করেন পোষাক প্রদর্শনীর। দেশীয় সংস্কৃতির আবহে নিজের করা ডিজাইন তরুণ প্রজন্মের কাছে বেশ সাড়া ফেলে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউট থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে ব্রত নিলেন ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের উপর নিজের ক্যারিয়ার গড়বেন। পোষাক প্রদর্শনীতে প্রতিষ্ঠানের নাম 'ঢঙ' দেওয়া হলেও পরিবারের আপত্তিতে নাম পরিবর্তন করলেন 'শৈল্পিক' নামে।
আগ্রাবাদের মৌলভীপাড়ার বাসার একটি রুম থেকে যাত্রা শুরু শৈল্পিকের। ২০০৪ সালে ১৫ লাখ টাকা বিনিয়োগে আগ্রাবাদের সিঙ্গাপুর ব্যাংকক মার্কেটে একটি শো রুম দেন। সেই থেকে চট্টগ্রামের ফ্যাশন জগতে শৈল্পিকের এগিয়ে যাওয়া শুরু। ক্রমাগত চট্টগ্রাম নগরীর সকল শপিংমলে বাড়তে থাকে শৈল্পিকের আউটলেট।
বর্তমানে চট্টগ্রাম নগরীতে শৈল্পিকের ১৭টি আউটলেট রয়েছে। তিন পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, পর্যটন শহর কক্সবাজার, সিলেট সহ বিভিন্ন উপজেলায় শৈল্পিকের মোট ৪৬টি আউটলেট রয়েছে। পাঞ্জাবি, শার্ট, টি শার্ট, থ্রিপিসের জন্য শৈল্পিক ব্রান্ডের সুখ্যাতি রয়েছে। চট্টগ্রাম নগরীর চন্দ্রনগর, খুলশী এবং দেওয়ানহাটের তিনটি কারখানা এবং আউটলেটে কাজ করে চার শতাধিক কর্মী।
বছরে এক লাখ পিসের বেশি ড্রেস তৈরি করে শৈল্পিক। প্রতিবছর ঈদ এবং পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে নতুন ডিজাইনের পোষাক নিয়ে আসে এই ফ্যাশন ব্র্যান্ড। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক চিত্রশিল্পী এইচ এম ইলিয়াছ নিজেই এসব ডিজাইন তৈরী করেন। পোষাকের মাধ্যমে এসব ডিজাইন গত ২০ বছর ধরে তরুণ প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দিচ্ছেন তিনি।
দেশাত্ববোধ থেকে পোষাকের ডিজাইনে বাংলাদেশের সংস্কৃতি তুলে ধরে শৈল্পিক। পাঞ্জাবির ক্ষেত্রে টেলিগ্রাফি ডিজাইনে গুরুত্ব দেওয়া হয়। বিভিন্ন রকম ফেব্রিকসের সমন্বয়ে এইচ এম ইলিয়াছ তার ভাবনাগুলো প্রকাশ করেছেন নান্দনিকভাবে।
বছরে ১ লাখ পিসের বেশি পোষাক তৈরী করে শৈল্পিক। ঈদ এবং পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর ফ্যাশনে বৈচিত্র্য নিয়ে আসে প্রতিষ্ঠানটি। সব শ্রেণীপেশার মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয় শৈল্পিক। ঈদ কিংবা পহেলা বৈশাখে চট্টগ্রামের তরুণ সমাজের কাছে শৈল্পিক ব্র্যান্ড পছন্দের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।
২০১৪ সালে ফার্নিচার খাতে ব্যবসা সম্প্রসারণ করে শৈল্পিক। চট্টগ্রাম নগরীর কাজীর দেউড়ি আগ্রাবাদ এক্সেস রোডে প্রতিষ্ঠানটির রয়েছে বৃহৎ দুটি শো-রুম। ড্রেসের মতো ফার্নিচারের ডিজাইনও তৈরী করেন এইচ এম ইলিয়াছ। ফার্নিচার বিভাগে কাজ করে একশোর বেশি কর্মী।
ছোটবেলায় আঁকাআঁকি পছন্দ করতেন ইলিয়াছ। সে বিষয়েই উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। পেশা হিসেবেও ফ্যাশন ডিজাইনিংকে বেছে নিয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটি একাধারে ফ্যাশন, ফার্নিচার, কারুশিল্প, নির্মাণশিল্পের সবার কাছে সমাদৃত হচ্ছে।
এইচ এম ইলিয়াছের বাড়ি চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলায়। শৈল্পিক তাদের পারিবারিক ব্যবসা। মোঃ ইলিয়াছের বড় ভাই মোহাম্মদ আলী এবং শওকত আলী রয়েছেন যথাক্রমে চেয়ারম্যান এবং ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে। তার ছোট তিন ভাই লিয়কত আলী, জাহাঙ্গীর আলম, ওবায়দুল হক আছেন পরিচালক হিসেবে। পরিবারের সকল সদস্য শৈল্পিকের সবগুলো আউটলেট এবং ফার্নিচার ব্যবসা তত্ত্বাবধান করেন।
শৈল্পিক কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছে নানা পুরস্কার। ক্লোজআপ ওয়ান ফ্যাশন প্রতিযোগিতা ২০০০ পুরস্কার, অন্যদিন, প্রথম আলোর ঈদ ফ্যাশন প্রতিযোগিতায় অসংখ্যবার পুরস্কার জিতেছে শৈল্পিক। তাদের পরবর্তী প্রজন্মও এই ব্যবসার হাল ধরছেন। দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে শৈল্পিক ব্র্যান্ডের ড্রেস বিদেশে রপ্তানি করার পরিকল্পনা আছে তাদের পরবর্তী প্রজন্মের।
শৈল্পিকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এইচ এম ইলিয়াছ বলেন, "ফ্যাশন ব্র্যান্ড হিসেবে শৈল্পিককে এত দূর নিয়ে এসেছি আমরা। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম এর পরিধি আরো সম্প্রসারণ করবে। শৈল্পিকের পোষাক বিদেশে রপ্তানি করবে।"
তিনি বলেন, "ব্যবসা পরিচালনায় বর্তমানে বেশকিছু সংকট মোকাবেলা করতে হচ্ছে। শ্রমিকের মজুরী বৃদ্ধি, কাঁচামাল ও দোকান ভাড়া বৃদ্ধি সর্বোপরী ভ্যাট বিভাগের মাত্রাতিরিক্ত হয়রানি আমাদের হতাশ করছে। ভ্যাট বিভাগের কর্মকর্তাদের অযাচিত হস্তক্ষেপ, হয়রানি, অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার প্রবণতায় ব্যবসা সম্প্রসারণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।"
ব্যবসার প্রসারে এসব বাধা দূর করার জন্য সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।